আসল ভ্রমণ

সে অনেক অনেক বছর আগেকার কথা।

এক দেশে ছিল এক রাজা। আরেক দেশে ছিল এক রাণী।

ওহ সরি।
রাজা-রাণী একটা দেশেই ছিল- ভিন্ন দেশে না!

থাক। এ গল্প বলতে ভালো লাগছে না।
তারচে বরং নতুন কিছু বলি।

অনেক বছর আগের কথা।
তখনও আমার সম্পূর্ণ বাংলাদেশটা ঠিক সেভাবে বেড়ানো হয়ে উঠেনি।

নতুন কোন জায়গা পেলেই চলে যাই- এরকম অবস্থা।

একদিন। গুলিস্তানে হাঁটছি।
উদ্দেশ্য বাড়ী যাবো। কাঁধে একটা হালকা ব্যাগ।

আমার ব্যাগে সবসময় দু’একটা কাপড়-চোপড় তথা প্রয়োজনীয় কিছু থাকে যাতে যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারি।

হঠাৎ একটা নতুন বাস দেখতে পেলাম।
খুব সুন্দর করে রং করা, গাড়ীটাও ঝকঝকে আনকোড়া। সাজানো।

সম্ভবত আজই নতুন রোডে নেমেছে।
গাড়ীটা পছন্দ হলো। সামনে কোন রুটের বাস- লক্ষ্য করা হয়ে উঠেনি।

তাতে কি? বাংলাদেশের বাইরে তো আর যাবে না!
সুতরাং আমি উঠে বসলাম।

সামনে দিকে সীটও পেয়ে গেলাম। বসলাম।
কোথায় যাবে জানি না। জানার কোন আগ্রহও কাজ করছিল না।

যেখানে খুশী যাক।
আমার কোন সমস্যা নেই।

গাড়ী ছুটে চলছে। যাত্রাবাড়ী পার হবার পর টের পেলাম গাড়ীটা মুন্সিগঞ্জ যাবে।

যাক না! আমার কি?

পোস্তখোলা পাড় হলো।
ফতুল্লাও।
অতঃপর মুক্তারপুর ফেরীঘাট।
মুন্সীগঞ্জ শহর।

আমিও নেমে গেলাম। তখনও সন্ধ্যা হয়ে উঠেনি।
ভাবলাম একটা হোটেল নিই। কাল ফেরা যাবে।

‘যাহাই সিদ্ধান্ত তাহাই কর্ম’।

লোকল একটা রেষ্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম।

মুন্সীগঞ্জ শহরটি বাংলাদেশের অন্য যে-কোন ছোট জেলা শহরের চেয়েও ছোট। আহমরী কিছুই নেই। রাত দশটা পর্যন্ত একটা রিক্সা নিয়ে ঘুড়ে বেরালাম।

দেখলাম। তারপরও খারাপ লাগেনি। পরদিন একটা বেবীট্যাক্সি নিয়ে আরও একটু ভেতরে গ্রামগুলিও দেখলাম- আশপাশটা।

পুরো বাংলাদেশটা আসলে দেখতে অনেকটা একইরকম।
চোখ জুড়ায়, মনও ভরে উঠে।

দুই।
আমার বন্ধু মাহাবুব।
আমার অনেকগুলি ভ্রমণেরই সংগী সে।

ও যেন রেডীই হয়ে থাকতো- আমি কবে ওকে রেডী হতে বলি।
রাঙামাটি গেলাম।

রিজার্ভ বাজারের সস্তা হোটেলে একটা রুম নিলাম। মুল রাস্তা থেকে ভবনটি উপরের দিকে নয়- নীচের দিকে ফ্লোরে রুমগুলি। কাপ্তাই লেকের কিছু অংশ মিশে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে।

রাঙামাটির অপরূপ সৌন্দর্য্যের বিনিময়ে আমি যে-কোন কিছু দিতে রাজী।
সম্পূর্ণ রিক্সামুক্ত একটা শহর।

প্রকৃতির আপন হাতে বোনা নির্ভেজাল পবিত্র সৌন্দর্য্য।
তখনও বাংলাদেশের বাইরে কোন দেশ আমার দেখা হয়ে উঠেনি সত্য। কিন্তু আজও এই পৃথিবীর অনেকটা অঞ্চল দেখা আমার অভিজ্ঞ চোখ অনায়াসেই বলে দিতে পারে- রাঙামাটির সৌন্দর্য্য অসাধারণ।

দার্জিলিং দেখেও আমি এতটা আনন্দ পাইনি- যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম রাঙামাটি দেখে। অার তাইতো অসংখ্যবার ছুটে গেছি আমি রাঙামাটিতে।

যখনই, যতবারই আমি প্রকৃতিকে ‘মিস’ করেছি- ঠিক ততবারই আমি ছুটে গিয়েছি রাঙামাটি অথবা শ্রীমঙ্গল; এই তো সেই সেদিনও পর্যন্ত।

যাই হোক। যা বলছিলাম।
হোটেলে ব্যাগ রেখে, একটা গোসল দিয়েই মাহাবুবকে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। ওটা ছিল জীবনের প্রথমবার রাঙামাটি। সবকিছুই অচেনা। বয়সও অনেক কম। অভিজ্ঞতা ঝুড়ি খালি বললেই চলে।

মাহাবুব জানতে চাইলো, ‘কৈ যাবি এখন?’
আমি উত্তরে বললাম, ‘ঠিক জানি না; দেখি না কৈ যাওয়া যায়।’

আমার পাগলামী সম্পর্কে মাহাবুরের কিঞ্চিত ধারণা রয়েছে। তবে এটাও সত্য ও আমার পাগলামীতেও যথেষ্ঠ ভরশা রাখে।

রিজার্ভ বাজার বাসস্ট্যান্ড এ দাঁড়ানো আমরা দু’জন। কোথায় যাবো জানি না।

সেদিনও সুন্দর একটা বাস। চিটাগাং যাচ্ছে না খাগড়াছরি অথবা অন্য কোন গভীর বনে ঢাকা গ্রামে- কে জানে? কনডাক্টরের কাছে জানতে চেয়ে সময় নষ্ট করার কি দরকার? উঠে বসলাম।

গাড়ী চলছে বেশ দ্রুত গতিতেই। আমি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখছি দু’চোখ মেলে। কোন একটা দৃশ্যও যেন মিস না হয়ে যায়।

বোধ হয় মিনিট বিশেক পর কনডাক্টর এসে জানতে চাইলো, ‘কোথায় যাবেন?’ কনডাক্টরের আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল।

আমি জানতে চাইলাম, ‘গাড়ীটা কোথায় যাবে?’

বেচারা কনডাক্টর জীবনে মনে হয় এতটা পাগলা প্যাসেঞ্জার আর দেখেনি। সে বিরক্ত হলো। বিরক্তি নিয়েই বলে উঠলো, ‘আপনি জানেন না কোথায় যাবে? না জেনেই গাড়ীতে উঠেছেন?’

আমি তার বিরক্তির কারণ হতে চাইলাম না। এখন হলে অবশ্য অনেক মজা করতাম। কিন্তু তখনতো আমি নিতান্তই পুলাপান। কে জানে উল্টাপাল্টা ভেবে আবার না কোন ঝামেলায় ফেলে দেয়।

একটা স্বাভাবিক দম নিয়ে বললাম, ‘সামনের ষ্টপেজ এ নামিয়ে দিয়েন; কত ভাড়া দুজনের?’

কনডাক্টর মনে হয়ে মনে মনে আপদ বিদেয় হবে ভেবে খুশীই হলো। আমি তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিলাম।

আমাদের ঠিক যেখানটায় নামিয়ে দেয়া হলো, এখনও প্রায় ২৩ বছর পরেও পরিস্কার পরিস্কার মনে রয়েছে জায়গাটার নাম মানিকছড়ি।

ছোট পাহাড়ী গ্রাম মানিকছড়ি।

খোলা মেলা। বাড়ীঘর নেই বললেই চলে। চারদিকে শুধুই সবুজ পাহাড় আর পাহাড়।

পাগল করে দেয়া সৌন্দর্য্য।

মাহাবুব অার আমি পালা করে ছবি তুলে যাচ্ছি।
একটা বড় পাহাড়ে উঠবো সিদ্ধান্ত নিলাম।

হঠাৎই কি মনে করে যেন মাহাবুবকে বললাম, একা একা অপরিচিত এলাকায় না ঘুড়ে চল একটা বাড়ী খুঁজে নিই, দেখি কাউকে পাওয়া যায় কিনা সাহায্য করার।

একটা বাশের ঘড় পেয়েও গেলাম পাশেই। দরজায় কড়া নাড়লাম।

একটা পাহাড়ী ছেলে বের হয়ে আসলো।
নাম জানালো ‘আয়রন দেওয়ান’।

আয়রনের সংগে মুহুর্তেই ভাব জমিয়ে ফেললাম। আমাদের’চে বয়সে ছোটই হবে। বলল ক্লাস টেন এ পড়ে।

আমি ওকে সুন্দর করে অনুরোধ করলাম, ‘আয়রণ তোমাদের কোন পাহাড় নেই? চলো না একটু ঘুরে দেখবো, ছবি তুলবো।’

আয়রণ আমার কথায় উৎসাহ পেল। বলল, ‘হ্যাঁ আছে তো। আমরা আনারস চাষ করি। চলুন।’

একটা বড় পাহাড়ের চুড়ায় উঠলাম। প্রচুর ছবি তুললাম।
অতপর ক্লান্ত শরীরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম রাঙামাটি।

ঠিক তখনই কোত্থেকে উদয় হলো একজন আর্মি অফিসার।
কাছে এসে জানতে চাইলে কোত্থেকে এসেছি, কেন এই দুর্গম পাহাড়ে উঠেছি। সংগে কে কে রয়েছে? কি চাই ইত্যাদি।

বললাম, যা সত্যি তাই। আয়রনের সংগে পরিচয়ে কথাও বললাম।
অফিসার প্রচন্ড রকমের বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘আপনারা এই দুর্গম পাহাড়ে উঠেছেন একজন উপজাতীয় ছেলের সংগে; তাও আবার এই শান্তিবাহিনী অধ্যুসিত মানিকছড়িতে! আপনার সাহস তো ভয়ংকর?’

আমাদের আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাদের একটা জীপে গিয়ে বসতে বলল। কোন ভাবেই আর্মি অফিসার আমাদের একা একা রাঙামাটিতে ফিরতে দেবে না; এমনকি পাবলিক বাসের জন্য অপেক্ষাও করতে দেবে না।

মানিকছড়ি তখন শান্তিবাহিনীর একটা বড় ঘাটি।
আর্মি অফিসার আমাদের বলল, তাদের গাড়ীতে করে আমাদের রাঙামাটিতে আমাদের হোটেলে পৌছে দেবে এবং আমরা যেন কোন অবস্থাতেই এসব এলাকায় আর কখনও না অাসি।

আমাদের নাকি কপাল অনেক ভালো- তাই তখনও পর্যন্ত কিডন্যাপড হইনি।

কি জানি! আমার কপালতো কখনওই খারাপ দেখলাম না অন্তত কোন ভ্রমণে গিয়ে।

এবং তিন।

এভাবেই চলছিল আমার ভ্রমণ পর্ব।

অসংখ্য শহর, জনপদ, গ্রাম, দেশ ভ্রমণে সমৃদ্ধ হয়ে উড়ে আসলাম অামেরিকায়।

পৃথিবীর প্রায় গোটা বিশেক সাবওয়ে পাতাল রেলেও চড়া হয়েছে। নিয়ম-কানুন আদ্যপান্ত বলতে গেলে সবই মুখস্থ।

সুতরাং। একটু বেশীই বাহাদুরী করি।
এবং সেই বাহাদুরীর রেজাল্টও পেয়ে গেলাম হাতে নাতে।

১৪ই অক্টোবর নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম।
১৫ই অক্টোবর ওয়ান টুয়েন্টি ফাইভ হারলেম থেকে সাবওয়ে ট্রেনে করে চলে গেলাম ফরটি সেকেন্ড গ্রান্ড সেন্ট্রাল। ওখান থেকে গুগল ম্যাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সেন্ট্রাল পার্ক।

দেখলাম। ঘুরলাম। মুগ্ধ হলাম।
ক্লান্তও হলাম।

সংগে করে নিয়ে আসা বাংলাদেশী টাকা আমেরিকায় অনেক ভাড়ী বলেই মনে হয়। সিংগেল রাইড সাবওয়ে ভাড়া পোনে তিন ডলার! ৩ ডলার দিয়ে একটা ষ্ট্রিট হট ডগ খেয়ে শান্তি পাই না। ১ ডলার দিয়ে ছোট্ট এক বোতল পানি! খুব কষ্ট খেতে।

যাই হোক। ঘরে ফিরতে হবে।
তখনও তো আমি জানি না যে গ্রান্ড সেন্ট্রাল আদতে কতটা ‘গ্রান্ড’!

বিশ্বের অনেক দেশের সাবওয়েতে উঠেছি- সুতরাং এটা আর তারচে বেশী কি হবে?

খুব ভাব নিয়ে (যেন হারিয়ে না যাই- রাস্তা ঘাট সব শক্তভাবে মনে রেখে) গ্রান্ড সেন্ট্রালে ঢুকে ফিরতি ট্রেনে উঠবো- কিন্তু একি? এখানে তো অসংখ্য ট্রেন! আমি কোনটায় উঠবো?

এবার আমি সত্যি সত্যিই হারিয়ে গেলাম।
আমি যে কতটা অসহায়! কতটা বোকা! কতটাই কম বুদ্ধির একজন মানুষ- সেটা আবারও হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। কেউ যেন চোখে আংগুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল!

আন্দাজের উপর ভর করে একটা ট্রেনে উঠে পড়লাম। সব ট্রেন তো দেখতে প্রায় একই রকম!

সাহস করে একটা ট্রেনে দিয়ে উঠে বসলাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বুঝে ফেললাম, ভুল পথে যাচ্ছি। ট্রেন তো মাটির নীচ দিয়েই চলার কথা, এটা আকাশে উঠে গেল কিভাবে?

তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম পরের ষ্টেশনেই।

কিন্তু এবার? কোথায় যাবো?

জানার মধ্যে কেবল বাসার ঠিকানাটাই মুখস্থ।

একটা গ্রীন ট্যাক্সি দেখলাম, হাত তুললাম। থামলো আমার সামনে। উঠেও বসলাম। ঠিকানাও বললাম ঠিক কোথায় যাবো- তার।

মুখ খুললো ড্রাইভার নিজেই, একটু পর- ‘কোন দেশ থেকে এসেছেন স্যার?’

বাংলাদেশ বলাতে সে এবার পরিস্কার বাংলায় বলল, ‘এভাবে ট্যাক্সি নিয়ে নিউ ইয়র্কে চললে তো সব টাকা শেষ হয়ে যাবে ভাইজান। সাবওয়ে ম্যাপটা ভালো করে দেখে নিয়ে ট্রেন-বাসের রাস্তাটা বুঝে নিবেন। মোবাইলে সাবওয়ে ম্যাপটা ডাউনলোড করে নিবেন।’

মনে মনে এবং জোরেও বললাম ‘জ্বি। নিতেই হবে।’

ভুলের আর অতি পান্ডিত্বের খেসারত স্বরূপ ড্রাইভারকে ৬০ ডলার ভাড়া দিতে যে কষ্টটা পেয়েছিলাম সেদিন- আজও বুকের বাম পাশটায় ব্যাথা করে মনে হলেই।

 

 

 

   Send article as PDF