মাস্তানী

মাস্তানী এক
 
সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলো প্রজাতন্ত্রের চাকর।
আর প্রজাতন্ত্রের ‘মালিক’ হলো সাধারণ জনগণ।
 
কিন্তু বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ‘মালিক’ এর সংগে কোনদিনও সভ্য আচরণ করে না, করতে দেখিনি।
 
প্রজাতন্ত্রের ‘নিরাপত্তা রক্ষী’ পুলিশ- মানুষের সংগে কি আচরণ করে- সেটা আমি আর নতুন করে কি বলবো? জাতীয় সংসদের হুইপ-কে জয়নুল আবেদিন ফারুক-কেই যেভাবে পিটাইলো, সাধারণ মানুষ তো মানুষই না ওদের কাছে!
 
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ সকল শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয় পায়, ভয়ে হলেও সমীহ করে চলে।
 
এটা বাংলাদেশীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
 
এক সন্ধ্যায় কুয়ালা লামপুর যাবো।
আমার পকেটে ডলার-রিংগিট মিলিয়ে ক্যাশ সাত হাজার ডলার।
 
আমি ‘আইন’ সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখি এবং আমার নিজের অধিকারের বিষয়েও সচেতন সব সময়ই। তাছাড়া বাংলাদেশে সবকিছুতেই নিজের অধিকার নিজেকে আদায় করে নিতে হয়। এটা আমার দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় অর্জন।
 
এদেশে ভদ্রলোকের কোন মূল্য নেই। যার যত মেজাজ সে তত বড়। তবে, বড় মেজাজের সংগে যদি কিছু আইনী প্রভাব ও যুক্তি ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে ‘রাজা’ হতে সময় লাগে না।
 
ইমিগ্রেশন আর কাষ্টমস কর্মকর্তারা আমাকে সাধারণত কখনওই ঘাটায় না। জীবনে একবারই ঘাটিয়ে ছিল সেই প্রথম হংকং যাবার সময়; সেই গল্পতো আপনাদের বলেছিই। তারপর আর কোনদিনই পৃথিবীর কোন এয়ারপোর্টেই আমি হেনস্তার স্বীকার হইনি আজ অবধি।
 
ইমিগ্রেশন শেষ করে অন-বোর্ড করবো।
ফাইনাল সিকিউরিটি চেক হচ্ছে। সিকিউরিটি চেকে কাষ্টম কর্মকর্তা থাকে আমি জানি। তবে তাদের দৃশ্যমান কোন বাড়াবাড়ি আমার চোখে কোনদিন পরেনি।
 
ওদিন লক্ষ্য করলাম একজন কাষ্টম কর্মকর্তা প্রত্যেক যাত্রীর সংগেই একটু বেশী বাড়াবাড়িমূলক আচরণ করে যাচ্ছে, অনেককে ধমক ধামক দিচ্ছে; কারো কাছ থেকে প্রকাশ্যে উৎকোচও গ্রহণ করছে। আমি বিষয়টা তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে থাকলাম এবং আমার মেজাজটা চরমে উঠলো।
 
আমি সবসময় লাইনের শেষে দাড়াই।
এবং, অতপর, আমার নিজের পালা আসলো।
আমি সাধারণতঃ সবসময়ই খালি হাতে ট্রাভেল করি। ছোট একটা মাত্র লাগেজ সেটাও বোর্ডিং এর সময়ই বুকিং দিয়ে দিই।
 
আমি আমার সেলফোন, ম্যানিব্যাগ, হাতঘড়ি বের করে একটা ট্রে’তে করে স্ক্যানিং এর দিয়ে নিজে ‘আর্চওয়ে ডিটেক্টর’ পার হয়ে ট্রে থেকে আমার পার্টস নিতে গেলাম।
 
সেই কাষ্টমস কর্মকর্তা আমার মানিব্যাগটি হাতে নিল এবং মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলি বের করে আমাকে বলল, ‘কত টাকা আছে?’।
 
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। কিন্তু আমি মেজাজ যতই গরম হোক- খুব ঠান্ডা রাখতে পারি- এটা একটা চমৎকার কৌশল।
 
আমি খুব ঠান্ডা গলায় অতি নরম স্বরে বললাম, ‘টাকাগুলি যখন ম্যানিব্যাগ থেকে আমার অনুমতি ছাড়া বের করেই ফেলেছেন- তাহলে নিজেই গুনে দেখেন না- কত আছে? আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন কেন?’
 
অফিসার আমার কথায় হকচকিয়ে গেলেও তা বুঝতে দিল না। সে তার চটুল গাম্ভীর্জ বজায় রেখেই বলল, ‘আপনি বলেন’।
আমি এবার একটু শক্ত হয়ে জবাব দিলাম, ‘না। আমি তো বলবো না। আপনি আমার অনুমতি ছাড়া আমার টাকায় হাত দিলেন কেন? সাহসটা কি একটু বেশী দেখিয়ে ফেললেন না?’
এবার সেও আমাকে আরেকটু চড়া গলায় বলল, ‘আপনাকে বলতে হবে কত টাকা আছে, আমার অনুমতি ছাড়া আপনি এত টাকা নিয়ে যেতে পারবেন না?’
আমি জবাব দিলাম, ‘আপনি যতটুকু আইন জানেন; আমার তো সবটুকু জানার প্রয়োজন নেই- যেহেতু আমি আপনার মতো চাকুরী করি না; তবে আমার নিজের অধিকারের আইনটুকু আমি কিন্তু বেশ ভালই জানি। ইউ হ্যাব টু এনস্যার মি, হোয়ায় ইও টাস মাই মানি উইথআউট মাই পার্মিশন? হু গেইভ ইও সাচ রাইটস্? আর আপনি আমাকে আটকানোর ক্ষমতা রাখেন না; চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি- ক্ষমতা থাকলে আমাকে আটকান’ কথাগুলি আমি অনেকটা চিৎকার করেই ধমকের স্বরে উচ্চারণ করেছিলাম।
 
এই অফিসার মনে হয় কোনদিন কোন সাধারণ যাত্রীর কাছ থেকে এরকম আচরণ দেখেনি। তাই একটু ভরকে গেলেও, নিজের অহমিকা বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
 
এবার সে তার স্বর অন্য দিকে ঘুড়িয়ে নতুন প্রশ্ন করলো, ‘আপনি অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করান নি কেন? আপনার তো পাসপোর্ট ভরাই ভিসা- এতবার বিদেশে যান কেন?’
 
‘আমার ইচ্ছে হয়নি, আমি করিনি। আপনার দরকার হলো- আপনি নিজে গিয়ে করিয়ে নিয়ে আসেন। আমি কতবার বিদেশে যাই বা কি করি সেই জবাব অাপনি নেবার কে? কি ভাবছেন নিজেকে? লাটসাহেব? চেনেন আমাকে? আর হ্যা, তার আগে আমাকে- আমার প্রশ্নের উত্তর আপনাকে এখনই দিতে হবে; নইলে আমিও আজ আমার ক্ষমতা আপনাকে দেখাব ‘।
 
তখন লক্ষ্য করলাম, বাকী যাত্রীরা প্রায় সকলেই উপভোগ্য দৃশ্যটি দেখতেছে প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে। নিজেরা তো তারা নিজেদের অধিকার আদায় করতে পারে না; তাই যখন দেখার সুযোগ পাচ্ছে ‘কিভাবে নিজের অধিকার আদায় করতে হয়’; তখন সকলে মজাই পাচ্ছে। বেশ কয়েক জনকে লক্ষ্য করলাম, আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে। সকলেই খুব খুশী। কারণ এদের অনেকেই এইমাত্র হয়রানীর স্বীকার হয়েছে।
 
কিন্তু ঐ অফিসার তখনও হাল ছাড়ছে না। সে এবার অনেকটাই নরম হয়ে কিন্তু আদেশের স্বরে আমাকে বলছে, ‘ঠিক আছে- আপনি যান, ডলারগুলি এনডোর্স করে নিয়ে আসেন’।
 
কিন্তু আমি তো তাকে ছাড়বো না।
অনেক মানুষকে সে আমার সামনেই আজ কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি আমার টাকায় আমার অনুমতি ছাড়া হাত দিয়েছেন কেন? সেটার এনস্যার আপনাকে আগে দিতে হবে। আর ডলার যদি আমার পাসপোর্টে এনডোর্স করতেই হয়- আপনি নিজে গিয়ে করে নিয়ে আসবেন। আমি যাবো না। এবং আপনাকে আজ আমি একটা শিক্ষা দিয়েই এখান থেকে যাবো। আপনি যার যার কাছ থেকে আজ ঘুষ নিয়েছেন- সবগুলি টাকা এখনই বের করেন। সবার টাকা ফেরত দেন। নইলে কাল আপনার পোস্টিং কিন্তু খাগড়াছড়ি হবে- বলে দিলাম। আপনি কিন্তু আমাকে এখনও চিনতে পারেননি।’
 
হঠাৎ দেখলাম সাদা ইউনিফর্মে আরো দু’জন কাষ্টম অফিসার চিৎকার চেচামেচি দেখে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। তাদের একজন ওনার হাত থেকে আমার ম্যানিব্যাগটি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সরি স্যার। এ অফিসার আজ নতুন এসেছে এখানে- তাই হয়তো আপনাকে চিনতে পারেনি। আমি এর পক্ষ থেকে সরি। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। প্লিজ, অন বোর্ড করুন।’
 
কিন্তু আমি তো নাছোড় বান্দা। আরও চিৎকার করে বললাম, ‘এরকম অসভ্য অফিসার কেন এখানে ডিউটি দিয়েছেন? আপনার আজ শিফট ইনচার্য কে? আমি তার সংগে কথা বলে তারপর ফ্লাইটে উঠবো। আমি দেখতে চাই- এ কে এবং কে এমন অসভ্য অফিসারকে এখানে দায়িত্ব দিয়েছে?’
 
সত্যি বলছি- সেই অফিসার আমার হাত ধরে আকুতি করলো, ‘স্যার আমি মাফ চাচ্ছি। প্লিজ স্যার আমাদের ক্ষমা করে দেন; আর কখনও এরকম হবে না। ওরা আপনাকে চিনতে পারেনি।’
‘আমাকে না চিনুক; বাকীদের সংগে কেন এরকম করলো? এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট; অসভ্যতা দেখানোর জায়গা কি এটা?’
 
তার সংগের অন্যজন ঐ অফিসারকে ধমকের স্বরে ওখান থেকে নিয়ে গেল। আর এই অফিসার আমার করুনা পাবার আশায় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
 
আমি ক্ষমা করে দিলাম, সে আমাকে বিমানের গেট পর্যন্ত অন-বোর্ড করে দিয়ে বিদায় নিল।
 
এই হলো আসল বাংলাদেশের চেহারা।
শক্তের ভক্ত; নরমের জম।
 
মাস্তানী দুই
 
ব্যাংকক থেকে রাত নয়টায় আমার ঢাকার ফ্লাইট।
আমি পাতায়ায়।
 
ব্যাংককের কাঁচা আম অসাধারণ মিষ্টি। আমার খুব পছন্দ। অন্যান্য ফলও দারুন। আমি কোন হিসাব নিকাশ না করে প্রায় ৩৫ কেজির মতো আম আর কাঠাল কিনে ফেললাম। ভাবলাম এই সময় কাচা আম পেলে বাড়ীর সকলে কিছুটা অবাক এবং খুশীও হবে।
 
বিকেলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে রওয়ানা দেবো। কিন্তু হোটেল ম্যানেজার আমাকে জানালো ঠিক তার হোটেলের সামনে থেকেই বিকেল ৪টায় একটা বাস সুবর্ণভূমির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়; ভাড়াও কম এবং ৭টার মধ্যেই পৌছে যায় এয়ারপোর্টে। ট্যাক্সি নেবার বাহুল্যের কোন প্রয়োজন নেই।
 
কথায় যুক্তি পেলাম।
ঠিক চারটায় একটা মাইক্রো এসে আমাকে বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে গেল- সেখানে এসি কোচ ওয়েট করছে।
 
ঠিক সাতটায় সুবর্ণভূমিতে পৌছে গেলাম।
ফ্লাইট’টি ছিল বাংলাদেশ বিমানের। কাউন্টার খুঁজে পেলাম। নয়টায় ফ্লাইট, সাতটা বাজে অথচ কাউন্টার বন্ধ। টিকেট চেক করলাম। আমি কোন ভুল করিনি- সব ঠিকই আছে।
 
লক্ষ্য করলাম আমার মতোই আরো অনেক দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
 
সাড়ে আটটার পরপর দু’জন থাই মেয়ে কাউন্টারে গিয়ে বসলো।
আমি এগিয়ে গেলাম। গিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, ‘কি ব্যাপার? তোমার ফ্লাইট কি ঢাকা যাবে না কি আমাকে কোন হোটেল দিবে? হোটেল দিলে দাও- খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমাই; খুব টায়ার্ড লাগছে’।
 
মেয়েটা হেসে দিল, ‘যাবে। তবে সবকিছু ঠিক-ঠাক থাকলে রাত তিনটায় ফ্লাই করবে’।
‘আর আমি এতক্ষন এখানে কি করবো? ঠিক আছে, তুমি আমার লাগেজ বুকিং নাও এবং আমাকে টাকা দাও- ক্ষুধা লাগছে, খাবো’।
 
মেয়েটি আমার কথায় আবারও হেসে দিল। বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে’।
 
আমি আমার লাগেজ এগিয়ে দিলাম। বেল্টে মালামাল তোলার পর দেখা গেল আমার মালের ওয়েট ৪৬ কেজি। একজনের অনুমতি রয়েছে ২৫ কেজি পর্যন্ত। আমি যে বোকার মতো কোন হিসাব না করেই ৩৫ কেজি আম-কাঁঠাল কিনেছি সেটা তো আমার মনেই ছিল না!
 
মেয়েটা এবার সুযোগ পেল, ‘এখন কি করবে?’ মিটমিট করে হাসছে সে।
আমি ঝটপট উত্তর করলাম, ‘তোমাকে বাড়তি মালগুলি গিফট করলাম, তুমি বাসায় নিয়ে যেও’।
মেয়েটা আমার বোডিং কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুমি সাইডে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তোমার মালগুলি সিষ্টেম করে দিচ্ছি; ডোন্ট ওরী- দেখ আমি কি করি?’
আমি সত্যিই চমৎকৃত হলাম।
 
সে অন্য কোন একজন যাত্রীর মালের সংগে আমার মালগুলি বুকিং দিয়ে আমাকে টোকেন দিয়ে দিল। ঠোটে মিষ্টি হাসি কেটে, ২০০ বাথের কুপন দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার টাকা। যা ইচ্ছে খেয়ে নাও ভেতরে গিয়ে। আর ইও হ্যাপি নাও?’
 
‘আই এম রিয়েলী হ্যাপী এট দিজ ইভিনিং, থ্যাংক য়্যূ’।
   Send article as PDF