চেতনা

আমরা সকলে মাহথির মোহাম্মদকে চিনি।
আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক তিনি।
 
আজ যে মালয়েশিয়াতে আকাশচুম্বি অট্ট্রালিকা, বিশাল বিশাল অত্যাধুনিক হাইওয়ে, লাখো ইন্ডাষ্ট্রিজ, মেট্রোরেল নিয়ে সাজানো গোছানো একটা দেশ মালয়েশিয়া তার সবটুকু কৃতত্বই ড. মাহথির মোহাম্মদের।
 
একজন মানুষ কতটুকু দূরদর্শী হলে সম্পূর্ণ জংগলে ঢাকা বাঘের গর্জন শোনা এক বিস্তৃর্ণ ভূমিকে আজ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী একটা দেশে পরিণত করতে পারে- সেটা বুঝতে একবার হলেও আপনাকে মালয়েশিয়াতে যেতে হবে। ড. মাহথির মোহাম্মদ কে জানতে হবে।
 
আজ থেকে ৪০ বছর আগেও দেশটি ছিল বাংলাদেশের চেয়েও পেছনে থাকা একটা জংগলাভূমি।
 
মালয়রা একটা সময় জাহাজে পাড়ি দিয়ে চলে যেত তামিল নাড়ু বা শ্রী লংকাতে একটু উন্নত জীবনের আশায়।
 
শুনলে অবাক হবেন, এখন শ্রী লংকাতে হাজার হাজার মালয় বসবাস করে শ্রী লংকান নাগরিকত্ব নিয়ে।
 
নিউ ইয়র্কে আমার বেশ কয়েকজন পরিচিত শ্রী লংকান মালয় ফ্রেন্ড রয়েছে- যারা আমাকে তাদের ঠাকুদাদা দের গল্প করে।
 
কি এমন জাদু ছিল মাহথির মোহাম্মদ এর হাতে?
মালয়েশিয়ানরা এমন একটা জাতি যে শুধুমাত্র নিজস্ব ভাষাই রয়েছে- আলফাভেট পর্যন্ত নেই তাদের। ধার করা ইংরেজী আলফাবেট দিয়ে তারা তাদের লেখা-লেখির কাজ চালায় আমাদের মতোই- একদা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে থাকা মালয়েশিয়া।
 
কিন্তু তারচেও বেশী মজার তথ্যও রয়েছে আমার হাতে।
 
কথিত রয়েছে দারিদ্রের জালা সহ্য করতে না পেরে এই মালয়েশিয়া তার কয়েকটি দ্বীপকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং সেখানকার মানুষ একটি দেশ গঠন করে যার নাম সিংগাপুর।
 
বুঝুন অবস্থা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।
ছোট ছোট কয়েকটা দ্বীপ নিয়ে একটা বিচ্ছিন্ন দেশ নিয়ে সিংগাপুর রাষ্ট্রটি যাত্রা শুরু করে সেই ১৯৬৫ সালে।
 
মানে আমাদের বাংলাদেশ জন্মের মাত্র কয়েক বছর আগে জন্ম দেশটির।
আজ সিংগাপুরের মাথাপিছু আয় ৮৭ হাজার ডলার। যা কি না আমেরিকার চেয়েও বেশী। আর আমাদের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ মাথা পিছু আয় ১৭০০ ডলার! বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে- বাংলাদেশ সিংগাপুর হয়ে যাবে ২০২১ এ!
ডিজিটাল বাংলাদেশ!
 
তিনি লি কুয়ান ইও।
সিংগাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
তিন দশক ক্ষমতায় ছিলেন।
 
সিংগাপুর কে বলা হয়ে থাকে এশিয়ার ইওরোপ।
আজ সিংগাপুর সেই ছোট্টটিই রয়েে গেছে, সামান্য খাবার পানিও তাদের ইমপোর্ট করে আনতে হয়ে মালয়েশিয়া থেকে। নিজস্ব খাবার পানিও নেই তাদের। শতভাগ শহুরে রাষ্ট্র সিংগাপুর।
 
আপনি চিন্তা করতে পারবেন না জন্মের সময় কতটা অসহায় ছিল সিংগাপুর দেশটি।
 
না।
সিংগাপুরের জন্মের কোন ‘চেতনা’ ছিল না।
মালয়েশিয়ার জন্মের সময় কোন ‘চেতনা’ ছিল না।
 
কিন্তু মালয়েশিয়াতে ছিলেন ড. মাহথির মোহাম্মদ।
এবং সিংগাপুরে ছিলেন লি কুয়ান ইও।
 
আর সেই লি কুয়ান ইও এর নেতৃত্ব পেয়েছিল আজকের মহান সিংগাপুর। ছবির মতো ঝকঝকে তকতকে একটা দেশ সিংগাপুর। আমি যতবারই চাংগি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছি, বুকের মধ্যে একটা অসহায় কষ্ট আমাকে চেপে ধরতো।
 
লি কুয়ান ইওকে স্রেফ হিংসা করতাম।
প্রচন্ড হিংসা করতাম এই ভদ্রলোকটিকে।
 
একটা মানুষ কতটা বড় হতে পারে।
একজন মানুষ কতটা আদর্শনীয় হতে পারে।
 
কিভাবে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে স্বগৌরবে দাড়িয়ে থাকতে পারে- ঘোষনা করতে পারে ‘আমি সিংগাপুর’।
 
ধীর, শান্ত একটা দেশ সিংগাপুর।
মাল্টিকালচার লোকজন। চাইনিজ, মালয়, তামিল সকলে মিলে সিংগাপুর।
 
মোস্তাফা’র আশ-পাশ দিয়ে হাঁটতাম, আর তাকিয়ে তাকিয়ে বিস্মায়াভূত হতাম। কি সুন্দর রাস্তাঘাট, অট্টালিকা, কর্মব্যস্ত মানুষ। গাড়ী ছুটছে। কোথাও তাদের ‘চেতনা’ আমি খুঁজে পাইনি।
 
আপনি যদি জীবনে একটি বারও অন্তত মালয়েশিয়া বা সিংগাপুর না দেখে থাকেন- তাহলে কিভাবে নিজেকে ‘আধুনিক মানুষ’ ভাববেন?
 
যাই হোক দু’টি মানুষ দু’টি দেশকে বদলে দিয়েছেন।
স্বশ্রদ্ধ সালাম মিষ্টার মাহথির মোহাম্মদ এন্ড লি কুয়ান ইও।
 
এবার আমাদের বাংলাদেশ।
এখানে দেখতে পাবেন হাজার বছরের চেতনা।
এখানে দেখতে পাবেন হাজার বছরের এতিহ্য।
 
এখানে আরও দেখতে পাবেন ডিজিটাল বাংলাদেশ।
এখানে দেখতে পাবেন কিভাবে সরকার নিজেই জনগণের টাকা দেশের কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে চুরি করে।
এখানে আরও দেখতে পাবেন, দেশের মানুষের টাকায় কেনা ‘বন্দুক আর গুলি’ দেদাচ্ছে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের মানুষের বুকেই।
 
এখানে গণতন্ত্র পাবেন না।
এখানে স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার পাবেন না।
এখানে মত প্রকাশের অধিকার পাবেন না।
 
কিন্তু তারপরও এদেশের মানুষ উদযাপন করবে ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘মাতৃভাষা দিবস’, আর বলবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
 
এই পৃথিবীতে এরচেও হিপোক্রেসী আর কোথাও পাওয়া যাবে কি?
 
সিংগাপুরে প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইও ১৯৭৩ সালে গেলেন কানাডার অটোয়াতে। বৃটিশ কমনওয়েলথ এর সম্মেলনে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও সেই সম্মেলনে যোগ দিতে গেলেন।
 
নবগঠিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭০৭ নিয়ে গেলেন অটোয়াতে জনাব শেখ মুজিবর রহমান।
 
প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইও তার একটি লেখাতে উল্লেখ করেছেন শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে, ‘আমি অটোয়াতে ল্যান্ড করেই দেখেতে পেলাম গায়ে ‘বাংলাদেশ বিমান’ লেখা বোয়িং ৭০৭ প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফট পার্কিং লটে পার্ক করা অবস্থায় রয়েছে এবং ঠিক আটদিন বাদে আমার ফেরার সময়ও দেখলাম সেই ‘বাংলাদেশ বিমান’টি ঠিক সেই একই জায়গাটিতেই ওভাবেই পরে রয়েছে। আটটি দিন এতবড় একটা বিমান কোন আয়-রোজগার করছে না। ফেরার দিন আমার চোখ এড়ায়নি যে দু’টি ভ্যানে করে শপিং করা মালামাল সেই বিমানে লোড হচ্ছে।
 
প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইও তার অবজারভেশনের শেষটায় বলেছিলেন “the poorer the country, the bigger the Cadillac’s they hired for their leaders”.
 
এই সেই লি কুয়ান ইও যার হাতে গড়া চাংগি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটি আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা এয়ারপোর্টের একটা। ফাইভ স্টার এয়ারলাইন্স হিসাবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে ‘সিংগাপুর এয়ালাইন্স’। চাংগিতে ল্যান্ড করলে আপনি বুঝতে পারবেন- এটা অন্য পৃথিবী।
 
প্রায় একই সংগে যাত্রা শুরু করে আজ সিংগাপুরিয়ানদের বার্ষিক অায় ৮৭ হাজার মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশীরা আয় করছে ‘শুধুই চেতনা’।
 
শেখ হাসিনা গোপালী নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রধান হিসাবে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলে রেখেছে আজ ৪ বছর।
 
আর এই চার বছরে হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করেছে তার পোষা গোপালী পুলিশ আর রাব।
 
দেশের মানুষকে হাত-পা বেঁধে তার শরীরে ঠান্ডা মাথায় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করা হচ্ছে। একজন মানুষ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে- সামান্য হাত-পা ছেড়ে একটু শান্তিতেও মরতে পারছে না।
 
মরতে দিচ্ছে না শেখ হাসিনা।
দেশের মানুষের উপর শেখ হাসিনার এ এক নির্মম প্রতিশোধ।
 
যখন যাকে মন চাচ্ছে নিরীহ মানুষদের ক্রস ফায়ারে দেয়া হচ্ছে।
যখন যাকে মন চাচ্ছে এই নিরীহ মানুষদের গুম করে ফেলা হচ্ছে।
 
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে দেশের শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদদের।
 
বাংলাদেশ আজ কোন পথে হাঁটছে?
 
শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়া হতো।
আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতভুক্ত হবার দাঁড়প্রান্তে।
 
মনে পরে স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিম এর প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জিকে ভারতে তার শেষ সরকারী সফরে ‘রাষ্ট্রপতি ভবন’এ আমন্ত্রিত ‘সৌভাগ্যবান অতিথি’র মর্যাদা দেয়া হয়ে ছিল।
 
সামনের সপ্তাহে গোপালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ‘সৌভাগ্যবান অতিথি’ হিসাবে থাকার জন্য।
 
ভারত শেখ হাসিনাকে দাসত্বের বাধ্যবাধকতায় চাপিয়ে দিচ্ছে ‘সামরিক চুক্তি’।
 
আমরা কেন ভারতে সংগে সামরিক চুক্তি করতে যাবো?
সামরিক চুক্তি যদি করতেই হয়ে- আমরা সেটা করতে পারি বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র আমেরিকা বা চায়নার সংগে। ভারতের সঙগে কেন?
 
বেগম খালেদা জিয়ার সামনে আমেরিকার সংগে সামরিক চুক্তি করার বড় একটা সুযোগ এসেছিল। কিন্তু তিনি তখন তা করেননি। আর দেশের চেতনাবাজরা তখনও আমেরিকার সংগে সামরিক চুক্তির বিরোধীতা করেছিল তখন। আজ যদি বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি খাকতো আমেরিকার সংগে- তাহলে ভারত বাংলাদেশকে ‘সামরিক চুক্তি’ অফার করার আগে শতবার ভেবে নিত।
 
আজ আমেরিকার সংগে এই পৃথিবীর ৬৩টা দেশের সামরিক চুক্তি রয়েছে। আমেরিকা কিন্তু ওসব দেশের জন্য কোন হুমকী নয়- বরং আমেরিকার উপস্থিতিতে অন্য আগ্রাসী দেশগুলিকে সামনে দাড়েয়ে কথা বলাও সুযোগ দেয় না।
 
দূরদর্শি নেতৃত্ব থাকলে- বাংলাদেশও সেদিন আমেরিকার সংগে সামরিক চুক্তি করে লাভবান হতে পারতো।
 
জাপান, কোরিয়া, সিংগাপুর পর্যন্ত আমেরিকার সামরিক অংশিদার। জাপান, দক্ষিন কোরীয়া বা সিংগাপুরের চোখে চোখ রেখে আজ কথা বলবে- এমন শক্তি বিশ্বে নেই।
 
বেগম খালেদা জিয়া যদি কথিত আন্তর্জাতিক আদালতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতেন; আন্দোলন করতেন, বিশ্ব মতামতকে যুক্তি, বাস্তবতা এবং দায়িত্ব নিয়ে বোঝাতে পারতেন যে ‘কথিত আন্তর্জাতিক আদালত’ শুধুই বিরোধী মতকে ফাঁসানোর জন্য করা হয়েছে- তাহলে শেখ হাসিনা এতটা স্বেচ্ছাচারী হবার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না আজ।
 
বাংলাদেশ তাদের ‘চেতনা’ আর ‘হাজার বছরের ঐতিহ্য’ নিয়ে কতদূর হাঁটবে?
 
এখনতো আর হাঁটতেও পারছে না- খুড়াচ্ছে!
 
আর নয় কারো উপর ভরশা করে থাকা।
আর নয় উত্তরাধিকারের অযোগ্য, অদূরদর্শী নেতৃত্ব।
 
যোগ্যতার লড়াই নামতে হবে দেশের মানুষকে।
নইলে মুক্তি নেই।
 
   Send article as PDF