ব্যক্তিগত অসুখ

৯/১১ আমেরিকার ইতিহাসের একমাত্র কালিমা। এই দিনে আমেরিকার গর্ব বলে খ্যাত টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগনে বিমান হামলা হয়।
 
যাই হোক, ৯১১ হলো আমেরিকার ইমারজেন্সী নাম্বার।
 
যে-কোন মোবাইল বা ফোন থেকে (নেটওয়ার্ক না থাকলেও) এই নাম্বারে ফোন করে সাহায্য চাওয়া যায়।
 
এক স্কুল বালক একবার ৯১১ নাম্বারে ফোন করে বললো, ‘হ্যালো, আমি না অংকটা মিলাতে পারছি না; একটু হেল্প করবেন?’
 
আমি গতকাল ৯১১ নাম্বারে ফোন করলাম।
এক ভদ্রমহিলা আমার ফোন রিসিভ করে প্রথমেই জানতে চাইলেন আমার বাসার ঠিকানা। আমি বললাম। এরপর জানতে চাইলেন, ‘কি প্রব্লেম?’
 
আমি বললাম, ‘ঘন্টা তিনেক যাবৎ প্রচন্ড পেট ব্যাথা করছে, ইমারজেন্সী এম্বুলেন্স পাঠাও’।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তুমি একটু হোল্ডে থাকো। আমি তোমাকে লাইনটা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি- তোমাকে যাষ্ট দু’একটা প্রশ্ন করবে- একটু সহযোগীতা করো’।
 
এবং মুহুর্তেই লাইনটি ট্রান্সফার হলো, এবার এক ভদ্রলোক অত্যন্ত মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমাকে একটু বিশদভাবে বলবে, তোমার ঠিক কি প্রব্লেম হচ্ছে?’
 
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ; প্রায় ঘন্টা তিনেক যাবৎ আমার প্রচন্ড পেট ব্যাথা হচ্ছে- আমি সহ্য করতে পারছি না’।
‘তোমার পেটের ঠিক কোথায় ব্যাথাটা করছে?’
‘সম্পূর্ণ পেটটাতেই।’
‘ওকে, ডোন্ট ওরী; যাষ্ট ৫ মিনিটের মধ্যে তোমার বাসার গেটে এম্বুলেন্স পৌছে যাবে। তুমি চিন্তা করো না। তোমার নাম্বারটা আমাকে কমফার্ম করো; তোমাকে পেতে আমাদের কোন সমস্যা হলে- আমরা তোমাকে কল করবো। আমরা আসছি।’
 
সে আরো কয়েকটা প্রশ্ন খুব সংক্ষেপে করে তারপর আমার নাম, বয়স, বাসার নাম্বার ও সেলফোন নাম্বারটা কনফার্ম করে নিল।
 
আমি তারাতাড়ি একটা ট্রাউজার্স পরে নিলাম, ম্যানিব্যাগটা পকেটে ঢুকালাম। মোবাইলটা আরেক পকেটে। ৭ মিনিটের মাথায় আমার দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ পেলাম। দু’টো ছেলে আমাকেই নাম ধরে খুঁজছে।
 
আমি প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে গেটের সামনে গেলাম। খুবই কষ্ট হচ্ছিল আমার। কিন্তু ছেলেটা আমাকে দেখে মনে হলো কিছুটা হতাশ হলো- ও হয়তো ভেবেছিল আমাকে ক্যারী করে নিয়ে যেতে হবে; কিন্তু আমি তো রীতিমত হাঁটছি!
 
ছেলেটা আমাকে এম্বুলেন্সে উঠতে সাহায্য করলো। আমি উঠে বসলাম। আমার পার্সোনাল ইনফরমেশনস ও ওর কাষ্টমাইজড ল্যাপটপে এন্ট্রি করে নিল, আমার ‘হেলথ ইন্স্যুরেন্স’ জানতে চাইলো। এবং একটু পর সে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
 
এমনিতে আমার সময়গুলি খুবই দ্রুত কেটে যায়, কিন্তু তখন মনে হচ্ছিল এক একটা ন্যানো সেকেন্ড যেন একটা স্বাভাবিক ঘন্টারচেয়েও লম্বা!
 
আমি পেটের ভয়াবহ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি; বসতে, শুতে বা দাড়াতে কোনটাই ভাল লাগছিল না। লক্ষ্য করলাম, আমি বাসায় পায়ে দেবার স্যান্ডেল পরেই চলে এসেছি।
 
ব্রঙ্কসের সেন্ট বার্ণাবাস হসপিটালের ইমারজেন্সীতে আমাকে নেয়া হল।
কিন্তু, প্রচুর রোগী এখানে, অনেককেই মনে হলে আমারচেও ভয়াবহ অবস্থা।
রোগীর চেয়ে ইমারজেন্সী ডাক্তারের সংখ্যা কম মনে হলো।
আমার আগে প্রায় ৪/৫ জন রোগীর কিউই।
একটা মেয়ে এসে আমার হাতে একটা প্যাসেন্ট লেভেল ষ্টিকার লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
এদিকে প্রচন্ড ব্যাথা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
ব্যাথায় আমি ৩বার মাটিতে বসে পরেছিলাম; মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো।
 
যাই হোক, একসময় একজন নার্স আসলো- অল্প বয়সী বাট একটু মোটা হোয়াইট একটা মেয়ে। আবার আমার কিছু পার্সোনাল ইনফরমেশন নিয়ে তার মোবাইল-ল্যাপটপে এন্ট্রি করে আমাকে ওয়েট করতে বলে চলে গেল এবং প্রায় মিনিট পাঁচেক পর একটা প্যাসেন্ট-ষ্ট্রেচার নিয়ে এসে আমাকে ওটার উপর শুতে অনুরোধ করলো। অামি শুলাম।
 
সে একাই ওটা ঠেলে ভেতরে নিয়ে ঢুকলো। এবং আমাকে রেখে সে চলে গেল।
আর আমি ব্যাথায় কুকড়িয়েই চলছি।
 
প্রায় আধ ঘন্টা পর একজন ‘মহিলা ডাক্তার’ আসলেন, আমার প্রেসার নিলেন, সুগার পরীক্ষার জন্য ব্লাড নিলেন, আরো কি সব করলেন। এবং জানতে চাইলেন পেটে কেমন ব্যাথা, ঠিক কোথায় ব্যাথা, আগে কখনও হয়েছে কিনা ইত্যাদি।
 
ভদ্রমহিলা সাসপেক্ট করছিলেন এপেনডিসাইড এর ব্যাথা হতে পারে। কিন্তু প্রাইমেরী পরীক্ষায় উনি সেটার প্রমাণ পেলেন না।
 
আমাকে বললেন, তোমার মেডিসিন আর কিছু টেষ্টের অর্ডার দিচ্ছি- নার্স এসে এগুলি করে যাবে। তুমি ওয়েট করো।
আমি ওকে বললাম, প্লিজ তুমি আমাকে এটলিষ্ট তারাতাড়ি ‘পেইন কিলার দাও’। আমি অার সহ্য করতে পারছি না।
 
ভদ্রমহিলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে আমাকে ওয়েট করতে বলে চলে গেলেন অন্য ইমারজেন্সী রোগীদের দেখতে।
 
আমি আবারও কাঁতরাচ্ছি।
প্রচন্ড ব্যাথা।
 
আমার ডাক্তার বা নার্সের কোন খবরই নেই।
মনে মনে ভাললাম, ঢাকায় হলে তো এতক্ষনে পুরো হসপিটাল, ডাক্তার আর নার্সদের খবর আনিয়ে ফেলতাম। কিন্তু এখানে কি হচ্ছে। কোন পাত্তাই তো পাচ্ছি না।
 
মেজাজ সত্যি বিগড়ে গেল। কিন্তু আমেরিকানরা অত্যন্ত সভ্য জাতি; আমি ২/১ টা ব্লাকের পাগলামী ছাড়া গত প্রায় ২ বছরে কাউকে এদেশে মেজাজ খারাপ করতে দেখিনি। কাজেই মেজাজ খারাপ করা চলবে না।
 
আমি অত্যন্ত ভদ্র হয়ে শুয়ে, বসে, দাড়িয়ে, চিৎ-কাত হয়ে প্রচন্ড ব্যাথা সহ্য করে যাচ্ছি।
 
এক পর্যায়ে ওই ডাক্তার মহিলাকে খুঁজে বের করলাম। তাকে গিয়ে বললাম, দেখ আমি কিন্তু প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছি, তোমার কোন এটেনশন দেখছি না আমার প্রতি। তোমার নার্স কোথায়? সামান্য একটা পেইন-কিলার তো আমাকে দিতে পারো।
 
সে আমাকে তার কমপিউটারের মনিটর দেখিয়ে বলল, দেখ; আমি তোমার মেডিসিন অর্ডার দিয়ে রেখেছি- নার্স চলে আসবে। তুমি একটু ওয়েট করো প্লিজ।
 
আমি আবার আমার বেডে ফিরে আসলাম।
তারও প্রায় ২০ মিনিট পর সেই ডাক্তার আবার আসলেন। আমাকে বলল, নার্স তো আসছে না, তাই আমিই আসলাম, তোমার কিছু ব্লাড নেব।
 
আমি বললাম, তোমার যা খুশী কর, কিন্তু আমাকে আগে ব্যাথাটা কমাও।
 
সে আমার ব্লাড নিয়ে চলে গেল; যাবার সময় বলল, রোগী অনেক বেশী আজ তাই একটু সময় লাগছে- আর এজন্য আমি নিজেই এসে তোমার ব্লাড নিলাম।
 
এবং একটু পরে দেখলাম, সেই ডাক্তার মহিলা তার ব্যাগ গুছিয়ে ডিউটি শেষ করে চলে যাচ্ছে- আমার দিকে ফিরেও তাকালে না।
 
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আরেকজন মহিলা ডাক্তার সেই সীটে এসে বসলেন।
এবং প্রায় ১৫ মিনিট পর তিনি আমার কাছে আসলেন। আমাকে একটু পরীক্ষা করে বললেন তুমি আর একটু ওয়েট করো, নার্স চলে আসবে তোমার মেডিসিন নিয়ে- অর্ডার দেয়া আছে।
 
আমি আর পারছিলাম না।
আবার উঠে গেলাম। বেশ বিরক্তি ভাব টেনে এই ডাক্তারকে বললাম দেখ আমি ৩ঘন্টা প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে ৯১১ এ ফোন করেছি। তোমাদের এখানে এসে পৌচেছি বিকাল ৪টায়। আর এখন বাজে প্রায় রাত ৮টা। অর্থাৎ আমি ৭ ঘন্টা যাবৎ প্রচন্ড ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছি। আর কতক্ষন- আমাকে একটু বলবে? না কি আমি বাসায় ব্যাক করবো- তোমাদের এখানে থেকে কষ্ট পাবার চেয়ে বাসায় চলে যাওয়াটাই আমার জন্য ভাল সিদ্ধান্ত হবে!
 
এবার মেয়েটার টনক নড়লো।
সে তার সামনে দাড়িয়ে থাকে নার্স মেয়েটিকে আমার মেডিসিন দ্রুত প্রয়োগের জন্য অনুরোধ করলো।
মেয়েটা কমপিউটার নিয়ে বসলো এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইনজেকশন, স্যালাইন আরও কিসব হাবিজাবি নিয়ে আমার বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো এবং তার কার্যক্রম শুরু করলো।
স্যালাইন লাগিয়ে আমাকে বলল, তোমাকে এখন মরফিন ইনজেকশন দিবো, তোমার মাথাটা একটু ঝাকি দিবে এবং তারপরই তোমার ব্যাথাটা চলে যাবে।
 
আস্তে আস্তে আমার ব্যাথা কমতে থাকলো।
স্যালইন চলছে। এর মধ্যে একজন ব্লাক এসে আমাকে বেডসহ টেনে নিয়ে গেল আলট্রাসাউন্ড করার জন্য। আলট্রাসাউন্ডে দেখা গেল গলব্লাডারে ষ্টোন রয়েছে এবং এটা সেই গলব্লাডারের ষ্টোনেরই ব্যাথা।
 
পরে জানলাম, এই ব্যাথাটা মানে গলব্লাডারে ষ্টোন এর ব্যাথাটা না কি মেয়েদের সন্তান প্রসব কালীন ব্যাথার সমান।
 
এবং এই অসহ্য এবং অতি কষ্টকর ব্যাথাটা আমি প্রায় সাত ঘন্টা সহ্য করলাম।
 
যাই হোক, ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ডে সন্তুষ্ট নন; সিটি সিটি স্কান করালেন। আবার ব্লাড টেষ্ট করালেন আগেরটা নির্ভূল কি না তা যাচাই করার জন্য।
 
এবং শেষটায় রাত সাড়ে বারটায় আমাকে ঢেকে বললেন, আমি খুবই দুঃখিত- তুমি যে সারা দিন কিছুই খাওনি সেটা আমার লক্ষ্য করা উচিৎ ছিল। তুমি এখনই আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই টুনা’টা খাবে। তারপর তোমাকে ডেসপাস করে দেব।
 
তবে সুসংবাদটা হলো- আমার এই গলব্লাডার ষ্টোনটা ক্ষতিকর নয় এবং এটা অত্যন্ত প্রাইমেরী ষ্টেজে রয়েছে।
 
আমি টুনা-স্যান্ডউইচটা খেলাম।
সে আমাকে রিপোর্টগুলির একটা প্রিন্ট আউট দিয়ে উপদেশ দিল আমার পিসিবি’কে যেন তাড়াতাড়ি এসব বিষয়গুলি জানাই এবং তার পরামর্শে পরবর্তী ট্রিটমেন্ট গ্রহন করি। এবং যদি আবার কোন ব্যাথা কখনও উঠে- তাহলে যেন সরাসরি ৯১১ এ কল দিয়ে তাদের এই হসপিটালে চলে আসি।
 
আমি রাত ১টায় একটা ব্লাক ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
   Send article as PDF