তাজা মাছ-সবজী!

আমার একটা ভাল লাগার বিষয় শেয়ার করি।
 
আমি প্রচুর ভ্রমণ করতাম।
বিশেষ করে বাংলাদেশটার এমাথা থেকে ওমাথা পুরোটাই অনেক অনেক বার ঘুরে ফিরেছি।
 
মাঝে মধ্যে আমি এমন এমন সব জায়গায় যেতাম- যেখানে কেউ কোনদিনও বিনা কাজে ভ্রমণে যাবে না। যেমন কুড়িগ্রাম এর চিলমারী উপজেলা। কেউ যাবেন ওখানে- শ্রেফ ভ্রমণ করতে? অথবা সাতক্ষীরা’র শ্যামনগর; বা অারও ভেতরে মুন্সিগঞ্জ যেখান থেকে ছোট নদী পার হলেই সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল। মাঝে মধ্যে নাকি ‘তিনি’ নদী পার হয়ে এপাড়েও চলে আসেন!
 
তো, এরকমই একবার গেলাম সেই জামালপুর এর বকসীগঞ্জ উপজেলার কর্ণঝড়া। ইন্ডিয়ান বর্ডার এর সংগে। ছোট পাহাড়ী জঙ্গল। নয়নাভিরাম। সরকারী উদ্যোগে একটা রেষ্ট হাউজ বোধ হয় আছে। ঘুরলাম। দেখলাম। ছবি তুললাম। প্রচন্ড আনন্দ পেলাম।
 
ওখান থেকে ফেরার পথে একেবারেই অঝো পাড়া গাঁয়ে দেখলাম একটা খুবই ছোট, শান্ত, টং রেষ্টুরেন্ট। কাষ্টমার নেই। আমি ঢুকলাম। জানতে চাইলাম কি কি আছে খাবার। জীর্ণ শরীরের রেষ্টুরেন্ট মালিক বলল, ‘স্যার আপনি তো এসব খাবেন না, গরীবের খাবার’।
 
আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘আমি তো গরীব-ই; এবং অবশ্যই খাবো’।
 
ছোট ছোট ট্যাংরা মাছ ডাটা-বেগুন-মুলা দিয়ে রান্না করেছিল। আমাকে খুব যত্ন করে, একটু বেশী পরিচ্ছন্নতায় সে খাবার পরিবেশন করলো। পাতলা ডালও ছিল।
মাছগুলি একেবারেই তাজা। সবজীগুলিও মনে হচ্ছিল মাত্রই বাগান থেকে তুলে এনে রান্না করা।
 
অপূর্ব তৃপ্তি নিয়ে সেদিনের সেই খাওয়া। এখনও মনে পরলে- ক্ষুধা লেগে উঠে!
 
একদিন খেয়েছিলাম ময়মনসিংহ যাবার পথে ত্রিশাল পার হয়ে কি একটা ছোট বাজারের পাশে। গাড়ী থামিয়ে টং রেষ্টুরেন্টটিতে ঢুকলাম। কি একটা শুটকী ভর্তা যেন ছিল- ওয়াও, অসাধারণ সেই দিনের খাবার, টাটকা কাচকী মাছ ছিল; পেট পুরে খেয়েছিলাম। শীতের দিনের সবজী, সত্যি, ভুলা যায় না।
 
চাঁদপাড়া’য় একটা কাজ ছিল।
চাঁদপাড়া হলো- বেনাপোল বর্ডার পার হয়ে বনগাঁ থেকে শিয়ালদাহ’র উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের ঠিক পরের ষ্টেশন। আমি করলাম কি রিক্সা নিলাম হরিদাশপুর থেকে- চাঁদপাড়া।
 
চাঁদপাড়া পৌছে যাবার মুহুর্তেই গ্রামের শেষ মাথায় একটা ভাংগাচরা রেষ্টুরেন্ট। অনেকেই খাচ্ছে। আমারও লোভ হলো। রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। প্রত্যেকটা মাছই ছিল এক্কেবারেই তাজা, সংগে সবজীগুলিও! খেয়ে নিলাম। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাঙালী বাবুদের রান্না করা খাবার সম্ভবত পৃথিবীর সেরা বাঙালী খাবার। এরা তরকারীতে ঝোল একটু বেশী খায়। ঝোলটাও মজা।
 
আরেকবার ব্যাংককে। চায়না টাউনের একটা হোটেলে উঠছি। প্রায় ঘন্টা খানেক খুঁজে পেলাম একটা বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট। রাত তখন সাড়ে নয়টা। রেষ্টুরেন্ট মালিক কিছুতেই দোকান খুলবে না। আমিও নাছোরবান্দা। জোর করে গেট খুলালাম। বলল খাবার নেই।
 
আমি বললাম, ‘কিছুই নেই তলানীতে? দেখেন না রে ভাই- খুব ক্ষুধা লেগেছে তো; বেইজিং থেকে এসেছি। ৬ দিন যাবৎ ভাত খাই না।’
 
বেচারার মনে হয় মায়া হলো। বললেন, ‘শুধু সামান্য একটু গুলশা মাছের ঝোল আছে একপিস মাছ আমার জন্য। রাতে খাবো- তাই। আপনাকে দিলে আমি কি খাবো?’
 
আমি বললাম, চলেন দুইটা ডিম ভাজি করি। দু’জন মিলে-মিশে খেয়েনি।
ভদ্রলোক অবশেষে রাজী হলেন। ডিম ভাজলেন। ওনি জোর করে মাছটা আমাকেই দিলেন- অর্ধেকটাও নিলেন না। চায়না টাউনে না কি তাজা গুলশা মাছও পাওয়া যায়। শুধু মুলা দিয়ে যে গুলশা মাছ এতটা মজা করে রান্না করা যায়- আমি সেটা সত্যিই জানতাম না। এখনও মুখে সেদিনের সেই স্বাদটা লেগে রয়েছে।
 
এতক্ষনে বুঝেই ফেলেছেন যে ‘তাজা’ মাছ আর সবজীর কতটা পাগল আমি।
ঢাকায় যখন থাকতাম, মাঝে মধ্যে চলে যেতাম মিরপুরের দিয়েবাড়ী দিয়ে পেছনের উত্তরা-গামী রাস্তায়। বিকেলে ওখানে তাজা মাছ বিক্রি হতো।
 
চায়নিজরা তাজা মাছ খায়।
কোন এক সকালে কুনমিংএ মর্নিং ওয়াক এর বের হয়েছি। ওরা খুব মজা করে ব্যায়াম করে। একদল মানুষ হাই ভলিউমে স্পীকার বাজিয়ে তালে তালে ঘন্টা খানেক ধরে ব্যায়াম করে। আমিও শরীক হলাম একদিন ওদের সংগে। বেশ উপভোগ্য।
 
ব্যায়াম শেষে হাঁটতে হাঁটাতে সামনে দেখলাম কাঁচা বাজার।
ভেতরে ঢুকলাম। একদম বাংলাদেশের কাঁচা বাজারের মতোই; ভেতরে- যেখানে মাছ বিক্রি হয়।
 
কোন মৃত মাছ নেই- সবই পানিতে ঝিইয়ে রাখা তাজা মাছ। আয়ের, মাগুর, বোয়াল, তেলাপিয়া, চিংড়ী সবই দেখলাম। সংগে কাকড়া, ফটকাসহ, নাম না জানা আরও কিছু মাছ।
 
আরেকবার কুনমিং এ যাত্রা বিরতী। দুপুরে ঢাকার ফিরতী ফ্লাইট। তখন কুনমিং এ নতুন এয়ারপোর্টটি চালু হয়ে গেছে। গ্রামের ভেতরে অামার হোটেলটি। সকালে হাঁটতে বের হলাম। অনেকটা দূরে একটা বাজার দেখতে পেলাম।
 
ভেতরে ঢুকলাম।
কুনমিং চির শীতের শহর। তাজা তাজা ফুল কপি, শিম, ধইনা পাতা। আরও কত কি। এবং সেই তাজা মাছ। হঠাৎ মাথায় একটা পোকা ঢুকে বসলো। দুই ব্যাগ ভর্তি করে কাঁচা সবজি কিনে ফেললাম। মাছ কিনলাম না, গন্ধ হয়ে যাবে- তাছাড়া বহন করাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
 
আমার লাগেজটা বড়ই ছিল। সেটার ভেতরে অনেক কষ্টে তাজা সবজীগুলি ঢুকালাম। আর ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগের মতো করে তাতেও কিছু।
 
চাইনিজ কাষ্টমস এর মেয়েরা স্ক্যানিং করতে গিয়ে দেখি মুচকী হাসছে- আমি ওদের সংগে তাল হেসে দিলাম, ‘বললাম তোমরা তো দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে না- তাই কিনে নিয়ে গেলাম; আর কি করবো বলো?’
 
ঢাকা এয়ারপোর্ট।
ওরা কোনদিনও আমার লাগেজ চেক করে না। ওদিন ভারী দেখে একজন অফিসার প্রশ্ন করলো- ‘ভেতরে কি’?
আমি জবাব দিলাম, ‘কাঁচা বাজার। ফুলকপি, বাধা কপি, শিম, টমেটো ছোটগুলি; স্ক্যানিং এ দেবো?’
 
বেচারা কি বুঝলো কে জানে? দেখি কোন উত্তর না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রয়েছে! আমি আমার ট্রলি নিয়ে বের হয়ে আসলাম।
 
আমাকে কেউ আটকায় না।
 
আমি তাজা মাছ এবং সবজীর জন্য পাগল।
দুই বেলা যদি তাজা মাছ আর টাটকা সবজী পাই- তাহলে আমার আর কোন চাওয়া নেই।
 
সেই আমি এখন নিউ ইয়র্কে।
বাংলাদেশ থেকে শীপে করে ফ্রজেন কনটেইনার ভরে ভরে মাছ আসতে মাস দুয়েক লাগে। তার পর সেই বরফ থেকে মাছ বের করে রান্না করতে হয়। সেগুলি আর ততদিনে মাছ থাকে না।
 
ভাগ্যিস, করাচী থেকে কিছু দেশী মাছ ১৬ ঘন্টার ডাইরেক্ট ফ্লাইটে জেএফকে চলে আসে। সেখান থেকে সরাসরি জ্যাকসন হাইটস-এ। প্রতি শুক্রবার। কেটে পেট ফেলে দেয়া আয়ের, বোয়াল, লক্ষা ইত্যাদি। গত পরশু বড় সাইজের মাগুর মাছও ছিল- কিনলাম ৩টা। বেশ ভালই লাগলো খেতে।
 
চাইনিজ কিছু লাইভ ফিস দোকান রয়েছে। হিলসাইডে সম্প্রতি একটা বাংলাদেশী লাইভ ফিস এর দোকানও চালু হয়েছে। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে তাজা ‘তেলাপিয়া’ আর ‘ক্যাট ফিস’ (মাগুর বা রিটা অথবা আয়ের গোত্রের) অথবা তাজা চিংড়ী মাছ নিয়ে আসি। ক্যাটফিসটা বেশ সুস্বাধু। আর বাদবাকী যে তাজা মাছগুলি দেখি- তাতে চেহারা দেখে মনে হয় না যে খেতে ভালো হবে।
 
একদিন আমেরিকান জনপ্রিয় মাছ ‘সলমন’ নিয়েছিলাম- পুরাই ফালতু একটা মাছ! ভাল যেন লাগে সেজন্য ‘ফার্ম রাইজ’ টা না নিয়ে বেশী দাম দিয়ে ‘ওয়াল্ড’ মাছটা নিয়েছিলাম- তাতে কি? কোন মজাই নেই। এদেশের চিংড়ী মাছও খেতে কোন মজা নেই।
 
নিউ ইয়র্কে ৮ মাস শীত। সারাবছরই শীতের সবজী পাওয়া যায়। ফরমালিন ছাড়া। কিন্তু কোন স্বাদ নেই। ধইনা পাতায় নেই কোন গন্ধ।
 
বোঝা-ই যায় যে ‘মাটি এবং পরিবেশে’র বাইরে গেলে- আসল স্বাদটি আর মেলে না।
 
নিউ ইয়র্কে যে লেবুটা পাওয়া যায়- তাতে প্রচুর ‘টক-জল’ থাকে- কিন্তু সেটাকে আমার লেবু মনে হয়না কোনদিনও।
আমার দেশের কাগজী লেবু! ওহ!! সে কি স্বাদ!!!
 
অনেকেই আমাকে আমেরিকায় ফ্লাই করার আগে প্রশ্ন করে, ‘আপনার জন্য বিশেষ কিছু আনতে হবে? লাগলে বলেন- কি আনবো?’
 
আমি বলতে চাই, চার’টা ডিম পাড়া তেলওয়ালা দেশী মুরগী, তাজা ‘বাইল্যার ঘুগরী’ (ছোট মাছ), আর দু’হালি তাজা দেখে কাগজী লেবু- সংগে ৫০ টাকার ধইন্যা পাতা।
আর পারলে কিছু তাজা ট্যাংরা মাছ।
 
পারবেন কেউ আনতে?
   Send article as PDF