অস্ট্রেলিয়া

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া ভ্রমন করে আসলাম।

ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহ পুরোটাই কাটালাম সিডনীতে; মাঝে মোটে ১২ ঘন্টার জন্য ছিলাম মেলবর্ন।

একটা দেশ সম্পর্কে লিখতে এটা মোটেও যথেষ্ঠ সময় নয়।

তারপরও কিছু বিষয় বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই এই লেখা।

অস্ট্রেলিয়া বিশাল বড় দেশ।

আয়তনের দিক হিসাবে রাশিয়া, ক্যানাডা এবং চায়না, আমেরিকা, ব্রাজিলের পরই অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান। যদিও জনসংখ্যা মোটে ২৬ মিলিয়ন (২ কোটি ৬০ লাখ)।

আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে আয়তনে সামান্য বড় একটি দেশ, অথচ এর জনসংখ্যা ৩২৫ মিলিয়নের চেয়েও বেশী যা কোটির হিসাবে প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি।

সিডনী শহরটির জনসংখ্যা ৫ মিলিয়নের কিছু বেশী অপরদিকে মেলবর্ন এর জনসংখ্যাও মোটামুটি ৫ মিলিয়নই। শহর দু’টি নিয়ে একটি মজার ঘটনা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া রাজধানী কোন শহরটি হবে এটা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়ে যায়। সিডনীবাসী দাবী করে বসে সিডনীই হবে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী; অপরদিকে মেলবর্নবাসীও অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলে – কোন যুক্তিতে মেলবর্নকে বাদ দিয়ে সিডনী রাজধানী হবার দাবীদার?

দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় শহরদুটির মধ্যে।

অবশেষ, সিডনী ও মেলবর্নকে খুশী রাখতে এই শহর দুটির মাঝামাঝি ক্যানব্যারাকে রাজধানী ঘোষনা করা হয়।

একটু আগেই বললাম, আমি সিডনীতে ছিলাম প্রায় ৭ দিন এবং মেলবর্ণে মাত্র একদিন। কিন্তু আমার কাছে মেলবর্নকে সেরা শহর মনে হয়েছে। মেলবর্নকে মনে হয়েছে খুবই পরিপাটি ও গোছালো একটি শহর।

সবচে বেশী যেটা ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে, মেলবর্ন সিটির ট্রাম সার্ভিসটি। চমৎকার সুন্দর নেটওয়ার্ক রয়েছে মেলবর্ন ট্রামের। ডাউনটাওনের প্রতিটি অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ট্রাম লাইন। কয়েক মিনিট পরপরই রয়েছে সার্ভিস। এবং সবচে মজার বিষয়টি হচ্ছে এই ট্রাম সার্ভিস সম্পূর্ণ ফ্রি। কোন টিকেট কাটতে হয় না ট্রামে উঠতে।

একটা মেট্রো সিটিতে এমন ফুল ফ্রি সার্ভিস আমি এই প্রথম দেখলাম।

কুয়ালা লামপুর এবং হলি সিটি মক্কায় আমি ফ্রি শ্যাটল বাস দেখেছি কিন্তু তার সার্ভিস এতোটা ব্যাপক ও নিরবিচ্ছিন্ন নয়।

যাই হোক, আলোচনায় ফিরি।

সিডনী বা মেলবর্নের জনসংখ্যা ৫ মিলিয়ন; তবে নিউ ইয়র্ক সিটির জনসংখ্যা সাড়ে ৮ মিলিয়ন।

কিন্তু নিউ ইয়র্ক সিটির যে ব্যস্ততা আমরা উপভোগ করি, সিডনী বা মেলবর্ন তার ধারে কাছেও নেই। নিউ ইয়র্ক সিটি ২৪ ঘন্টাই জেগে থাকে। কিন্তু সিডনী বা মেলবর্ন সন্ধ্যা রাতের পরই ঘুমিয়ে পরে। সুতরাং নিউ ইয়র্কের সংগে সিডনী-মেলবর্নকে আমি কোনভাবেই তুলনায় নিতে পারবো না।

সিডনীকে আমি কিছুটা তুলনা করতে পারবো টেক্সাসের ডালাস টাইপ শহরগুলোর সংগে। তবে, সে তুলনায় সিডনী বা মেলবর্ন এর আয়তন বেশ বড়।

টেক্সাসের ডালাস, আর্লিংটন এবং ফোর্ট ওর্থ এই তিনটি সিস্টার সিটিকে এক নামে ডাকা হয়ে ‘ডালাস-ফোর্ট ওর্থ’ নামে। ডালাস ফোর্ট ওর্থ এর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ মিলিয়ন। কিন্তু ডালাস-ফোর্ট ওর্থ শহরতিনটির

সম্মিলিত আয়তনও এককভাবে সিডনী বা মেলবর্ন এর চেয়েও কম।

ডালাস ফোর্ট ওর্থও সিডনী-মেলবর্ন এর মতোই গ্রামীন শহর। কিন্তু চাকচিক্যের বিচারে ডালাস ফোর্ট ওর্থ সিডনী বা মেলবর্ন এর চেয়ে অনেক এগিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধান শহরগুলো মিনিমাম ওয়েজ কমবেশী ২২ অস্ট্রেলিয়ান ডলার (১৬ আমেরিকান ডলার)। নিউ ইয়র্ক সিটির মিনিমাম ওয়েজ ১৫ ডলার। সে হিসাবে অস্ট্রেলিয়ায় বেতন বেশী। এমনকি নিউ ইয়র্ক ১৫ থেকে ২০ ডলারের মধ্যেই বেশীরভাগ অডজবগুলোর বেতন হয়ে থাকে। কিন্তু সিডনীতে ঐ মানের স্যালারী হয়ে থাকে ৩৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার বা সাড়ে ২৩ আমেরিকান ডলার। অর্থাৎ নির্দিধায় বলা চলে যে অস্ট্রেলিয়ায় বেতন আমেরিকার চেয়ে কিছুটা বেশী। ডালাস ফোর্ট ওর্থে মিনিমাম ওয়েজ ১০ ডলার। অর্থাৎ আরও কম।

কিন্তু অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার জীবন মান অনেক বেশী ব্যয়বহুল। ওখানে ২ ডলারের নীচে কোন খুচরা পন্যের দাম হয় না। যদিও আমেরিকায় ১ ডলারের নীচেও অনেক পন্য খুচরা বিক্রি হয়।

সিডনীতে একটি ১ বেড রুমের বাসাভাড়া সপ্তাহে মোটামুটি ৫০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার বা ৩৩২ আমেরিকান ডলার যা মাসে হয় ১৩২৮ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার বাসা ভাড়া সপ্তাহিকভাবে দিতে হয় আর আমেরিকায় মাসিকভাবে। নিউ ইয়র্কে ১ বেড রুমের একটি বাসাভাড়া ২০০০ ডলার। কিন্তু আমি যেহেতু সিডনীকে তুলনা করেছি ডালাস ফোর্ট ওর্থ এর সংগে; সেহেতু আমাকে ডালাসের বাসা ভাড়া তুলনায় নিতে হবে। ডালাস ফোর্ট ওর্থে ১ বেড রুমের ঐ স্ট্যান্ডার্ডের একটি বাসা ভাড়া ম্যাক্সিমাম মাসিক ৬০০ ডলার। অর্থাৎ সিডনীর বাসা ভাড়া ডালাসের দ্বিগুনেরও বেশী।

অস্ট্রেলিয়ার আয় আমেরিকার চেয়ে বেশী হলেও ব্যয় আমেরিকার চেয়ে কয়েকগুন। অস্ট্রেলিয়ায় আমি একটি ইউনিভার্সেল মাল্টিপ্লাগ কিনেছি ৪০ ডলারে যা আমেরিকায় ৮ ডলারেই পাওয়া যায়। খাবারের মুল্য তুলনামূলক বিচারে আমেরিকার চেয়ে একটু বেশী। জামা-কাপড় এর মুল্য প্রায় দ্বিগুন। আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে আমেরিকার তুলনায় দ্বিগুন মুল্যে। ইলেকট্রনিক্স দ্রবাদীর মুল্য আমেরিকার দ্বিগুনেরও বেশী; কখনও বা তিনগুন বেশী। অর্থাৎ জীবন যাত্রা আমেরিকার চেয়েও অনেক বেশী এক্সপেনসিভ। সে হিসাবে আমেরিকায় বেতন কিছুটা কম হলেও জীবন যাত্রার মুল্য অনেক সস্তা। আমেরিকায় জামা-কাপড় এবং ইলেকট্রনিক্স এর মুল্য চায়নার চেয়েও সস্তা।

নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি ওয়ান ফ্যামেলী হাউজের দাম মোটামুটি ৭০০ হাজার ডলার; কিন্তু সিডনীতে একটি সমমানের বাড়ীর মূল্য ১ মিলিয়নেরও বেশী। টাকার মানে সমান।

কিন্তু আগেই বলেছি সিডনী কোন ভাবেই নিউ ইয়র্কের সমমানের শহর নয়। ডালাস বা ফোর্ট ওর্থ-এ ঐ মানের একটি বাড়ীর মুল্য ম্যাক্সিমাম ১৫০ হাজার ডলার। এমনকি ফিলাডেলফিয়া বা আলবেনীতেও ১৫০ হাজারে চমৎকার সব বাড়ী পাওয়া যায়; যার মুল্য সিডনীতে ১.২ মিলিয়নেরও বেশী। এমনকি মোটে ২০০ হাজার ডলারে ৫ একর জমি সহ আলিশান বাড়ীও পাওয়া যায় আমেরিকার শহুরে গ্রামগুলোতে যা অস্ট্রেলিয়ায় চিন্তাও করা যায় না।

আমেরিকায় বৈধ হবার সুযোগ সুবিধা সংকুচিত হচ্ছে দিনকে দিন। ক্রাইম না করলে কাগজপত্র ছাড়াও আমেরিকায় চিরজীবন বসবাস করা যায়; অস্ট্রেলিয়াতেও তাই। তবে, অস্ট্রেলিয়াতে ভিজিট ভিসায় গিয়ে তা স্টুডেন্টে ভিসায় পরিবর্তন করে অথবা স্টুডেন্ট ভিসায় যাবার ২ বছর পরই ‘পিআর’ পাওয়া সম্ভব এবং টোটাল ৪ বছর বসবাস করলেই সিটিজেন হওয়া যায়। কিন্তু আমেরিকায় ’পিআর’ (গ্রীনকার্ড) পাবারও ৫ বছর পর সিটিজেনশীপ পরীক্ষা দেয়া যায়। আর স্টুডেন্ট ভিসায় আগতদের আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করার পরও নানা ঝক্কি ও সময় পার করতে হয় – পিআর যে পাবেই তার কোনই নিশ্চয়তা থাকে না। তবে, এসাইলাম করে আমেরিকায় পিআর পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক সোজা।

অস্ট্রেলিয়ায় আমেরিকার মতো ‘চেইন মাইগ্রেশন’ নেই। সেখানে জন্মসূত্রেও নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। চেইন মাইগ্রেশন না থাকায়, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজন আমেরিকায় বসবাসরতে বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকদের চেয়েও তুলনামূলক হিসাবে অনেক বেশী শিক্ষিত, সচেতন এবং গ্রাম্য নয়। আমেরিকায় স্টুডেন্ট এবং ভিজিট ভিসায় আগতরা এই হিসাবের বাইরে।

অস্ট্রেলিয়ার আমার ৮ দিনের হিসাবে আমি সিডনী ও মেলবর্ন সিটি মিলিয়ে সর্বমোট ৯ জন কালো মানুষ দেখেছি। আর আমেরিকার যে-কোন রাস্তায় বের হলেই আপনি প্রতি ১৫ মিনিটে ১৫ জন করে কালো মানুষ দেখতে পাবেন।

আমেরিকায় ক্রাইম অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক বেশী। শুনেছি আমেরিকায় যে হারে কালোরা ক্রাইম করে, অস্ট্রেলিয়াতে সেই হারে ক্রাইম করে লেবানিজরা। আরবরা।

অস্ট্রেলিয়ার আমেরিকার মতোই স্বাধীনভাবে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে বলেই জেনেছি। রমজান মাসে সিডনীর গ্রোসারীগুলো ভোগ্যপন্যের মূল্য নাকি অর্ধেক কমিয়ে দেয়।

অস্ট্রেলিয়ার রাস্তাঘাট ইংল্যান্ডের মতো ন্যারো নয়; যদিও আমেরিকার মতো ততটা উন্নত এবং প্রসস্তও নয়।

অস্ট্রেলিয়ার সবচে বাজে দিকটি হচ্ছে এখানে আমেরিকার মতো ব্যক্তি স্বাধীনতা উপভোগ করা যায় না। আইন-কানুন অত্যন্ত কঠিন। পান থেকে চুন খসলেই এখানে ৪০০-পাচশত ডলার টিকেট খেতে হয়। সামান্য পার্কিং টিকেটও এখানে ৫০০ ডলার; যা আমেরিকায় ১২০ থেকে দেড়শত ডলারের মধ্যে। স্ট্রিট পার্কি ফিও আমেরিকার স্ট্রিটের চেয়ে ৫ ‍গুন বেশী।

তারপরও অস্ট্রেলিয়ায় চাকুরীজীবিদের (যে-কোন জব) জন্য দারুন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার মতো ল্যান্ড অব অপুর্চুনিটিজ নয়। এখানে সুযোগ-সুবিধা আমেরিকার তুলনায় খুবই গৌন। বা সেভাবে কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। বিশাল দেশ অল্প মানুষ, কি ব্যবসা করবেন? তবে চাকুরীর বাজার খুবই ভালো।

যারা চাকুরী করে ভালো টাকা আয় করতে চান, তাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া ভালো। অবশ্য সিডনীতে একজন ড্রাইভার উবার বা ট্যাক্সি চালিয়ে দিনে ৩০০ ডলারের (২০০ আমেরিকান ডলার) বেশী আয় করতে পারে না। কিন্তু নিউ ইয়র্কে একটু পরিশ্রম করলে দিনে ৪০০ ডলারও আয় করা সম্ভব।

অর্থাৎ সেল্ফ এমপ্লয়ীদের জন্য আমেরিকা অবশ্যই স্বর্গরাজ্য। আর ব্যবসায়ীদের জন্য তো আমেরিকা সেরা ভুখন্ড। আমেরিকায় ইলন মাস্ক, বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গরা তৈরী হতে পারে, অস্ট্রেলিয়ায় নয়।

অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের পোষাক অনেক মার্জিত; যেটা আমি লন্ডনে দেখিনি। আমেরিকার হোয়াইট ছেলে-মেয়েদের পোষাক তুলনামূলক বিচারে অস্ট্রেলিয়ার চেয়েও সমৃদ্ধ ও মার্জিত রূচির।

আর আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন আমেরিকার সংগে অস্ট্রেলিয়ার মুল পার্থক্য কোথায় – তাহলে আমি উত্তর দিবো, আমেরিকার সংগে অস্ট্রেলিয়ার তুলনা চলে না। আমেরিকায় একজন মানুষ সত্যি সত্যিই অনেক বেশী স্বাধীন। যা অস্ট্রেলিয়ায় চিন্তা করা যায় না।

আমেরিকার পুলিশ অনেক বেশী ফ্রেন্ডলী, হাসিমুখে কথা বলে, ফান করে এবং বুঝে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ নাকি বাংলাদেশী পুলিশদের মতোই, শুধুমাত্র ঘুষ খায় না।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের মতো রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভার ও কার চেক করতে দেখেছি যা আমেরিকায় এসে ভুলেই গিয়েছিলাম।

তারপরও যারা চরম উচ্চাভিলাসী নয়, তাদের জন্য আমি অস্ট্রেলিয়াকেই সেরা দেশ বলবো।

আমেরিকা শুধুই উচ্চাভিলাসীদের জন্য।

   Send article as PDF