‘ল্যান্ড অফ অপরচুনিটিস’

আমি যখন কমপিউটার শিখি, সেটা সেই ১৯৯৩ সালের হিষ্ট্রি- তখন ছিল ওয়ার্ড পার্ফেক্ট, লোটাস ১২৩ ও ডিবেস ফোর এর যুগ। হার্ড ড্রাইভের প্রচলন তখনও সেভাবে ছিল না। সোয়া পাঁচ ইঞ্চ ডিক্স দিয়ে ৮০২৮৬ কমপিউটারটি চালাতে হতো।
 
আমাদের ইন্সট্রাকটর কাম মালিককে আমরা বস বলতাম। আমার সংগে ওনার বেশ ভালো একটা রিলেশন ডেভেলাপ হয়ে গেল।
 
কমপিউটার স্কুলটি ছিল ঢাকার নবাবগঞ্জে। কেরানীগঞ্জের জিনজিরা থেকে তখন বান্দুরা পর্যন্ত বাস চলতো। সেখানে দুই টাইপের বাস চলতো। ষ্টিল-বডির মিনিবাস এবং কাঠ-বডির বড় বড় বাস। ষ্টিল-বডির বাসগুলি দেখতে সুন্দর, ঝকঝকে। আর কাঠ-বডি তো মুড়ির টিন মার্কা বাস।
 
একদিন সেই বস আমাকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করলেন। ‘তৌফিক সাহেব- আপনার কি ষ্টিল-বডি বাসগুলি ভাল লাগে না কি কাঠ-বডিগুলি?’
 
আমি হেসে দিলাম; কোন কিছু না ভেবেই বললাম, ‘কেন? ষ্টিল-বডিগুলি। ওগুলি দেখতে কত সুন্দর।’
 
বস ব্যারিষ্টার মওদুদ মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে কিন্তু কাঠ-বডিগুলিই বেশ দারুন লাগে’।
 
সত্যি বলতে কি- আমি ওনার রুচি-জ্ঞান দেখে কিঞ্চিত আহত হলাম। সরাসরি হেসে দিয়েই বললাম, ‘আপনার রুচি তো সুন্দর না’।
 
ওনিও হেসে দিলেন। বললেন, ‘ষ্টিল বডি বাসগুলিতে ম্যাক্সিমাম ৩০-৩৫ জন যাত্রী উঠতে পারে; অপরদিকে দেখেন কাঠ-বডি বাসগুলিতে ৭০-৭৫জন যাত্রী এক সংগে যেতে পারে। তাহলে আমার কোনটা পছন্দ করা উচিত? বাসের ব্যবসা করলে আমিতো ঐ কাঠ-বডিগুলিই কিনবো। তাই না?’
 
আমি ওনার কথায় কতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম সেটার প্রমাণ হলো- আজ ২৩ বছর পরও এক মুহুর্তের জন্য ওনার সেদিনের সেই কথাটা ভুলিনি। অথচ ওনার নামটা ভুলে গেছি!
 
আমার সংগে বিচিত্রভাবেই অনেক লোকজনের পরিচয় হয় এবং পরিচিতদের মধ্যে যাকে যাকে আমার ভাল লাগে তাদের সংগে পরিচয় থেকেই হয়ে যায় ঘনিষ্ঠতা। নিউ ইয়র্কে আসার পর মাহমুদ নামে এক ভদ্রলোকের সংগে আমার পরিচয়। ভদ্রলোক নিজ থেকে আমার সংগে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এক পর্যায়ে লোকটাকে আমার ভাল লাগতে শুরু করলো এবং কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হলোও।
মাহমুদ ভাই একটা আমেরিকান রেষ্টুরেন্টে জব করেন। রেষ্টুরেন্টটির মালিক একজন জুইস, বয়স ৮৬-৮৭ হবে। এই বুড়ো বয়সেও ওনি একটা স্পোর্টস কার ড্রাইভ করে তার রেষ্টুরেন্টে আসেন।
 
মাহমুদ ভাইয়ের স্যালারী ১২ ডলার/ আওয়ার; সংগে ওভারটাইম দেড়গুন মানে ১৮ ডলার/ আওয়ার। মাহমুদ ভাই যে কাজটা করেন সেটা হলো ওনি টানা ১৮ ঘন্টা থেকে ২৪ ঘন্টা কাজ করেন বেশী ওভারটাইম এর আশায়; তারপর একদিন ফুল রেষ্ট নেন- এরপর আবার ১৮-২৪ ঘন্টার স্ক্যাজুয়াল নেন। এর বাইরেও দৈনিক তিনি টিপস পান প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ডলার। এতে করে তিনি সপ্তাহে প্রায় ৮০০ ডলার স্যালারীসহ আরও প্রায় ৫০০ ডলার টিপস পেয়ে থাকেন। মানে, এই সামারে তার সাপ্তাহিক আয় প্রায় ১৩০০ ডলার। যেটা নিঃসন্দেহে অনেক। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশীরা গড়ে সপ্তাহে ৪০০ ডলারের বেশী খুব একটা ইনকাম করে না- অড জব করে। শুধুমাত্র যারা ইয়েলো ক্যাব কিংম্বা ‘উবার’ ড্রাইভ করে তারাই সপ্তাহে ১৫০০ ডলায় আয় করতে পারে।
 
আমি আসলে মাহমুদ ভাইয়ের কথা বলার জন্য তাকে টেনে আনিনি- আমি বলতে চাচ্ছি তার মালিকের রেষ্টুরেন্টেটার কথা। ঐ রেষ্টুরেন্টেটির মুল কাষ্টমার হলো হোয়াইটরা। রেষ্টুরেন্টেটি সিটি আইল্যান্ডে অবস্থিত। সিটি আইল্যান্ডটা ব্রঙ্কসের ওর্চার্ড বীস সংলগ্ন একটি দ্বীপ। রেষ্টুরেন্টটি সাড়া বছরই চালু থাকলেও মূলতঃ সামারেই রমরমা ব্যবসায় করে।
মাহমুদ ভাইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ঐ রেষ্টুরেন্টের সাদা ক্রেতারা এক এক পরিবার এসে প্রায় ৪০০ থেকে ৭০০ ডলার পর্যন্ত খাবার খান ও পার্সেল করে নিয়ে যান। এবং ঐ রেষ্টুরেন্টটিতে সামারে দৈনিক বিক্রি এভারেজে ১০০ হাজার ডলার।
 
১০০ হাজার ডলার যদি সেল থাকে- নিউ ইয়র্কে; তবে চোখ বন্ধ করে হিসাব করা যায়- প্রতিদিন সব খরচ বাদে ঐ রেষ্টুরেন্টের নেট ইনকাম ৬০ হাজার ডলার। মাসে ১.৮ মিলিয়ন ডলার।
 
– কী! মাথা ঘুড়ে গেল!!
 
আরেকজনের কথা বলি।
এইট গ্রেডের ক্লাস চলছে। টিচার ক্লাসে ঢুকলেন। সকলকে তার দিকে গভীরভাবে খেয়াল করতে বললেন। একটি সাদা এ-ফোর সাইজ পেপার নিলেন। তারপর সেই পেপারটির ঠিক মাঝখানে একটি ছোট বিন্দু আঁকলেন।
 
অতপর সেই কাগজটি উুঁচ করে ছাত্রদের দিকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন- ‘এটা কি?’
 
ছাত্ররা সবাই সমস্বরে উত্তর করলো- ‘স্যার ওটা একটা বিন্দু’।
 
স্যার বিরক্ত হলেন।
বললেন, ‘তোমরা এত বড় কাগজটা তোমাদের চোখে পড়লো না- ক্ষুদ্র বিন্দুটাকে দেখলে?’
 
সেদিনের ঐ ক্লাসেরই একজন ছাত্র; যাকে আমরা সবাই চিনি এক নামে- তিনি কফি আনান। ইউনাইটেড ন্যাশনস এর সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল ঘানার ব্লাক ম্যান ‘কফি আনান’।
 
আমি মাঝে মধ্যেই ম্যানহ্যাটনের টাইমস স্কোয়ার এর বিভিন্ন গল্প করি।
‘টাইমস স্কোয়ার’ এই পৃথিবীর সবচে প্রাণবন্ত অথবা জীবন্ত একটা জায়গা। যেখানে গেলে- ৮০ বছরের বৃদ্ধও ২৫ বছরের যুবক হয়ে যেতে বাধ্য!
 
একটা সময় মূলতঃ ম্যানহ্যাটন-কেই বলা হলো নিউ ইয়র্ক। পরবর্তীতে আয়োতন বৃদ্ধি করে আরও ৪টি বরো (কুইন্স, ব্রুকলীন, ব্রঙ্কস ও স্ট্যাটান আইল্যান্ড) নিউ ইয়র্কের সংগে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তারপরও ‘ম্যানহ্যাটন’কে-ই এখনও ‘নিউ ইয়র্ক সিটি’-ই বলা হয়।
 
যা-ই হোক; এই টাইমস স্কোয়ার-এ ই আমার নতুন অফিসটি অবস্থিত।
আমার অফিসটির মালিক একজন জুইস; ওর নাম জোদা শোরোর। ছেলেটার বয়স বড়জোর ২৭-২৮ হবে। ভয়াবহ রকমের স্মার্ট একটি ছেলে। ওর সংগে দেখা করার আগে আমি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর ৮৫ তলায় একটি অফিস দেখতে গিয়েছিলাম। আমার হাতে তখনও সেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অফিসের ক্যাটালগ।
জোদা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওটা কি?’
আমি বললাম, ‘এটা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অফিস সুইটের ক্যাটালগ’।
জোদা হেসে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ওটা কষ্ট করে হাতে রেখেছো কেন? আমার কাছে দাও- আমি গার্বেজ করে দিই।’
আমিও হেসে দিলাম, ওটা ওর হাতে দিয়ে বললাম- ‘থ্যাকংস আমার পরিশ্রম একটু কমিয়ে দিলে!’
 
বলে রাখি- ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নিঃসন্দেহে নিউ ইয়র্কের সবচে ‘প্রেষ্টিজিয়াস বিল্ডিং’ বাট, সেখানে রয়েছে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি রকমের নিরাপত্তা এবং উচ্চ মুল্য; ঐ বাড়াবাড়ি নিরাপত্তাকে অনেকেই ভয় করে- বিশেষতঃ আমার বাংলাদেশী কাষ্টমাররা।
 
আমার হিসাবেও টাইমস স্কোয়ারই ভালো। এবং সেই ভালোর সুফলও পাচ্ছি, আলহামদুলিল্লা।
 
যা বলছিলাম। জোদা শোরোর। টাইমস স্কোয়ারের এই বিল্ডিংটিতে ওর ২৭০টি অফিস সুইট যার ৯৮%ই সবসময় বুকড থাকে। এটা ছাড়াও ম্যানহ্যাটনেই জোদা’র আরও ৬টি অফিস কমপ্লেক্স রয়েছে এবং যেখান থেকে ওর মাসিক রেভিনিউ আসে প্রায় ১.২ মিলিয়ন ডলার। আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি, জোদা’র মাসিক নেট আয় ন্যূনতম পক্ষে ৭০০ হাজার ডলার।
 
জোদা’কে যখন ওর হিসাবটা দিয়ে বললাম, ‘তুমি কি কর এত টাকা দিয়ে?’
জোদা হাসলো, সেই হাসিটাও ছিল ব্যারিষ্টার মওদুদ মার্কা। বলল, ‘দেখ আমার সংগে আরও অনেক ইনভেস্টর রয়েছে। আমি একা তো আর মালিক না!’
 
জোদা শোরর এর দেশের বাড়ী লেবানন; ওর কাছেই জানলাম লেবাননে প্রচুর সংখ্যক জুইস রয়েছে; ওর মাতৃভাষা আরাবিক। ও লেবানন থেকে মাত্র ৭ বছর আগে আমেরিকায় এসেছে এবং এই ব্যবসায়টা শুরু করেছে পাঁচ বছর চলছে।
 
এজন্যই আমেরিকাকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অফ অপরচুনিটিস’।
   Send article as PDF