এক ভয়ংকর যাত্রার রাত

দুই হাজার ছয় সাল।
আজ থেকে পাক্কা দশ বছর আগের কথা।

আমি সাধারণত হঠাৎ বা এলোমেলো সিদ্ধান্ত নিতে ভালবাসি। সিদ্ধান্তের বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করে কোন লাভ নেই; মাথায় যা আসে তাই করতে পছন্দ করি। অবশেষে যদি দেখি সিদ্ধান্তটা ‘ভূল’ ছিল- তখন-ই শুধুমাত্র মাথা খাটাই ‘সেই ভূল’-টাকে কিভাবে মোড় ঘুরিয়ে সঠিকের রাস্তায় নিয়ে নেয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেতে তা করিও। এটাও এক ধরণের মজা।
তবে, এই মজাটা সকলের করা উচিৎ না। ভেবে চিন্তা সিদ্ধান্ত নেয়াটা-ই মনে হয় ভাল।

রোজার ঈদের রাতে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন সকালে শ্বশুড় বাড়ী ভোলা যাব। রাতেই ড্রাইভারকে ফোন দিলাম, ও বলল, ‘স্যার কোন সমস্যা নেই- আমি এবং গাড়ী দু’টোই ওকে’।

রাতেই ব্যাগেজ গুছিয়ে রাখলাম। আমার ওয়াইফ ও কাজের মেয়েটাও তাদের প্রস্তুতি রাতের মধ্যেই সেড়ে নিল। সকালে সাতটার দিকে রওয়ানা দিলাম।
আটটার দিকে পৌছে গেলাম মাওয়া ফেরীঘাটে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো আরও হাজার হাজার গাড়ী পারাপারের অপেক্ষায়। ১২টার দিকে ফেরীতে উঠতে পারলাম। ওপাড়ে পৌছতে পৌছতে আড়াইটা। বরিশাল এর কাছাকাছি যাবার পর দেখি আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। ভোলায় ফোন করে জানলাম সাগড় উত্তাল ৫ নম্বার বিপদ সংকেত। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম কপালে আজ দূর্গতি আছে।

বরিশাল পৌছলাম সাড়ে চারটা নাগাদ। তখনও কির্তনখোলা ব্রীজ তৈরী হয়নি। ফেরী পারাপারই ভরষা। প্রচন্ড বৃষ্টি এবং সংগে ঝড়ো হাওয়া বইছে। বরিশাল থেকে ভোলার সর্বশেষ ফেরীটি সাড়ে ছয়টায় ছেড়ে যায়। আমি চাইছিলাম- ওই শেষ ফেরীটা ধরতে।

বরিশালের ফেরী পাড় হয়ে ওপারের বরিশাল-ভোলা হাইওয়ের সরু পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে আকাঁবাকা অনেকগুলি বাক পার হয়ে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেই পৌছলাম লাহারহাট ফেরী ঘাটে। তখন অলরেডী অন্ধকার হয়ে আছে চার দিক। ফেরী ঘাটে সময়ানুযায়ী শেষ ফেরীটাও এসে ভিড়েছে। ভাবলাম, বিপদ থেকে তাহলে বোধহয় মুক্তি মিলল। ফেরী পার হলে আর কোন সমস্যা নেই- ওই পার থেকে ২৫/৩০ মিনিটেই পৌছে যাবো শ্বশুরালয়ে।

কিন্তু ভিন্ন ইতিহাস যে লেখা ছিল কপালে- সেটা কে ঠেকাবে?
ফেরীতে গাড়ী উঠাতে গেলে ফেরীর কর্মীরা বাঁধা দিল, বলল, ‘এই ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে ফেরী আজ রাতে আর ছাড়া সম্ভব নয়’।
ড্রাইভারকে দিয়ে ফেরীর মাষ্টারকে অনেক অনুনয় করেও কোন কাজ হল না- ওনি কোন ঝুঁকি নেবেন না এই উত্তাল সাগরতূল্য নদীতে ফেরী চালাবার।

এদিকে দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসছে। এলাকায় ইলেকট্রিসিটি আছে কি না জানি না; থাকলেও লোড-শেডিং চলছে। ভয়াবহ অন্ধকার নেমে আসছে। ঝড়ো হাওয়া। প্রচন্ড বৃষ্টি।

ভোলা থেকে ফোনে আমাদের অবস্থান জেনে- তারা আমাকে আরও টেনশনে ফেলে দিল। এই এলাকাটা না কি চোর অার ডাকাতের আস্তানা। এখানে কোন ভাবেই রাতে থাকা সম্ভব নয়।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে- কি করবো? আমার ড্রাইভার ভীষন ভয় পেয়ে গেছে। তার না কি মাথা কাজ করছে না। আমার ওয়াইফও দেখি টেনশনে কাহিল।
কিন্তু মজার বিষয় হল- আশ্চর্য্যজনকভাবে আমার কোন টেনশন নেই। আমি খুবই স্বাভাবিক।

আমি ঠিক বুঝি না কেন- জটিল বিষয়গুলি মোকাবেলা করে আমি একধরণের তৃপ্তি পাই। আনন্দ পাই। মজা লাগে, ভাল লাগে। আমি বিষয়টাকে খুব এনজয় করছি। তখন আমি আরও বেশী আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি।

আমার মাথা- সত্যিই তখন চমৎকার কাজ করছিল। আমি বিন্দুমাত্র ভয় করছিলাম না। ২/৩ জন মানুষ অামরা; কোথায় যাব? কোথায় থাকবো? সংগে অনেক কিছু। ডাকাতির ভয়। ভয়ংকর অবস্থা; অথচ আমি খুব স্বাভাবিক।

ড্রাইভার আমাকে তাড়া দিচ্ছে- স্যার কি করবো?
আমি ওকে বললাম, বরিশাল ফিরে চল। ফেরীঘাটে যাবার পর একটা ব্যবস্থা হবেই।
ডাইভার আমার নির্দেশনায় খুশী হল। গাড়ী ঘুরালো। উদ্দেশ্য বরিশাল।

কিছুটা রাস্তা আসার পর দেখা গেল একটা বিশাল গাছ উপড়ে রাস্তার উপর পরে রয়েছে এবং কোনভাবেই গাড়ী নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এবং গাছটি অল্প সময় আগেই পরেছে। কারণ কিছুক্ষন আগেই আমরা এই রাস্তা দিয়ে এসেছি।

ড্রাইভার এবার আরও ভয় পেয়ে গেল। ওদিকে আমার ওয়াইফও দেখলাম প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে!
আমি ড্রাইভারকে বললাম, ‘আবার ফেরীঘাটে চল’।
‘স্যার, ওখানে ফিরে আমরা কি করবো’? কোথায় যাব?
আমি বললাম, ‘চল আগে। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়; তাছাড়া এখানে আটকে থেকেও তো কিছু্ই হবে না; টেনশনের কিছুই নেই’।

ড্রাইভার আমার নির্দেশে আবারও গাড়ী ঘুরিয়ে ফেরীঘাটে ফিরে এল। ভোলা থেকে তখন আবারও ফোন- বরিশাল পৌছতে পেরেছি কি না? ইত্যাদি। জায়গাটা ভাল না। প্রায়ই না কি এখানে মানুষ খুন হয়। কিসব হাবিজাবি।

আমি ভাবছিলাম এবার কিছু একটা করতে হবে। প্রথমে ভাবলাম মসজিদ খুঁজবো- ইমাম সাহেবের সহায়তা নেব। পরেই আবার ভাবলাম, ফেরীঘাটে তো ২/৩ টি দোকান থাকার কথা। ড্রাইভারকে বললাম, দোকানের কাছে গাড়ী নিতে।

আমি আমার অভিজ্ঞতায় জানি, ঠিকানা-হীন লোক-জনই চুরি-ডাকাতি করে। যার ঠিকানা আছে সে চাইলেও কোন অন্যায় করতে পারে না। মসজিদের ঈমাম বা স্থানীয় দোকানদার কাউকে না কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেই।

দোকানটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। ভেতরে কেউ রয়েছে কিনা বোঝার কোন উপায় নেই। বাইরে থেকে ঝাপ নামানো। আমি ড্রাইভারকে বললাম, দোকানের দরজা জোরে জোরে নক করো। কিন্তু ভেতরে আসলেই কেউ নেই।

আমি পরের দোকানে যেতে বললাম। সেখানে নক করে কাজ হল। দোকানদার ভেতর থেকে হারিকেন এর আলো বাড়িয়ে দরজা খুলল।
আমি বুঝে ফেললাম, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। টেনশন করার কোন মানেই হয় না।

দোকানদার আমাদের ঘটনা মুহুর্তেই বুঝে নিল- আমরা কি রকম বিপদে রয়েছি সেটা বুঝতে তার বাকী থাকলো না। মানুষ বিপদে পরা মানুষদের সবসময়ই মন খুলে সহায়তা করে। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক মানুষকে বেছে নেয়া বা খুঁজে বের করা।

দোকানদার তার দোকানের ফ্রিজ থেকে একটা ইলিশ মাছ বের করে নিয়ে- মাছটি হাতে করে আমার গাড়ীতে এসে বসলেন। বললেন, চলেন আমার বাড়ীতে। রাতে ওখানেই থাকবেন।

গ্রামের বাড়ী। ছোট একটা ঘর। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড়ও। গাড়ীটি বাড়ী পর্যন্ত যেতে পারছে না। কাচা মাটিতে চাকা দেবে যাচ্ছে। দোকানদার এর হাতে ছাতা ছিল, ওনি একজন একজন করে ছাতার নীচে নিয়ে আমাদের সকলকে তার ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
তার স্ত্রীকে মাছটি দিয়ে বললেন, ওনারা ঢাকা থেকে এসে বিপদে পরে গেছে। মাছটা রান্না কর। রাতে তাদের খেতে হবে। ঘুমানোর ব্যবস্থা কর।

ছোট্ট ঘরের ভেতরে একটা চৌকি পাতা। সেখানে বসেই ইলিশ মাছ ভুনা দিয়ে গরম গরম ভাত খেলাম। বৃষ্টি, ঝড় বাড়ছেই।

খাওয়া শেষ, মোবাইল অফ করে ঘুমিয়ে পরলাম।বাড়তি বোনাস হিসাবে এনজয় করলাম টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ।

সকাল সাতটার দিকে আমাদের ঘুম ভাংলো। ঝর-বৃষ্টি থেকে গেছে। আমরা ফ্রেস হলাম। হালকা নাস্তা ও চা রেডী। খেয়ে নিলাম। খবর নিলাম সাড়ে আটটায় ফেরী ছাড়বে।

দোকানদার ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তার ছেলে নাঈম এর হাতে দুটি পাঁচশ টাকার নোট দিলাম; লাজুক ছেলেটি নিতে চাচ্ছিল না।

গল্পটা বলার একটাই উদ্দেশ্য ছিল।
যা ঘটার সেটা ঘটবেই। আমাদের শুধু ঘটনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মাথা, যুক্তি খাটিয়ে।

   Send article as PDF