হংকং এ ইফতার

হাতে আজ কোন কাজ ছিল না।
প্রায় ১২টা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি।
 
রোজার মাস, খাবার তাড়া নেই। সেহারী খাওয়া হয়েছে ড্রাগন এয়ারের ফ্লাইটে।
 
উঠলাম, একটু ওড়ামুরি দিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। গোসল করার পর আরও ফ্রেস লাগছিল।
 
রাস্তাঘাট তেমন একটা চিনি না কিন্তু হাঁটতে অসাধারণ লাগছিল। ঝকঝকে তকতকে ফুটপাত। সকলেই হাঁটছে। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট বক্তৃতা দেবার স্ট্যান্ডের মতো করে স্ট্যান্ড বসানো, সেখানটায় লোকল ম্যাপ দেয়া আর ঠিক মাঝ খানটায় লেখা ‘ইও আর হেয়ার’।
 
অর্থাৎ আপনার হারিয়ে যাবার কোন চান্সই নেই- অতি আধুনিক এই শহরটিতে।
 
আমি বলছিলাম হংকং এর কথা।
আমি চুংকিং ম্যানশন এর হোটেলটিতে উঠেছি এই এলাকাটার নাম সিমসাসই (Tsim Sa Tsoi), সংক্ষেপে টিএসটি। নীচে বিশাল সাবওয়ে ষ্টেশন।
 
আমি হাঁটছি ফুটপাত দিয়ে। দেখছি। অবাক হচ্ছি।
সব কিছুই অত্যন্ত গোছানো।
 
হংকং এর জনঘনত্ব ঢাকার জনঘনত্বের মতোই।
গিজগিজে মানুষে ঠাসা একটা শহর। অথচ কতটা সুশৃঙ্খল। কতটা পরিচ্ছন্ন।
 
বৃটিশরা এদের মাত্র ৯৯ বছরে ‘মানুষ’ বানিয়ে দিয়ে গেছে।
বৃটিশরা ২০০ বছরেও ভারতবর্ষকে ‘মানুষ’ বানিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি।
 
হংকং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
হংকং মুলত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবেই পরিচালিত হয়।
 
বৃটিশরা চলে যাবার পর হংকং এর মুল মালিক এখন চায়না।
চায়নিজ গভর্ণমেন্ট হংকং এর নাম দিয়েছে ‘হংকং সার’ বা হংকং স্পেশাল এডমিনিসট্রেটিভ রিজিয়ন।
 
চায়নার বিখ্যাত ‘এক দেশ দুই নীতি’র অধিনে হংকং পরিচালিত হয়।
চায়নায় এক দলীয় শাসন চলছে- সিপিসি বা ‘কমিউনিষ্ট পার্টি অব চায়না’ মেইনল্যান্ড চায়নার একমাত্র রাজনৈতিক দল। বিরোধী জনমত চায়না সহ্য করে না।
 
তবে, চায়নার চমৎকারিত্ব হচ্ছে- সিপিসি’তে রয়েছে অনন্যসাধারণ ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ’। যোগ্যতা দিয়ে সিপিসির নেতা নির্বাচিত হতে হয়। উত্তরাধিকারিত্ব বা পারিবারিক প্রথা চলে না সেখানেও।
 
যা বলছিলাম।
হংকং এর মালিকানা একদলীয় চায়নার হাতে থাকলেও চায়না হংকং এ `হাত’ দেয় না।
 
হংকং এর পূর্ণ বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। হংকং এর বার্ষিক মাথাপিছু আয় আমেরিকার প্রায় সমান ৫৬,০০০ ডলার।
 
দেশটি অত্যন্ত উন্নত। চমৎকার আবহাওয়া। মানুষগুলিও অসাধারণ।
হংকং এর মেয়েদের দিকে তাকালে বুঝে উঠা খুবই কষ্টকর যে মেয়েটার বয়স ১২ না ৭২!
 
মেইনল্যান্ড চায়নাতে রাস্তায় গাড়ী চলে ডান দিক দিয়ে আর হংকং এ বা দিক দিয়ে। চায়নার কারেন্সি রিনমিমবি (ইউয়ান) বা আরএমবি আর হংকং এর কারেন্সি ‘হংকং ডলার’।
 
হংকং এর আরও একটি অত্যন্ত মজার দিক হলো সেদেশের কারেন্সী বা টাকা বেসরকারী ব্যাংকগুলি মুদ্রন করে, অর্থাৎ হংকং এ বিভিন্ন ব্যাংকের নামে টাকা মুদ্রিত হয়। সেখানে এইচএসবিসি ডলার রয়েছে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকেরও ডলার রয়েছে। আরও অনেক ব্যাংকেরও কারেন্সি দেখা যায়।
 
হংকং এর পুলিশের ব্যবহার অত্যন্ত চমৎকার। তাদের পোষক, পরিপাটি ব্যক্তিত্ব যে-কাউকে ভয় ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ঠ।
 
হংকং ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র। এর রাজধানী হংকং। আমি যে শহরটিতে রয়েছি সেটা কাউলুন।
 
আমার মাত্র ১ দিনের কাজ নিয়ে এসেছি। কাল থাকবো, পরশু রাতের ফ্লাইটে ঢাকা ব্যাক করবো।
 
কাউলুন চুংকিং ম্যানশন এর পাশেই শেরাটন হোটেল। আমি হাঁটতে হাঁটতে বেশকিছু শপিং মল দেখে স্টার ফেরী ঘাটে চলে আসলাম। সেখান থেকে টিকেট কেটে ফেরীতে করে চলে গেলাম হংকং।
 
‘নাই কাজ তো খই ভাজ’।
হংকং এ কিছুক্ষন হাঁটাহাটি করে আবার ফেরীতে করে কাউলুন চলে আসলাম। ঘড়িতে তখন বিকেল প্রায় ৫টা।
 
তখনই মনে হলো, ইফতার করবো কোথায়?
ভাবছিলাম কি করা যায়।
 
চুংকিং ম্যানশন কে সেন্টার করে চারদিকে দেখছিলাম হালাল রেষ্টুরেন্ট বা হালাল কোন ফুড পাওয়া যায় কি না। চাইজিন আমি বুঝি না চাইনিজ খাবারের ব্যাপারে তখনও আমার বলতে গেলে কিছুই বোঝা হয়ে উঠেনি।
 
মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না, কি করা যায়!
 
হোটেলে আমার রুমে ফিরে গেলাম।
পাশের রুমে একজন ইন্ডিয়ান মুসলিম এর সংগে পরিচয় হলো। পরিচয়ের এক পর্যায়ে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি ‘ফেসটিং’ করছি কি না?
 
হ্যা বলাতে বললেন, ‘ইফতার কোথায় করবেন?’
আমি বললাম আমার দুরাবস্থার কথা। সে আমাকে সহজ রাস্তা বাতিয়ে দিল। ‘কাউলুন জামে মসজিদে চলে যান- সেখানে ভালো ইফতারের ব্যবস্থা রয়েছে।’ মসজিদটিও যাষ্ট চুংকিং ম্যানশন এর কাউলুন পুলিশ ষ্টেশনের মাঝামাঝি। হেঁটে যেতে মিনিট পাঁচেক লাগবে।
 
সত্যি বলতে- কি করবো ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।
হঠাৎই মনে হলো যাই। দেখিই না কি হয়। মাগরিবের নামাজটাও পরে আসা হবে।
 
কাউলুন মসজিদটি যথেষ্ঠ বড়। সিড়িতে হাজার হাজার দামী দামী জুতা রেখে সকলে ভেতরে ঢুকছে। সম্ভবত জুতা চোর নেই হংকং এ।
 
আমি সবসময়ই একটু দামী জুতা ব্যবহার করি- জুতার জন্য মায়া লাগছিল, চুরির ভয়ে না, হারিয়ে যাবার ভয়!
 
নীচ তলায় ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল হলরুম। খুবই সুন্দর আর পরিপাটি করে টেবিল আর চেয়ার সাজানো। মনে হলো কোন পার্টি হবে। দামী অতিথীদের জন্য প্রস্তুত হল রুম।
 
ভাবলাম, আমার সম্ভবত এখানে বসাটা ঠিক হবে না। আমি তো আর অতিথি নই।
 
ভাবছিলাম কি করবো, একা একা একটু বোকা বোকাও লাগছিল। ঠিক তখনই কেউ একজন আমাকে সুন্দর ইংরেজীতে অনুরোধ করলো বসে পরতে।
 
অগ্যতা বসলাম।
চাইনিজ ও ইংলিশে বয়ান হচ্ছে।
 
আস্তে আস্তে হলরুমটি ভরে গেল।
ইফতারের তখনও প্রায় অাধা ঘন্টা বাকী।
 
ট্রে তে করে অনেক রকমের প্যাকেট চলে আসলে প্রত্যেকের কাছে। আমার সামনেও আসলো। বড় গ্লাসে প্যাকেটজাত শরবত, ঠান্ডা পানি, সুপ, সংগে বড় একটা প্যাকেট।
 
একটু পরই আজান হবে। প্যাকেটটি খুললাম। ভেতরে ৭/৮ রকমের ইফতার সাজানো। খেজুর, বিভিন্ন ফলসহ আরো অনেক কিছু। সবই দাবী রেষ্টুরেন্টের খাবার।
 
কিছুটা অবাকই হলাম। এতটা দামী খাবার কে দিচ্ছে?
আমার হিসাবে বাংলাদেশী টাকায়ও সেই খাবারের মুল্য মিনিমাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা হবে। আর মানুষ হবে ন্যূণতম দুই হাজার। আমি আপনাদের ২০০২ সালের গল্প করছি। আজ থেকে ১৫ বছর আগের গল্প।
 
আজান হলো।
ইফতার করলাম সময় নিয়ে।
ইফতার শেষে দোতালায় চলে গেলাম। জামায়াতে নামাজ আদায় করলাম।
 
বেশ কয়েকজনের সংগে (ইন্ডিয়ান/ পাকিস্তানী) কথা হলো।
হ্যাঁ হংকং গর্ভর্ণমেন্ট প্রতিদিনই মসজিদে ইফতার পরিবেশন করে আগত রোজাদারদের জন্য।
 
আর, আমরা তো এই পবিত্র মাসে হংকং গভর্ণমেন্টের বিশেষ অতিথি।
তাই আমাদের জন্যই এই বিশাল আয়োজন।
 
হংকং এর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আরও কয়েকগুন।
 
অমুসলিমদের কাছে মুসলিম আচরণ শিক্ষাটা কতটা যে লজ্জাজনক সেটা টের পেলাম।
 
সভ্যতা দুনিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে- জানি না শুধু বাংলাদেশে নেই কেন?
 
আমরা তো ব্যস্ত থাকি সুপ্রিম কোর্টে থেমিস মুর্তি বসানো নিয়ে। মুসলিমদের ধরে ধরে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।
 
তারপরও নাকি বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র!
   Send article as PDF