দুবাই

চলুন দুবাইয়ের গল্প করি।

এক ঢিলে ২টি নয়, কমচে কম ৩ থেকে ৪টি পাখি মেরে ফেলাই উত্তম। এবং এটা বলতে পারেন খুব ছোট বেলা থেকে-ই রপ্ত করা আমার এক চর্চিত অভ্যাস।

মানুষ তার অভ্যাস কখনোও ত্যাগ করতে পারে না; আমি কিভাবে পরবো বলুন? এই যে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই – সবসময়ই ভ্রমণের পাশাপাশি কিছু কাজ করে ফেলতে আমি আনন্দ পাই। এতে লোকল পিউপলদের সংগে মেলার সুযোগ হয়, সেই সংগে নতুন কিছু দেখা, নতুন কিছু খাবার ইত্যাদির সুযোগ অটোমেটিকলি চলে আছে।

নইলে, বিমানে করে যাবো, প্যাকেজ ট্যুর অপারেটরের ঠিক করে দেয়া হোটেলে উঠবো, তাদের নিয়ন্ত্রিত খাবার খাবো, তাদের গাড়ীতে ও ঠিক করে দেয়া সময় মতো সাইট-সিইং করবো – ব্যস বিদেশ ভ্রমণ হয়ে গেলো! এতে আমার পোষায় না কখনওই। ট্যুর অপারেটর আমাকে বলবে – ’ঠিক ভোর ৬টায় খেয়ে রেডী হয়ে থাকবে – গাড়ী কিন্তু তোমার জন্য দেরী করবে না!’ টাকা খরচা করে ‘বিরক্তি’ কেনা আমার অভ্যাস নয়।

আমার স্ট্যাইল হচ্ছে আমি আমার মতো করে বিমানের টিকেট কাটবো, আমার পছন্দ মতো হোটেল ঠিক করবো, হেঁটে হেঁটে নতুন শহর দেখবো – প্রয়োজনে লোকল ট্রান্সপোট দিয়ে রাইড নিবো, চেনা-অচেনা খাবার খাবো নিজের ইচ্ছে মতো, হুট করে রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে অচেনা খাবার খাবো; নিজে নিজে লোকল ট্যুর বুক করবো – দেখবো স্বাধীন মতো; কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন সুযোগ পাবে না। তবেই না আমি প্রকৃত স্বাধীন চেতা এক যাযাবর!

কেউ আমাকে ফোর্স করবে না যে, ‘তুমি সকাল ৬টায় রেডী থাকবে – গাড়ী কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না’! আমি মন চাইলে বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘুমাবো – আমার স্বাধীনতায় আমি কাউকে হাত দেবার সুযোগ দিবো না, দিই না। এটাই আমার জীবন।

দুবাই ভ্রমনের পরিকল্পনা আমার বহু বছরের। কিন্তু সময়-সুযোগ মিলেনি।

গত জানুয়ারীতে যখন কোলকাতা থেকে এমিরেটস এয়ারের ফ্লাইটে দুবাই ট্রানজিট হয়ে নিউ ইয়র্কে ফিরবো – তখন এমিরেটস আমাকে অফার করলো দুবাই -এ ২ রাত থাকার জন্য। মাত্র ৬০ ডলারে ওরা আমাকে ভিসা, দু-রাতের হোটেল ওইথ কমপ্লিমেন্টাল ব্রেকফাস্ট, এয়ারপোর্ট – হোটেল ফ্রি ট্রান্সফার এবং দুবাই এক্সপোর ফ্রি-টিকেট ও সেখানের আসা যাওয়ার গাড়ী অফার করেছিলো। কিন্তু সে-সময় ’আমার ২টি দিন’ আমার কাছে ঐ মোটে ৬০ ডলারের লোভনীয় অফারের চেয়েও অনেক বেশী মুল্যবান ছিলো বিধায় তা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ওটা একটা ভালো ও আনন্দময় সময় হতে পারতো।

সে যাকগে! এবার এমিরেটস এর ফ্লাইটে লন্ডনের স্ট্যানসটেড (Stansted Airport) এয়ারপোর্ট থেকে ৮ ঘন্টার লম্বা এক ফ্লাই করে দুবাই এসে পৌছলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার বিন্দুমাত্র একটি প্রশ্ন না করে এন্ট্রি সিল দিয়ে হাতে একটি ফ্রি এমিরেট সীমকার্ড ধরিয়ে দিলো – যদিও সেই সীমকার্ডটি আর একটিভ করা হয়নি। মুগ্ধ হলেম ওদের আচরণে।

এমনিতেই এই পৃথিবীর কোন ইমিগ্রেশন আমাকে সাধারণত আটকায় না, প্রশ্নও করে না। সে হিসাবে দুবাই ইমিগ্রেশনও যে প্রশ্ন করবে না – সেটা বলাই বাহুল্য। শুনেছিলাম লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসাররা নাকি খুবই পাজি – নানা প্রশ্ন করে জর্জরিত করে! এমনকি আমেরিকান পাসপোর্ট হোল্ডারদেরও নাকি বিভিন্ন প্রশ্ন করে, আর আমার তো বাংলা পাসপোর্ট! লক্ষ্য করছিলাম দূর থেকে লন্ডনের হিথরোতে ইউকে বর্ডার অফিসার অন্যদের সংগে কেমন কথা বলে বা আচরণ করে। সকলকেই দেখছিলাম (নন-আমেরিকান সিটিজেনদের) পাসপোর্টের সংগে এক গাদা কাগজ-পত্র উপস্থাপন করতে!

আমার ডাক যখন আসলো, সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার হাতে শুধুই একখানা বাংলা পাসপোর্ট। ইচ্ছে করেই অন্য কোন পেপারস বের করিনি। দেখি অফিসার কি বলে?

মধ্যবয়সী হোয়াইট বৃটিশ ইমিগ্রেশন অফিসার, আমার পাসপোর্ট এর পাতা উল্টিয়ে ইউকে এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স স্টিকারটি দেখলেন, তারপর আমার বাংলা পাসপোর্ট এর ইনফো পেইজ বের করে একবার আমার দিকে, আরেকবার আমার বাংলা-পাসপোর্টের দিকে তাকালেন বেশ কয়েকবার। এরপর হাসি হাসি মুখ করে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ঠিক কোথা থেকে এসেছো বলো-তো?’

আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘নিউ ইয়র্ক থেকে’।

তিনিও মুখ ভরা হাসি নিয়ে বললেন, ‘তাই-ই তো’!

এরপর পাসপোর্টে এন্ট্রি সিলটি বসিয়ে পাসপোর্টটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, ‘কতদিন থাকবে বলে ভাবছো?’

আমি বললাম, ‘৩ রাত থাকবো’।

’তুমি মাত্র ৩ রাতে কি দেখবে- আরও কিছুদিন থাকো। নাকি পরের বার একটু সময় নিয়ে আসবে?’ প্রশ্ন ছুড়লেন তিনি।

আমি আবারও হেসে দিয়ে বললাম, ‘দেখা যাক; যদি ভালো লাগে – তাহলে তোমাদের গ্রেট কান্ট্রি দেখার জন্য নিশ্চয়ই আবারও আসবো; তুমি ভালো থেকো’। আমার উত্তরে অফিসারটি মিস্টি করে হেসে আমাকে ইশারায় বিদেয় জানালেন।

পুরাতন দুবাই এর ’ডেরা’ নামক এলাকায় আমার হোটেল বুক করা ছিলো। প্রচন্ড গরমের শহর ডেরা – দুবাই। পুরো মধ্যপ্রাচ্যই গরম। দামী হোটেল অথচ ঠান্ডা পানি কাজ করে না। রিসিপশনে কল দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের ঠান্ডা পানির সিস্টেম কাজ করছে না; সমস্যা কি?’

টেকনিশিয়ান এসে ‘ভুম-ভাং’ কিছু একটা করে চলে গেলো – বললো, ‘এখন থেকে ঠান্ডা পানি কাজ করবে’।

কিন্তু সবই ভূয়া।

ঠান্ডা পানি নেই।

গরম পানিতে গোসল করতে হলো বাধ্য হয়ে, নাকে মুখে চোখে পানি দেবার সময় খুবই বিরক্ত হলাম।

এতো চাকচিক্য এক শহর বানিয়েছে আরবের ‘গাধা’ শেখরা; নিজেদের ইওরোপ বা হংকং এর সংগে তুলনায় নিতে চায় অথচ শহরে ঠান্ডা-গরম পানির সরবরাহ ব্যবস্থাই চালু করতে পারেনি। এরা সভ্য হবে কবে? সভ্যতার মানদন্ডই তো এরা জানে না!

বিশ্বের সবচে দরিদ্র মানুষদের দেশ ভারতের হোটেলগুলোতে পর্যন্ত ঠান্ডা-গরম পানির (গিজার দিয়ে হলেও) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে অথচ এই শেখদের হোটেলে কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থাটুকুও রাখেনি। পুরো দেশের সিসটেমের কথাতো বাদই দিলাম। আরবের কোথাও রাস্তায় একটি ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ আমার চোখে পরেনি। কিছু বড় বড় ভবন আর রাস্তা তৈরী করলেই কি ‘উন্নত’ ভাবা সম্ভব? উন্নত হওয়া কি এতই সোজা?

দুবাই-এ ইংরেজীতে কথা বলা যায়; যদিও অধিবাসীরা উর্দূ বা হিন্দী (দুটো একই ভাষা- আলফাবেট ভিন্ন) তে কথা বলে অভ্যস্ত। এসব অধিবাসীদের প্রায় সকলেই ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-ফিলিপিন্স থেকে আসা। স্থানীয় আরবরাও নাকি উর্দূতেই কথা বলে এদের সংগে। আমি (ইচ্ছে করেই) উর্দূ বা হিন্দী বুঝি না; কারো সংগে ওভাষায় কথা বলি না বা কাউকে কথা বলার সুযোগ দেই না। এবং লক্ষ্য করেছি তারা সকলেই ইংলিশ জানে।

আমার সংগে কেই কথা বলতে আসলে তাকে অবশ্যই ইংলিশে কথা বলতে হবে আর যদি সে ইংলিশ না জানে তাহলে তার জন্য একমাত্র অপশন হচ্ছে ‘বাংলা’।

দুবাই সফরে যাবার আমার দ্বিতীয় কারণটি (এক ঢিলে ২ পাখি মারা) ছিলো সেখানে যে-কোন একটি ব্যাংকে একটি চেকিং একাউন্ট ওপেন করা। কিন্তু যাবার আগে প্রায় ২ মাস এসব নিয়ে স্ট্যাডী করে জানলাম যে- দুবাইতে ব্যাংক একাউন্ট করতে হলে আগে সেখানকার ‘রেসিডেন্ট’ হতে হবে।

কি আর করা? দুবাই বিশ্বের সকলকেই আমিরাতের টুরিস্ট ভিসা দেয় এবং যে-কেউ চাইলেই কিছু নগদ টাকা খরচা করে এখানকার ‘রেসিডেন্সী’ নিতে পারে। ’রেসিডেন্সী’ প্রদান দুবাই সরকারের একটি বড় ব্যবসা। যে-কোন মানুষ দুবাইতে ‘রেসিডেন্সী’ ক্রয় করে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে। গাড়ী-বাড়ী-ঘর-জায়গা-জমি ১০০ বছরের জন্য লীজ নিতে পারে।

আমার যেহেতু ব্যাংক একাউন্টটি জরুরী, সেহেতু সিদ্ধান্ত নিলাম দুবাই -এ রেসিডেন্সী কিনবো। আমেরিকায় বসেই অনলাইনে অসংখ্য কোম্পানীর সংগে যোগাযোগ করলাম। তাদের মধ্যে ৯৫% কোম্পানীর মালিক ও কর্মচারীরা ভারতীয়। আর এটা তো অতি পুরাতন কথা যে – ‘ভারতীয়রা টাওট প্রকৃতির একটি জাতি’। এরা একবার অন্যের টাকা কোনও ভাবে নিজের পকেটে ঢুকাতে পারলে – প্রডাক্ট বা সার্ভিস দিতে পারুক বা না পারুক সেই টাকাকে নিজে পৈত্রিক সম্পত্বি হিসাবে গণ্য করে থাকে। এদের প্রতিটি কথায় চালাকি লুকায়িত থাকে। এবং এদের হাতে ওয়ার্ক অর্ডার দিলে একটা একটা করে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হিডেন চার্জ বের করতে থাকে। আমি ইন্ডিয়ানদের এসব ব্যাপারে আগে থেকেই অবহিত। কাজেই যখনই বুঝতে পারলাম দুবাই নিয়ন্ত্রন করছে টাওট-ভারতীয়রা তখনই সতর্ক হয়ে গেলাম।

   Send article as PDF