দুবাইয়ের গল্প

৫ তারিখের (বুধবার) খুব ভোরে আমি দুবাই থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্য বিমান ধরবো। ঘটনাক্রমে ১ তারিখ শনিবার আমার দুবাই এর সকল কাজ কমপ্লিট হয়ে গেলো।

দুবাই আসার আমার মুল উদ্দেশ্য ছিলো এখানকার কোন একটি ব্যাংকে একটি বিজনেস চেকিং একাউন্ট ওপেন করা। ১ তারিখে ডেবিট কার্ডটি হাতে পেলাম।

দুবাইয়ের এমিরেটস পোস্ট সহ অন্যান্য কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানীগুলো সার্ভিস অসাধারণ; আমি অভিভূত তাদের স্মার্ট সার্ভিস দেখে। এবং এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ডেলিভারীম্যানদের ট্রেনিংও অত্যন্ত উঁচু মানের।

যাই হোক, ২ থেকে ৪ তারিখ আমার হাতে কোনও কাজ নেই।

আমি কাজ ছাড়া থাকতে পারি না। অসহ্য লাগে। কাজ চাই, কাজ। কি করা যায় ভাবছিলাম।

প্রচন্ড গরমে বাইরে যেতেও ইচ্ছে করে না।

তারপরও ২ তারিখ বিকেলের জন্য ডেজার্ট সাফারী ও ডিনার এর একটি টিকেট বুক করলাম ২০০ দেরহাম দিয়ে। ভারতের রাজস্থানের জয়সালমীরে অনুরূপ ডেজার্ট সাফারী ও বাফে ডিনারের অভিজ্ঞতা আমার ঝুড়িতে ছিলো; তবুও ভাবলাম দুবাই এর ডেজার্ট সাফারীটা এবং ডিনারটা হয়তো অন্যরকম, আরেকটু আকর্ষণীয় হবে।

বুকিং শেষ করে ভাবছিলাম ৩ তারিখ ঘুমাবো।

৪ তারিখের জন্য কিছু একটা খুঁজছিলাম – লোকল ন্যাচারের সংগে পরিচিত হওয়া যায় এমন কিছু। এবং হঠাৎ পেয়েও গেলাম।

কিন্তু সেটা আর্লি মর্ণিং এর প্যাকেজ।

মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের (জর্ডান, ওমান, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও কাতার) ন্যাশনাল এনিমেল হচ্ছে ওরেক্স। অনেকটা ছাগল ও হরিণের সমন্বয় যেন। দেখতে খুবই সুন্দর একটি প্রাণী। খুব সকালে দুবাইয়ের মরুর বুকে ডেজার্ট সাফারী, ওরেক্সসহ স্থানীয় মরুর বুকের প্রাণসমূহ পরির্দশন শেষে মরুভূমিতে অবস্থিত একটি ফাইভ-স্টার হোটেল (কটেজ) এ বাফে ব্রেকফাস্ট অফার।

এবং সবচে ইন্টারেস্টিং বিষয়টি ছিলো এই সম্পূর্ণ প্যাকেজটির মুল্য ছিলো মাত্র ৩৫ দেরহাম। একই সাইজের আগের বৈকালিক প্যাকেজটি যেখানে ২০০ দেরহাম সেখানে মাত্র ৩৫ দেরহাম দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম।

একটু দুঃশ্চিন্তাও হচ্ছিল!

বিষয়টি মেলাতে পারছিলাম না।

যাই হোক ২ তারিখে বিকেলে ডেজার্ট সাফারীতে গেলাম। দুবাই এর মরুভূমি দেখতে চমৎকার। অসাধারণ। টয়োটার ল্যান্ড ক্রজার এয়ারকন্ডিশন্ড জীপের সামনের সীটে বসে ডেজার্ট সাফারী অসাধারণ লাগছিলো। জয়সালমীরের খোলাজীপে দাঁড়িয়ে কস্টকর সাফারীর বিপরীতে এটা দারুণ ছিলো। তাছাড়া জয়সালমীরের মরুভূমিকে আমার কাছে ’মরুভূমি’ই মনে হয়নি। আমার এই সফরের সংগীরা সকলেই ছিলো ইন্ডিয়ান।

সাফারী শেষে ওদের বাফে ডিনারের জন্য নিয়ে গেলো। পরিবেশ দেখে বুঝে ফেললাম এটা ইন্ডিয়ানদের প্যাকেজ। খাবার থেকে শুরু করে স্টেজ শো সবই ইন্ডিয়ান ধাঁচের। আরও অতিরিক্ত ৫০ দেরহাম দিলাম ভিআইপি সার্ভিসের জন্য। এবং যথারীতি বিরক্ত হলাম ডিনার করে।

ফেরার পথে ড্রাইভার জানতে চাইলো – ওদের জন্য আমার কোন এডভাইস আছে কি না? জানালাম, দুবাইতে ‘ইন্ডিয়ান শো দেখতে বা খাবার খেতে আসিনি; এসেছি রিয়েল আরাবিয়ান কালচার ও ফুড এনজয় করতে’।

সে যাই হোক, আরাবিয়ান ডেজার্ট সাফারীও রয়েছে নিশ্চয়ই, হয়তো আমি খুঁজে পাইনি সেটা। আমি অবশ্য ততটা খুঁজিওনি। তাছাড়া শীতের ৪ মাস ওখানে সব ধরণের এন্টারটেইনমেন্টস ওপেন থাকে। সামারে লিমিটেড।

আমি রাত জাগা মানুষ। দিনে ঘুমাই।

কিন্তু সকাল ঠিক ৭টায় আমাকে পিক করতে গাড়ী আসবে – আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে এই ৩৫ দেরহাম মুল্যে প্যাকেজে।

রাতে একটুও ঘুম হলো না।

ঠিক ৭টায় নীচে নেমেই দেখলাম একটি অত্যন্ত আকষর্ণীয় রেঞ্জ রোভার কার। ড্রাইভার নেমে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার নাম জানতে চাইলো। নাম মিলিয়ে সামনের আসনের গেট খুলে ধরে অত্যন্ত ভদ্রচিতোভাবে ভেতরে বসতে বললো।

গাড়ীতে উঠেই দু’জন ভদ্রমহিলাকে বসা দেখলাম, ‘হাই, হাও আর ইও ডুয়িং’ এর উত্তরে তারা দু’জনই আমাকে ‘গুড মর্ণিং’ জানালো।

আমাদের ড্রাইভার ভীষন স্মার্ট। নিজের নাম পরিচয় দিলো। সে পাকিস্তানী। এবং মিস্টি হাসি দিয়ে বললো – ’আজ আমাদের গেস্টরা আমেরিকান ও জার্মানী’।

যাই হোক, ড্রাইভারের স্মার্টনেস এবং গাড়ী আমাকে বুঝিয়ে দিলো এটি একটি ভিআইপি সফর হতে চলছে। কিন্তু আমি হতবাক হচ্ছিলাম মাত্র ৩৫ দেরহামে কিভাবে এমন প্যাকেজ হতে পারে?

৪০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ডেজার্টে পৌছে গেলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মরুর বুকে অবস্থিত সংরক্ষিত (Dubai Desert Conservation Reserve) দুবাই ডেজার্ট কনজারভেশন রিজার্ভ এ। এখানে একটি ওয়াইল্ড ওরেক্স ফার্ম রয়েছে।

আমাদের ৩ জনকে আরবিয়ান হেড-স্কার্ফ পরিয়ে দেয়া হলো। তারপর নিয়ে যাওয়া হলো মরুর প্রাণীদের সংগে পরিচয় করিয়ে দিতে। এলাকাটি সংরক্ষিত। হালকা নিয়ন্ত্রিত ডেজার্ট সাফারীও হলো – ড্রাইভার আমাদের সবকিছু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছিলেন; দুস্টমীর তালে তালে।

মরুভূমিতে ৪ রকমের সাপ রয়েছে তার মধ্যে ৩টি খুবই বিষাক্ত। তার বর্ণনায় মনে হলো একটি সাপ রয়েছে যেটা দারাজ সাপের মতোই লম্বা ও খুবই দ্রুতগতিসম্পন্ন। এছাড়া অতি পয়জনিয়াস স্করপিয়ন রয়েছে, রয়েছে স্যান্ডফিস (মুরুর মাছ) এবং মরু-শেয়ালও।

ড্রাইভার জানালো এই সংরক্ষিত অঞ্চল, ডেজার্ট এনিমেল ও প্লান্টস রিসার্স সেন্টার, আল মাহা হোটেল-রিসোর্টসহ এই সম্পূর্ণ এলাকাটির মালিক দুবাইয়ের শেখ মুখদম পরিবারের একজন প্রিন্স।

দুর্দান্ত চমৎকার ডেজার্ট সাফারী শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মরুর বুকে অবস্থিত আল মাহা ফাইভ স্টার হোটেল-রিসোর্টে। এখানে প্রতি রাতের একটি রুমের ভাড়া ২ হাজার ডলার। আমাদের বাফে ব্রেকফাস্ট করানো হলো।

এরপর দুপুর ১২টা নাগাদ হোটেলে পৌছে দিলো।

এই ট্যুরটি আমাকে মুগ্ধ করেছিলো, দুবাইকে ভিন্নভাবে চেনার সুযোগ করে দিয়েছিলো।

যাই হোক, দুবাই সফরের শেষ দিনে আমার জন্য আরও একটি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো।

আগেই বলেছি, এখানে ব্যাংক একাউন্ট করতে এমিরেটস এর রেসিডেন্সী ক্রয় করতে হয়। আর রেসিডেন্সীর জন্য সর্বপ্রথম আমি ‘ইনভেস্টর’ হিসাবে একটি কোম্পানী রেজিস্ট্রেশন করি।

সব কাজ শেষে যখন ফিরে যাবো আমেরিকায়; রোহান দা যিনি আমার দুবাই-এ প্রতিটি কাজ এক্সপাডাইট (আর্জেন্ট) করে মাত্র ৫ দিনের মধ্যে করে দিয়েছেন – তিনি ফোন দিয়ে জানালেন, দুবাই এ কোম্পানী করলে ঐ কোম্পানীর মালিক (ইনভেস্টর) ও তার পার্টনারকে মিলিয়ে মোট ২টি রেসিডেন্সী দেয়া হয় যদিও আমার কোন পার্টনার নেই। এবং প্রতিটি কোম্পানীর অনুকুলে কমবেশী ৮ থেকে ১৩টি ভিসা প্রদান করা হয়।

কিন্তু আমার জন্য সারপ্রাইজিং নিউজ ছিলো, রোহান দা জানালেন – আমার কোম্পানীর জন্য দুবাই সরকার ১৯টি ভিসা এলোকেট করেছে।

এতোগুলি ভিসা দিয়ে আমি কি করবো – সেটাই তো বুঝে আসছে না!

আর আমার প্রতি দুবাই সরকারের এই একতরফা পক্ষপাতিত্বের কারণও অজানাই রয়ে গেলো।

   Send article as PDF