নাসিবা

ম্যানহ্যাটনে একটা কাজ ছিল।
সারাদিন ওখানেই ছিলাম।

মধ্য এশিয়ার একটা মেয়ের সংগে পরিচয় হলো- মেয়েটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে জব করে; বাড়ী উজবেকিস্থান। তার এমবিএ করার পর তাসখান্ডস্থ ‘বাংলাদেশ দুতাবাস’ এ প্রায় ৩ বছর চাকুরী করেছে। সেই সুত্রে বাংলাদেশের খাবারের প্রতি তার অসীম আগ্রহ- প্রতিদিন দুপুরে সে বাংলাদেশ দুতাবাসে বাংলাদেশী খাবার খেত। বাংলাদেশী মাছ তার অতি প্রিয়। বাংলাদেশী পিঠারও ভূয়সী প্রশংসা করলো সে।

রাশিয়া, টার্কি, জাপান আর ইন্ডিয়া সম্পর্কে তার চমৎকার ধারণা রয়েছে। সে উজবেকিস্থান, ইন্ডিয়া, টার্কি এবং জাপানে পড়াশোনা করেছে। নিজের ও তার বাবার চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়াতে এসেছে বেশ কয়েকবার।

উজবেকিস্থান সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেংগে যাবার পর স্বাধীন হওয়া- মধ্য এশিয়ান মুসলিম কান্ট্রি। কাজাকিস্থান, আফগানিস্থান এর সংগে বর্ডার রয়েছে। ওর গ্রামের বাড়ী (হোম টাওন) সামারখান্ড আর নানা বাড়ী বোখারা। বোখারা প্রদেশটিতে প্রচুর ইহুদীর বসবাস। এবং বোখারার ইহুদিদের বড় একটা অংশ এখন আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ফরেষ্ট হিলে বসবাস করে। আমি জানতাম ইরানে প্রচুর ইহুদী রয়েছে- কিন্তু বোখারাতেও যে প্রচুর ইহুদী রয়েছে তা আজই জানলাম।

উজবেকিস্থান মুসলিম কান্ট্রি কিন্তু সেখানে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত। মেয়েদের হেজাব পড়া নিষেধ। সরকার আজান বা নামাজ পড়া পছন্দ করে না। (ঠিক বাংলাদেশের মতোই)।

সোভিয়েট ইওনিয়ন যে পুরোটাই একটা ‘চাপাবাজী’র উপর দাড়িয়েছিল সেটা বোঝা গেল ‘নসিবা’র কথায়। উজবেকিস্থানের চিকিৎসা ব্যবস্থা নাকি সেখানে বাংলাদেশের মতোই! অর্থনৈতিক অবস্থাও যথেষ্ঠ ভাল না। সাধারণ মানুষের গড় আয় মাসে ১২০ ডলাররে কম। তেল ও স্বর্ণের খনি রয়েছে বোখারায়। রাজধানী তাসখান্ড বেশ পরিচ্ছন্ন শহর।

উজবেকিস্থানের পয়সাওয়ালা মানুষ তাদের চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়াতে যায় আবার কেউ কেউ যায় ইস্তানবুলে। ১০০টার উপর দেশে যেতে তাদের কোন ভিসা লাগে না। মেয়েটি যেহেতু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে চাকুরী করে- সেহেতু তার রয়েছে ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট।

কিন্তু সবচে মজার যে বিষয়টা জানলাম, সোভিয়েট ইওনিয়ন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের নাগরিকদের জন্য রাশিয়ার রয়েছে একটা চমৎকার অফার। এক্স সোভিয়েট ইউনিয়েন ভুক্ত যে কোন নাগরিক- যদি সে রাশান ভাষায় পারদর্শীতা দেখাতে পারে- তাহলে সে চাইলে- চাওয়া মাত্র রাশিয়া তাকে বা তার পরিবারকে রাশিয়ান পাসপোর্টসহ নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে। এবং সেই পাসপোর্ট দিয়ে মধ্য এশিয়ার যে-কোন দেশে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করা যায়।
অপরদিকে উজবেকিস্থান বাইরের কোন দেশের কোন মানুষকে কোন অবস্থাতেই নাগরিকত্ব দেয় না, ইভেন কেউ যদি অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করে- তবে তার উজবেক নাগরিকত্ব চলে যাবে এবং পরবর্তী ২ বছর তাকে উজবেকিস্থানের ভিসাও দেয়া হয় না।
উজবেকিস্থানে কোন ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই- সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা বললে তা বরদাস্থ করা হয় না- বাংলাদেশ বা চায়নার মতোই।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ভিজিটররা গড়ে প্রতিমাসে ২টি করে উজবেক মেয়েকে বিয়ে করে থাকে। এবং তাদের বেশীরভাগই তাদের উজবেক স্ত্রীকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। সে যখন বাংলাদেশ দুতাবাসে কাজ করতো তখন সে নিজ হাতে এই বাংলাদেশী উজবেক মেয়েদের ভিসাগুলি প্রসেস করতো। কিছু ব্যবসায়ী অবশ্য উজবেক মেয়ে বিয়ে করে তাসখান্দেই বসবাস করতেছে।

তবে, সবচে চমৎকার গল্পটি হলো- ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তার চাকুরীকালীন সময়ে দুতাবাসের ‘রাষ্ট্রদূত’ সাহেব- একটি ১৭ বছর বয়েসের উজবেক মেয়েকে বিয়ে করেছে। ঐ ১৭ বছরের মেয়েটি খুবই নিন্মমানের একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছে এবং তার নামে তাসখান্ডে ২টি বাড়ী করিয়ে নিয়েছে রাষ্টদূত সাহেবের টাকায়। আরো অনেক কিছু।
বাংলাদেশের প্রাইম মিনিষ্টারের নামটা সে ঠিক-ঠাক মনে করতে পারছিলা না, হা-বি-সা-সা কি কি যেন আওড়াচ্ছিল।; আমি মনে করিয়ে দেয়াতে সে বলল, হ্যাঁ শেখ হাসিনা’র কাছে বিশেষ আবেদন করে সে ঐ এম্বাসিডার উজবেকিস্থানের স্ত্রীকে বিয়ে করা পারমিশন নিয়েছিল- আমি নিজে ঐ চিঠি ড্রাফট করে দিয়েছিলাম। (যদিও আমার এবং নাসিবা’রও জানামতে কোন কুটনৈতিক বিদেশী কোন মেয়েকে বিয়ে করার অধিকার রাখে না)। শেখ হাসিনা বলে কথা!

উজবেক মেয়েরা একা নিজ দেশের বাইরে ভ্রমনে যেতে পারে না, সংগে অবশ্যই পুরুষ অভিভাবক থাকতে হবে- এই আইনটি আমি দেখেছি নেপালেও।

ঐ অফিসে আমি এবং ঐ মেয়েটিও অনেকটা সময় ওয়েটিং এ ছিলাম- অনেক কথা হলো। গল্প জমে উঠলো।

গল্পের এক পর্যায়ে সে আমাকে কিছু কথা বলল।
মূলত ঐ কথাগুলি শেয়ার করার ইচ্ছে থেকেই আজকের লেখা।

সে আমার কাছে হঠাৎই জানতে চাইলো- ‘আচছা তোমাদের দেশের সরকারী বড় অফিসাররা কি ঠিক-ঠাক অফিস করে?’
আমি কিছুটা অপ্রস্তত হয়ে গেলাম- কি বলতে চায় মেয়েটি? তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন? তোমার কথা আমি ঠিক বুঝিনি!’

মেয়েটা হেসে দিল।
বলল, আসলে আমি যখন চাকুরী করতাম তখন দেখতাম দুতাবাসের বাংলাদেশী অফিসাররা অফিসে ঢুকতো ৯টার পরিবর্তে ১০টায়। তারপর ১ ঘন্টা পেপার পড়তো, চা খেত- খুব ব্যস্ততা দেখাতো পেপার পড়ার সময় কথা বললে। তারপর ১২টা পর্যন্ত অর্থাৎ ১ ঘন্টা অফিসিয়াল কিছু কর্ম করেই ‘প্রেয়ার টাইম প্রেয়ার টাইম’ বলে চিৎকার করে উঠতো। সব কাজ বাদ।
প্রেয়ার টাইম শেষ হলেই লাঞ্ছ টাইম এসে যেত। লাঞ্ছের পর একটু রেষ্ট তো চাই-ই চাই। তিনটায় ১টা ২টা ফাইল হাতে নিয়েই বলতো ‘এই, লেট হয়ে যাচ্ছে- বাসায় যেতে হবে; জরুরী কাজ আছে।’

ব্যস, কাজ শেষ।
সারাদিন দুই ঘন্টা ওয়ার্ক।
কি চমৎকার চাকুরী বড় কর্তাদের!

হাহাহা করে হেসে দিল মেয়েটি। আমিও হাসলাম নসিবা’র সংগে তাল মিলিয়ে। সে আমাকে প্রশ্ন করলো- দেশের অফিসাররাও কি এরকমই করে।

আমি উত্তর দেবার আগেই- আমার ডাক পরলো ভেতর থেকে।
মেয়েটার সংগে অার কথা হয়নি।
দেখা হলে শুধু বলতাম- ‘হ্যাঁ’ ঠিক তাই। আর এজন্যই তো ‘বাংলাদেশ’। ওও হয়তো বলতো- ‘হ্যাঁ- এজন্যই আমরাও উজবেকিস্থান’। হা হা হা

   Send article as PDF