তাহলে গল্পটাই বলি!
আমার যে ‘আইটি প্রজেক্ট’টি ছিল সেটার অফিস নিয়েছিলাম নয়াপল্টন।
নয়া পল্টন মানে এক্কেবারে ‘পল্টন মডেল থানা’র ঠিক উল্টো পাড়ে, সিটি হার্ট ভবনের পেছনের গলিতে দুই-তিনটা বিল্ডিং এর পরে।
বছর দু’য়েক এ অফিসটাতে আমি নিয়মিত বসতাম।
আস্তে আস্তে হলো কি- ঐ থানার কর্তাবাবুদের সংগে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল।
ওসি, সেকেন্ড অফিসারসহ বেশ কয়েকজন ‘এসআই’ এর সংগে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। ওদের মধ্যে ‘একটা এসআই’ একটু বেশী ঘনিষ্ঠ হবার নেশায় মেতে উঠলো। পরে বুঝতে পারলাম তার কিছু নিয়মিত মাসোহারা প্রয়োজন।
ঐ ব্যাটা করতো কি প্রতিমাসেই হঠাৎ করে একদিন ৪/৫ জন ফোর্স নিয়ে আমার অফিসে ঢুকে পরতো। তারপর তার বাহিনীকে আমার ওয়েটিং রুমে বসিয়ে নিজে আসতো আমার চেম্বারে।
প্রথম দিন আমি বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার? এসব কি? ঠুল্লা বাহিনী নিয়ে আমার অফিসে ঢুকেছেন কেন? আমার এসব পছন্দ নয়!’
দারোগা হেসে দিয়ে বলল, ‘রাগ করেন কেন ভাইজান? একটু বলতে দেন। ভালো না লাগলে চলে যাবো।’ তারপর যোগ করলো, ‘আসলে আপনাকে একটু সহযোগীতা করতেই এটা করেছি। জানেনই তো এই এলাকাটা মাস্তানদের আঁখড়া। আপনার অফিসে যখন তারা দেখবে প্রায়ই পুলিশ বাহিনী এসে চা-বিস্কুট খায় তখন আর আপনাকে ডিষ্টার্ব করার সাহস পাবে না। সবাই যেন আপনাকে একটু সমীহ করে চলে- বুঝতে পারে থানার সংগে আপনার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে সেজন্যই এমনটা করছি’।
‘থাক ভাই, আমার এতো ঘনিষ্ঠতা লাগবে না, প্লিজ ওদের বিদেয় করুন; আপনি আসছেন কি খাবেন বলেন- এনে খাওয়াই’।
যাই হোক, ঐ দারোগার পুরো দলবলকে কেক আর কোক আনিয়ে খাওয়ালাম। তারপর যাবার সময় আমাকে ঐ দারোগা এসে বলে ভাই এত্তোগুলি পুলিশ আইছে খালি হাতে বিদেয় করবেন? আমার থানায় গেলে আপনাকে সাহায্য করবো। ওদের খালি হাতে বিদেয় করলে আমার ইজ্জত থাকবে না।
অগত্যা বিরক্ত মুখে ৫০০ টাকা দিয়ে জোর করে বিদেয় করলাম।
আমর নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ঐ পুলিশ তার দলবল নিয়ে আরও প্রায় ৫/৭ বার আমার অফিসে এসেছে। এবং প্রতিবারই আমাকে ওদের অাপ্যায়ন করতে হয়েছে।
অথচ আমার সংগে তার ব্যবহার ছিল অসাধারণ।
কারণে অকারণে আমাকে ফোন করতো। প্রায়ই আবার আবদার করতো ‘ভাই লাঞ্চ করান।’
মাঝে মধ্যে করাতামও।
আর খালি একটা কথা বলতো- ‘ভাই আপনি আমার উপর বিরক্ত হবেন না। আপনাকে আমি খুব পছন্দ করি। কোনদিন বিপদে পড়লে দেখবেন বুক পেতে সামনে দাঁড়াবো।’
আমি বলতাম, ‘আমি কোনদিন বিপদে পরবো না, আপনাকে কষ্ট করে দাঁড়াতেও হবে না’।
আরও একটা কথা বলতো, ‘আমি রিটায়ারমেন্টে যাবার পর ব্যবসা করবো। আমাকে আপনি গাইড করবেন।’
যাই হোক আরও কয়েকজন এসআই এর সংগেও ঘনিষ্ঠতা ছিল কিন্ত ও ছিল নাছোরবান্দা। শুনলে অবাক হবেন সে আমাকে এখনও আমেরিকায় ফোন করে, প্যাচাল পারে। সে আবার মোহাম্মদপুর থানা আম্লীগের নেতাও!
যাই হোক, ওর অনুরোধে অনেকবার থানায় যেতাম। অবসরে সময় পেলে আড্ডাও দিতাম অন্য এসআইদের সংগে, ওসির সংগেও।
আমার টেলিকমিনিউনিকেশনস ব্যবসা ছিল সেটা ও জানতো।
বিশেষ করে আমি যে টেলুলার আমদানী করতাম এবং একটা সময় গেটওয়ে, ইওরোটেকও আনতাম সেটাও আলাপ প্রসংগে ও জানতো।
তো, একদিন হঠাৎই সে রাত প্রায় ১১টার দিকে আমার বাসার নীচে এসে ফোন দিলো, ‘ভাই একটু নীচে নামেন আপনার সংগে জরুরী একটা আলোচনা করবো।’
আমি বললাম, ‘না, আজ আর নামবো না বেশী দরকার হলে বাসায় আসেন’।
ও বলল, ‘না ভাইজান, আমি ইউনিফর্মে এসেছি- আপনার বাসায় এত রাতে আসবো না; আপনার বাসার দারোয়ান, অন্যরা ভিন্ন কিছু ভেবে বসবে। আপনার হেল্প আমার দরকার। একটু নামেন প্লিজ’।
ওর রিকোয়েষ্টে নীচে নামলাম, একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম।
আমাকে বলল, ‘ভাই একটা ইওরোটেক মেশিন এর দাম কত?’
‘হঠাৎ ইওরোটেক এর দাম কেন? আমি তো এসব প্রডাক্ট এখন আর আনি না। আনার কোন ইচ্ছেও নাই। যখন অবৈধ ছিল না তখন আনতাম।’
‘আমি জানি, আপনার সব ইনফরশেনই আমার কাছে আছে। কিন্তু আমার দামটা জানা দরকার। একটু বলেন।’
‘নতুন মেশিন এর দাম আট লাখ টাকা, সেকেন্ড হ্যান্ডটা তাও ৪/৫ লাখ টাকা হবে। কিন্তু কেন?’
‘আমার থানার স্টাফরা রেইড দিয়ে গতকাল একটা ভিওআইপি সেটআপ আটক করে এনেছে। এখন এক পার্টি আমার কাছে এসেছে ঐ আটককরা ইউরোটেকটা কিনতে। তাই দাম জানতে এসেছি। ওরা আমাকে মাত্র ২ লাখ টাকা দিতে চায়। কন শালারা কি টাউট, মাত্র দুই লাখ টাকা দিয়ে ৮ লাখ টাকার মাল নিতে চায়।’
আমি তাকে বললাম, ‘আটক করা মাল আপনি কিভাবে বিক্রি করবেন? আপনাদের ষ্টোরে হিসাব থাকে না?’
‘আরে ভাই, আপনি তো দেখি মহাবোকা! বিক্রি করা কি কোন ব্যাপার? থানার লোক কি আর ইউরোটেক চিনে? তারা চিনে মেশিন। মেশিনের জায়গায় মেশিন থাকবে মাঝ খান থেকে আসল জিনিস বিক্রি হয়ে যাবে; বুঝেন নাই?’
‘তার মানে!’
‘পার্টি সেইম টাইপ দেখতে একটা যে-কোন ডামি বক্স দিবে আর টাকাও দিবে; আমি শুধুমাত্র ঐ ডামি বক্সটা চেঞ্জ করে আসল বক্সটা বিক্রি করে দিবো। মালের জায়গায় মাল থাকবে- সচল মেশিন আটকে রেখে লাভ কি? ওদেরও লাভ হবে, আমাদেরও লাভ হবে। এই যে পুলিশ রাব এতো এতো মেশিন আটক করে- কোথাও আটককৃত মেশিন আর থাকে না। এমনকি কাষ্টমস এর গোয়েন্দারা যে প্রতি বছর হাজার হাজার সোনার বার আটক করে ব্যাংকে জমা রাখে- ওসবও আর ব্যাংকে থাকে না। তামার বারের সংগে আসল সোনার বার বদল হয়ে যায়। এসব কি আপনি জানেন না?’
‘কি বলেন আপনি এসব! তাহলে কি এভাবেই চলছে সবকিছু!’ আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
দু’দিন পরে ওই দারোগা আমার অফিসে এসেছে সিভিল ড্রেসে।
গল্প করতে করতে একটা ৫০ হাজার টাকার বান্ডেল আমার টেবিলে রেখে বলল, ‘ভাই এই নেন আপনার কমিশন। মানুষ বলে পুলিশ নাকি কখনও কারো বন্ধু হয় না- এটা মিথ্যা। আপনাকে আমি সত্যিকারের বন্ধু মনে করি। টাকাটা রাখেন। আমি ২লাখ টাকা লাভ করছি মেশিনটি বিক্রি করে, তাই আপনার জন্য ৫০ হাজার।’
আমি টাকাটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘হারাম টাকা আমার হজম হয় না’।
সব মানুষ হারাম টাকা খেতে পারে না!
সবার পেটে ওসব সয় না। কম্বল, লবন, আস্ত ব্যাংক এবং শেষটায় ব্যাংকের ভোল্টে রাখা সোনার বার- ইত্যাদি সবকিছুই অনেকে দিব্যি খেয়ে হজম করে ফেলতে পারে।
আমি বদহজমের ভয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছি।
আমেরিকায় হারাম টাকা আয়ের কোন সুযোগ নেই, তবে অগাধ শান্তি আছে এখানে। আর হালাল টাকা আয়ের প্রচুর সুযোগও রয়েছে এখানে।