মৃত্যুই ছিল আনিসুল হকের একমাত্র অপশন

তখন রাত সাড়ে আটটা।
আমার অফিসে আমার ডাইরেক্ট ল্যান্ড নাম্বারে একটা ফোন আসলো।
 
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভরাট গলায় একজন খুব সুন্দর করে বললেন, ‘তৌফিক ভাই আসসালামুআলাইকুম, কেমন আছেন? আপনি যদি আর ঘন্টা খানেক অফিসে থাকতে পারেন তাহলে আমি আপনার অফিসে একটু চা খেতে আসবো।’
 
খুব পরিচিত একটা কন্ঠস্বর কিন্তু আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে মানুষটা ঠিক কে!
 
নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমি আনিসুল হক, এবারের এফবিসিসিআই নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী; আপনার সংগে একটা পরিচিত হবো, কথা বলবো।’
 
সেখান থেকেই পরিচয়।
ওটা ২০০৭ এর ঘটনা যদ্দুর মনে পরছে।
 
এফবিসিসিআই এর নির্বাচন পদ্বতিটা বেশ মজার যদিও এটাকে আরেকটু পরিচ্ছন্ন এবং গণতান্ত্রিক করার সুযোগ রয়েছে। বিজিএমইএ থেকে আনিসুল হক সরাসরি এফবিসিসিআই এ ডাইরেক্টর মনোনীত হয়েছেন বিধায় তার আর সরাসরি আমাদের কোন ভোটের প্রয়োজন ছিল না। তার প্রয়োজন ছিল তার ‘প্যানেল’কে নির্বাচিত করতে আমাদের সহযোগীতা তথা ভোটগুলি।
 
যাই হোক, আনিসুল হক ২-বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন- আমরা তার পক্ষে কাজ করেছি, ভোট দিয়েছি। তার বক্তব্য শুনেছি, মুগ্ধ হয়েছি।
 
এফবিসিসিআই এর নির্বাচন হলো বাংলাদেশের সবচে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নির্বাচন। এই নির্বাচনের প্রচারণা-মিটিং হতো ঢাকার হোটেল সোনারগাঁ, শেরাটন, পূর্বানী এবং লেডিস ক্লাবেও।
 
তবে, আনিসুল হকের বনানীর নিজ বাসভবনের বেজমেন্ট এ একটা বিশাল হল রুম রয়েছে; তাঁর অনুষ্ঠানগুলো তার সেই বেজমেন্ট হলেই অনুষ্ঠিত হতো।
 
তিনি বিভিন্ন কর্মসূচীর কথা বলতেন, আমরা শুনতাম।
তিনি নির্বাচিত হবার পর দেশের প্রায় সবগুলি চেম্বারকে একটা করে দৃষ্টিনন্দন, আধুনিক পাকা দালানের অফিস ভবন করে দিয়েছিলেন। মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যে এতটা একটিভভাবে কাজ করা যার-তার দ্বারা সম্ভব ছিল না।
 
আমরা ছিলাম এসোশিয়েশন গ্রুপে।
আমাদের প্রত্যেকটি এসোশিয়েশনকে একটা করে কমপিউটার সিষ্টেম, লেজার প্রিন্টার, ফ্যাক্স মেশিন এবং জেরক্স ব্রান্ডের ফটোকপিয়ার মেশিন দিয়েছিলেন আনিসুল হক।
 
হাটখোলার অভিষার সিনেমা হলের অপজিটে একটা বিশাল জায়গা তিনি ক্রয় করেছিলেন সেখানে এসোশিয়েশনগুলোকে একটা করে অফিস তৈরী করে দিবেন।
 
এফবিসিসিআই এর মতিঝিলিস্থ ভবনটিকে রেনোভেশন করেছিলেন।
 
মাত্র দু’বছরের মধ্যেই তিনি এতোগুলো কাজ করেছেন- যা তার আগে বা পরের প্রেসিডেন্টগণ চিন্তায়ও নিতে পারেননি কোনদিনও।
 
আনিসুল হকের কাছে আমাদের একটা সম্মিলিত দাবী ছিল- এফবিসিসিআই এর ‘প্রেসিডেন্ট পদ’টিতে যেন সরাসরি ‘জেনারেল বডি মেম্বার’দের ভোটে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা হয়।
 
তিনি কথা দিয়েছিলেন।
আমরা দেখেছি, তিনি সরকারের সংগে অনেক দৌড় ঝাপ করেছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এই দাবীটি বাস্তবায়ন করাতে।
 
তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
 
এখনও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় ‘মনোনীত ও নির্বাচিত’ ডাইরেক্টরদের ভোটে।
 
কিন্তু আমরা স্বাক্ষী তিনি তার সকল চেষ্টা করেছেন।
পারেননি। এটাকে ব্যর্থতা বলা উচিত হবে না- তার চেষ্টার কোন ত্রুতি রাখেননি। সরকারের অসহযোগীতা এবং অনীহা তার প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়নি- পাশে এফবিসিসিআই শক্তিশালি ফেডারেশন এ পরিণত হয়।
 
বাংলাদেশের কোন সরকারই চায় না যে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক।
 
আনিসুল হককে আমি কোন বক্তিতায় আওয়ামী লীগের বা বিএনপির পক্ষে কোন কথা বলতে দেখিনি। তার কিছু বড় দোষ ছিল বলে শোনা যায়- যার কিছু আমারও চোখ এড়ায়নি। তাহলো- তিনি নিজের স্বার্থটাকে খুববেশী প্রাধান্য দিতেন।
 
আমার প্রশ্ন ছিল, কে আছে বাংলাদেশে যে তার নিজের স্বার্থটাকে প্রধান্য না দিয়ে কোন একটা কাজও করে দেখিয়েছে? তারপরও আনিসুল হকের মতো করে, এতটা একটিভভাবে কোন কাজ কি কেউ করতে পেরেছেন? করেছেন?
 
আনিসুল হকের বেশ কিছু ব্যক্তিগত মতামতের সংগে আমার দ্বিমত ছিল।
তার মধ্যে প্রধানতম হলো তিনি বলতেন ‘হাসিনা-খালেদা’কে এক টেবিলে বসাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
 
আর আমি বিশ্বাস করি হাসিনা-খালেদা আওয়ামী লীগ বিএনপি দিয়ে বাংলাদেশের আদৌ কোন উন্নতি হবার সম্ভবনা নেই; সেই যোগ্যতাই এই দুই পরিবারকেন্দ্রিক দলের কোন নেতারই নেই। এবং দৃশ্যমান কোন নেতাই বাংলাদেশে নেই যারা নতুন নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখে। সম্পূর্ণ নতুনদের মধে থেকে কেউ না কেউ তার দূরদর্শি ভিশন নিয়ে আসবেই। এবং সেখানেই সফলতা লুকিয়ে রয়েছে।
 
২০১৪’র শেষে আমি চলে আসলাম আমেরিকায়।
সম্ভবত ১৫রতে শেখ হাসিনা তাকে ডেকে নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিলেন।
 
শেখ হাসিনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে- আনিসুল হক কেন নিজের বিপদ ডেকে আনবেন!
 
তিনি বুদ্ধিমান, সুযোগটাও কাজে লাগিয়েছেন, প্রস্তাব গ্রহন করেছেন। নষ্ট হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ আনিসুল হকের মতো একজন ‘নেতা’কে পেয়ে নিজেদের ‘উপরে’ উঠানোর চেষ্টা করেছে।
 
যাই হোক, আনিসুল হক দূরদর্শী মানুষ ছিলেন- যথেষ্ঠ টকেটিভও।
দূরদর্শীরা একটু বাঁচাল হবেই। কথা না বলা মানুষ খুব বুদ্ধিমান- এমনটা আমি অন্তত দেখিনি কোথাও।
 
আনিসুল হকের দৃষ্টি যে দেশের ‘প্রধান নির্বাহী’র চেয়ারটার দিকে ছিল- সেটা আমি তার চোখ দেখেই বুঝতে পারতাম।
 
সেই যোগ্যতা, সাহস, মেধা, দূরদর্শতিাও তার ছিল। শুধু ছিলনা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বা মাঠে গিয়ে রাজনীতি করার মতো দক্ষতা। তাই তিনি ‘সুযোগ’ খুজেছিলেন ‘সর্টকার্ট’ পথের!
 
আমার ক্যালকুলেশনে আমি পরিস্কার দেখতে পেয়েছি সেই সুযোগটি তার সামনে এসেছিলও। আর সেই সুযোগটি তাকে দিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থ্যা ‘র’।
 
বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই ভারতের হাতে।
ভারত যেভাবে চায় সেভাবেই দেশ চলছে। দেশের সেনাবাহিনীর অফিসার, সচিব, পুলিশ অফিসার, বিজিবি সবই এখন ভারত সরকার নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
 
তারপরও মাঝে মধ্যে শেখ হাসিনা চায়নার দিকে একটু ঝুঁকে পরে, বা পরার চেষ্টা চালায়। যেটা ভারত মেনে নিতে পারে না। আর তখনই ‘র’ জায়গামতো আঘাত করে- হাসিনাকে বুঝিয়ে দেয় যে ‘আমাদের হাতে অপশন রয়েছে’।
 
সেই ‘অপশন’টা ‘র’র তৈরী এবং সেটা ছিলেন ‘আনিসুল হক’।
 
খুবই পরিপক্ক খেলা ছিল।
 
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’কে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করেছে ‘র’।
তাকে দিয়ে সেই বিখ্যাত ‘অবজারভেশন’ টি করিয়ে নিয়েছে। তারপর দেশে নানা অস্থিরতা সৃষ্টি। ভুলটা ছিল বিএনপির- এরা বরাবরই কাঁচা খেলোয়ার। নিজেদের কিছু করার মুরোদ নেই- আগ বাড়িয়ে প্রপাগন্ড ছড়িয়েছে শুধু। পরিণামে ‘শক্ত ও কৌশলী’ হবার সুযোগ পেয়েছে শেখ হাসিনা ও তার দলবল।
 
জোর করে প্রধান বিচারপতিকে দেশত্যাগ করিয়েছে।
সেনাবাহিনীর ভেতরের গত অক্টোবরের বিশৃঙ্খলা ‘মোটা টাকার বিনিময়ে’ নিয়ন্ত্রন করিয়েছে শেখ হাসিনা।
 
এবং প্রধান বিচারপতি, আনিসুল হক এবং তার সহযোগীদের ‘কৌশল’ বুমেরাং করতে পেরেছে কিছু বিশ্বাসঘাতকতা ও টাকার বিনিময়ে।
 
এবং।
এবং চুড়ান্ত ও শেষ আঘাতটি হানা হয়েছে আনিসুল হককে।
 
সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ আনিসুল হক লন্ডন গেলেন নাতনীকে দেখতে।
পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে দেশে ফিরে তত্ববধায়ক ক্ষমতা গ্রহন করবেন আনিসুল হক।
 
সবকিছু ঠিকই ছিল।
কিন্তু, প্রধান বিচারপতির দেশ ত্যাগ, ফজলে হাসান আবেদসহ আরও কয়েকজনের জড়িয়ে যাওয়া এবং পিছিয়ে যাওয়া, শেখ হাসিনার কাছে সব পরিকল্পনার ফাঁস হয়ে যাওয়া, সেনা বিদ্রোহ সমাধান করায় শেখ হাসিনা আবারও সফলতা দেখালেন।
 
তারপর ডাকলেন জেনারেল বেলালকে।
কি শাস্তি দেবেন আনিসুল হককে- সেটা নির্ধারণ করে দিতে।
 
আনিসুল হকের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য সমূলে ধ্বংশ করে দেয়াসহ তার পুরো পরিবাররকে শেষ করা, জেনারেল বেলালকে বরখাস্ত ও কোর্ট মাশার্ল, এবং মৃত্যু।
 
জেনারেল বেলাল অসহায় আত্মসমর্পন করলেন। আত্মসমর্পন করলেন আনিসুল হকের স্ত্রী-পুত্ররাও।
 
সিদ্ধান্ত হলো, আনিসুল হককে মরতে হবে।
জেনারেল বেলাল বা রুবানা হকের হাতে অন্য কোন অপশন ছিল না।
 
এবং আনিসুল হক মারা গেলেন।
 
সম্পূর্ণ সুস্থ্য মানুষটি লন্ডন গেলেন।
কোথায় রয়েছেন কোন খোঁজ নেই। কোন হসপিটালে রয়েছেন কোন খবর নেই। কারো সংগে একটা স্বাক্ষাৎকারও নেই।
 
আনিসুল হকের মতো একজন ব্যক্তি- যিনি হসপিটালে ৩ মাস ভর্তি ছিলেন তাকে দেখতে কেউ গেলেন না; ধোয়াশায় আচ্ছন্ন ৩টি মাসের কোন খবর নেই!
 
তিনি মারা গেলেন।
দেশের সবচে একটিভ মানুষটিকেও হত্যা করলেন শেখ হাসিনা!
 
শেখ হাসিনার হাতে মুত্যুর সংখ্যা আরেকজন বাড়লো।
মৃত্যু সবসময়ই মৃত্যু ডেকে আনে- শেখ হাসিনার পালাও আসবে।
   Send article as PDF