বহুভাষী মানুষ

আপনি যখন প্রথমবার কোলকাতায় যাবেন, তখন প্রথমেই যে বিষয়টা আপনার চোখে আটকে যাবে সেটা হলো, প্রচুর সংখ্যক সাদা চামড়ার (হোয়াইট) মানুষ (টুরিস্ট) দেখতে পাবেন। সেই সংগে বহুভাষাভাষি একটি শহর বলেই মনে হবে কোলকাতাকে।

বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগে।
একই জায়গাতে দেখতে পাবেন কেউ উর্দূতে কথা বলছে, কেউ বা হিন্দিতে, বাংলায় বা কোলকাতার বাংলাও শুনবেন; এছাড়া পর্যপ্ত সংখ্যক মানুষকে ইংলিশেও কথা বলতে দেখবেন।

আপনি আরও বেশী মজা পাবেন যদি আপনি কোলকাতার বাইরের কিছু এলাকা ভ্রমণ করে লোকল পিপলদের সংগে কথা বলার সুযোগ পান। আপনি দেখতে পাবেন উত্তর বা দক্ষিন ২৪-পরগনার মানুষ কেমন ভাষায় কথা বলছে এবং তাদের ফুড হ্যাভিট কেমন, অবাক হয়ে দেখবেন মেদেনীপুরের মানুষদেরও (শেখ মুজিবের আদর্শ গুরু সোহরায়ার্দী সাহেব মেদেনীপুরের সন্তান); বিরভূম, হলিদিয়া, আসানসোল, ধনবাদ, বর্ধমান, এমনকি পাটনার বাংলাও আনন্দ দেবে আপনাকে; দেখতে পারেন মালদা (রাজশাহীর সংগে মিলে যাবে), শিলিগুড়ি, গৌহাটির বাংলাও।

আমি যে শহরটিতে বসবসা করি, সেটা এই পৃথিবীর সবচে সমৃদ্ধ বহুভাষী মানুষের শহর।

নিউ ইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোতে এই পৃথিবীর ১৯২ দেশের মানুষ বসবাস করে এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আপনি যদি বাংলা ছাড়া অন্য দ্বিতীয় কোন ভাষা না জানেন- এই শহরে চলতে আপনার তাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না। নিউ ইয়র্কের প্রতিটি সরকারী অফিস, আদালত, এমনকি হসপিটালেও বিশ্বের যে-কোন ভাষায় কথা বলা যায়।

কেউ যদি ইংলিশে কথা বলতে না চায়, তাহলে সরকারীভাবেই ‘ইন্টারপ্রেটার’ দেয়া হয় নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য।

একদিনের একটি মজার গল্প বলি।
আমি হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পরাতে পেসবেটেরিয়ান কুইন্স হসপিটালে যাই। অপেক্ষা করছিলাম, সেখানে চাইনিজ (এশিয়ান) চেহারার একটি লোক অসুস্থ হয়ে এসেছে। সে ইংলিশ জানে না, এমনকি সে চাইনিজও জানে না। তাকে নিয়ে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পাগল হবার দশা। তার বলা ভাষা কোনভাবেই কেউ বুঝতে পারছে না। তাকে যে ইন্টারপ্রেটার দেয়া হবে সেটা কোন ভাষার ইন্টারপ্রেটার দিবে সেটাই যদি না বোঝা যায় তাহলে আর কি করা?

কিন্তু হসপিটাল কর্তৃপক্ষও নাছোরবান্দা, তারা তাদের রোগীর সর্বোচ্চা সেবা দিবেই।

যাই হোক, আমি অসুস্থ অবস্থাতেই বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওর কথোপকথন থেকে কোন একটি ওয়ার্ড ধরতে পারি কি না- যেহেতু চায়না নিয়ে আমার বিস্তার অভিজ্ঞতা রয়েছে- কিন্তু আমিও ফেল।

অবশেষে একজন চাইনিজের সহযোগীতায় জানা গেল সে ক্যান্টনিজ এর একটি উপগোত্রীয় ভাষায় কথা বলছে এবং তাকে ঠিকই এক পর্যায়ে ইন্টারপ্রেটার সংযোগ দেয়া হলো এবং তার চিকিৎসা নিশ্চিত করা হলো।

আমাদের ঢাকা শহরে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসেই হুংকার ছেড়েছিলেন, ‘বাংলাদেশে বসবাস করতে হলে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে হবে। অবাঙালী যারা আছো হয় তোমরা বাংলা শিখে বাঙালী হয়ে যাও, নয়তো বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাও।’

হলোও তাই। বাংলাদেশে অবাঙালী খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
সকলেই এদেশে বাংলা বলে। কোলকাতায় গেলে আপনি দেখতে পাবেন, বিশেষ করে ব্লাংকিং ষ্ট্রিট এ দেখবেন প্রচুর সংখক চাইনিজ বসবাস করছে যদিও তারা চাইনিজ ও বাংলা দুই ভাষাতেই পারদর্শী। তারা মুলত জুতা তৈরী করে। একসময় কোলকাতার টানা রিক্সা চালাতো চাইনিজরাই, পরে বাঙালীরা তাদের জায়গাটা দল করেছে। অবশ্য বর্তমানে কিছু বিহারাীও রিক্সা চালায়।

আপনি কি জানেন, ৮০র দশকের আগেও বাংলাদেশের চট্রগ্রামে প্রচুর সংখ্যক চাইনিজ বসবাস করতো। নাহ, এখন আর কাউকে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবেন না- সকলেই চলে গেছে। যেসহ আটকে পড়া বিহারী বাংলাদেশে ‘পাকিস্তানী’ হিসাবে বসবাস করছে- তারাও আস্ত আস্তে উর্দূ ভুলে বাঙালী হয়ে যাচ্ছে। আর একটা বা ২টা প্রজন্ম পরেই দেখা যাবে ওরা আর উর্দূ বলছে না; বাঙালী হয়ে গেছে পুরোদুস্তর।

এখনও বাংলাদেশের সিলেট, চট্রগ্রাম, হিলট্রাকস, নোয়াখালী, কক্সেসবাজার আর বরিশালে ‘অবাঙালী’ আঞ্চলিক ভাষায় (যা মুলত বাংলা ভাষারই গোত্রভুক্ত) কথা বলতে শুনবেন। আপনি যদি ঐ অঞ্চলগুলোর অধিভুক্ত না হয়ে থাকেন- তাহলে আপনি তাদের ভাষা বুঝতে পারবেন না (অবশ্য যদিও নোয়াখাইল্যা ও বরিশাইল্যা ভাষা দুটো টুকটাক বোঝা যায়; কিন্তু বাদবাকী ভাষাগুলি বুঝা অসম্ভব)।

সমস্যা হলো সরকারীভাবে বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষার পরিচর্যা করা হয় না।

বাংলাদেশে প্রচুর চাকমা, রাখাইন, মারমা, গারো, সাওতাল, ত্রিপুরাসহ সিলটি, চাটগাইয়া, নোয়াখাইল্যা, বরিশাইল্যা মানুষ নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন যদিও কিন্তু তারা যখনই ‘মেইন-ষ্ট্রিম’-এ আসেন তখন তারা আর নিজেদের ভাষায় কথা বলেন না। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেন।

আসলে এসব আনন্দ উপভোগের জন্য একটু ভিন্ন দৃষ্টিভংগি প্রয়োজন হয়; আমাদের শেখ সাহেবের সেটা ছিলো না; তিনি সংকীর্ণ দৃষ্টির মানুষ ছিলেন। বহু ভাষাভাষী বা বৈচিত্রতা তার অপছন্দনীয় ছিল।

বাংলাদেশের উচিৎ প্রতিটি ক্ষুদ্র আঞ্চলিক ভাষাকেই পরিচর্যা করা।

কোন কিছুই হারিয়ে যেতে দিতে নেই।
একটা সময়ে এসে সবকিছুই কাজে লাগে, সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ।

   Send article as PDF