আটকে যাওয়া ভালবাসা

আজ সারাটা দিন ছিল শুক্রবার, ওহ না সরি, রবিবার।
ইদানিং রবিবার’টা আমার কাছে শুক্রবার শুক্রবার মনে হয়।
 
দেশ ছেড়েছি প্রায় ৩ বছর হতে চলল।
বাঁ-দিক দিয়ে চলা গাড়ীর রাস্তার হিসাব ডান-দিকে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছি কিন্তু ‘রবিবার’টা এখনও শুক্রবার শুক্রবারই মনে হয়।
 
বাংলাদেশ তথা ঢাকায় বসবাসকালে আমি সাধারণত ‘অলস সময়’ পাইনি কখনও। সাতদিনই কাজ করতাম। শুক্রবার কিংম্বা শনিবার কাজের চাপ কমাতে পারলে চলে যেতাম আউটিং-এ। বেশীর ভাগ সময় যেতাম গ্রামের বাড়ীতে ফিরতাম মধ্য রাতে।
 
অার তা না হলে চলে যেতাম মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, মাওয়া, কুমিল্লা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ অথবা যমুনায়- যখন যেদিকে মন চায়। সারাদিনের ট্যুর। দুপুরে রাস্তার পারে গ্রামীন কোন ‘টং রেস্তরা’য় খেয়ে নিতাম সস্তা ডাল-ভাত মাছ মাংস যা পাওয়া যায়।
 
ফেরার পথে রাস্তার পাড়ে বসা হাট-বাজার থেকে তাজা মাছ, সবজী যা পাওয়া যেত কিনে বাড়ী ফেরা।
 
সন্ধ্যার অন্ধকারে কোন গ্রামীন বাজারে গাড়ী থামিয়ে নেমে পড়তাম ‘গরুর দুধের তৈরী এক কাপ চা’ খাবার লোভে।
 
রাস্তায় দাড়িয়ে ঐ এক কাপ গরুর দুধের চায়ে ঠোট লাগিয়ে আমি উপভোগ করতাম প্রিয় বাংলাদেশ। যা এই পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।
 
ফিরে এসে রাতে কমপিউটারে বসে ফেসবুকে দিনের সেরা ছবিটা পোষ্ট করে হেডিং দিতাম ‘দিস ফ্রাইডে’।
 
সেই দিনগুলি আর নেই।
এই তো সেদিন এর কথা। তিনটি বছরও এখন পর্যন্ত পার হয়নি।
 
এবং দুই এক মাস পর পর কোন একটা শুক্রবারকে বেছে নিতাম আমার ‘ব্যক্তিগত হলিডে’ হিসাবে যেটাকে সোজা বাংলায় ‘আমার ঘুম দিবস’ বলাটাই শ্রেয়। দুপুরে জুম্মার বিরতী দিয়ে আবার ঘুম।
 
ঘুম ভাংতো সেই সন্ধ্যায়।
ঘুম শেষ করে মনে হতো ‘সম্পূর্ণ রিচার্জ’ হয়ে গিয়েছি। আবারও একটানা মাস দুয়েক কাজ করতে পারবো।
 
আমেরিকা আসার পর আমার কাজের চাপ অনেক কমে গেছে। সারাদিন সর্বোচ্চ দু’ঘন্টা কাজ করলেই আমার বেশ চলে যায়। বাসা থেকে টাইমস স্কোয়ারে অফিসে পৌছতে সময় লাগে গড়ে ৫০ মিনিট ফিরতে ৫০ মিনিট। যতক্ষন মন চায় অফিস করি।
 
সময়ের সজবলভ্যতায় লেখা-লেখি করি।
 
সকালে দেরী করে উঠার একটা বিশ্রী অভ্যাস প্রায় হয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ইদানিং অনেকটাই ত্যাগ করতে পেরেছি। তবে গত তিন বছরে ‘আমার ঘুম দিবস’ বিষয়টা আমা-থেকে হারিয়েই গিয়েছিল।
 
আজ সারাদিন ঘুমালাম।
একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ঘুম দিবস পালন করলাম অনেক বছর পর।
 
নিউ ইয়র্কের সামার শেষ হতে চলছে। মাস খানেক আগেও সূর্য ডুবতো রাত সাড়ে আটটার দিকে, এখন সোয়া সাতটাতেই মনে হয় সন্ধ্যা চলে আসে। গত রাতে বাসায় ফেরার পথে মনে হচ্ছিল ‘শীত’ সম্ভবত তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে- হালকা শীতের আভাস পাচ্ছিলাম যেন।
 
গতকাল সাবওয়েতে (স্কাইওয়ে) যাবার সময় গাছের সবুজ পাতাগুলিতে লালচে লক্ষ্যন আমার চোখ এড়ায়নি। পরিস্কার ওয়েন্টারের আগমনী বার্তা সেটা।
 
মনে পড়ে গেল বাংলার গ্রামের সেই ছোট বেলার কথা।
ভাদ্র মাসে আমাদের দেশে নৌকা বাইছ হতো, ঠিক আমাদের বাড়ীর সামনেই ছোট একটা নদী বয়ে চলছে। নাম তার ইছামতি।
 
অবশ্য ইছামতি নামে প্রায় ১৩৮টা নদী রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ মিলিয়ে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ‘ইছামতি’ কোন নদীর নাম না। একটু কম ছোট খালকে-ই সম্ভবত মানুষ ইছামতি নামে ডাকতে পছন্দ করে।
 
হরিদাসপুর (বেনাপোল-পেট্রাপোল) পাড় হয়ে রিক্সা নিয়ে বনগাঁ যাবার সময় প্রথম যে ছোট একটা ব্রীজ পাড় হতে হয়- সেই নদীটার নামও ইছামতি।
 
যাই হোক, যা বলছিলাম, ভাদ্র মাসে আমাদের দেশের সেই ছোট্ট ইছামতি নদীটিতে নৌকা বাইছ দেখতাম। নদীগুলির তখন ভড়া যৌবন, জল তার উপচে পড়ছে। আমার কাজ ছিল সারাদিন নৌকা নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানো।
 
ছোট ঐ নৌকাকে বলা হতো ‘কুশা নাও’- আমি দারুণ চালাতে পারতাম। আমার দিন কাটতো বলতে গেলে সেই কুশা নাও-এ।
 
কি যে অপরূপা সেই নদীর দু’পাড়ের দৃশ্যগুলি। সেই সৌন্দর্যের কাছে এই কৃত্রিমতায় ভরপুর বিশ্বের অবস্থান ১০ এ মাত্র ১।
 
ভাদ্রের শেষটায় নদীগুলি খালি হয়ে যেত।
আমাদের গ্রামের মাঠটিতে বোনা হতো কালাই। কালাই শাকগুলি আস্তে আস্তে পূর্ণ হতো। ক্রেতারা কেটে নিয়ে যেত কালাই। কেউ বা গরু নিয়ে এসে সেই কিনে নেয়া কালাই খাওয়াতে তাদের গরুকে।
 
নৌকা আর চালানো হতো না- জল নেই।
 
তখন আমার কাজ হতো গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটা চলা। কখনও শুকিয়ে আসা নদীর পাড় দিয়েও হাঁটতাম।
 
ঠিক তখনই কোন একদিন হঠাৎই মনে হতো শীত আসছে।
শীত হলো বাংলাদেশের ভাল লাগার ঋতু। আর নিউ ইয়র্কের সামার। ঠিক উল্টা।
 
এখানকার ওয়েন্টার জঘন্য। বিরক্তিকর। খুবই যন্ত্রণাদায়ক।
আর বাংলাদেশের শীত মানেই পিকনিক, আনন্দময় চলা, ফ্যাশন, জ্যাকেট, মাফলার, চাদরমুড়ি দিয়ে ভোরে খেজুরের রস খাওয়া, অথবা বিকেলে এক কাপ রসের চা।
 
বেলা চার’টায় ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাটি করলাম।
 
বাসায় ফিরে ফেসবুকে লগিন করে ইনবক্সে জানতে পারলাম আমার ভাগনী বাসা চেঞ্জ করেছে মিরপুর ১১তে।
 
মিরপুরের কথা খুব মনে হলো। মিস করা শুরু করলাম ঢাকা শহরকে।
গুগলে আর্থে ঢুকে মিরপুর ১১র রাস্তায় গেলাম।
 
সেই শ্রীহীন রাস্তা, উদভ্রান্তের মতো লক্ষ্যহীন, শৃঙ্খলাহীন, সিষ্টেমহীন একটা রাস্তা, দু’পাশের ভবন, দোকান-পাঠগুলির দৈন্য দশা। ফুটপাতের ‘পাত’-ই নেই।
 
ছবি দেখেই সেই ‘ভেপসা গরম’ এর কষ্টকর সময়গুলির কথা মনে পরে গেল।
ইলেকট্রিসিটি নেই, গ্যাস নেই, পানি নেই, হরতাল! ওহ্ মাই গড!
 
ডাষ্টগুলি উড়ছে, রাস্তায় রিক্সা, মোটর সাইকেল, সাইকেল, সিএনজি, রং উঠে যাওয়া বাস, কাভার্ড ভ্যান আইন মানার কোন বালাই ছাড়া চলছে আর চলছে।
 
সরু ফুটপাতে উঠে যাচ্ছে মোটরসাইকেল! কখনও সখনও রিক্সাও। রাস্তায় দাড়িয়ে উম্মুক্ত স্থানে প্রস্রাব করছে ‘সভ্য বাঙালী’।
 
ভাংগা চড়া, বসবাসের অনুপযুক্ত একটা শহর।
 
অথচ কতটা ভালবেসে এই শহরেই বসবাস করছে এক কোটি সাধারণ মানুষ। তারা হয়তো জানেও না এই পৃথিবীটা কতটা সুন্দর, কতটা সুশৃঙ্খলতায় ভরা।
 
আমি নিজেও এই শহরেরই একজন বাসিন্দা ছিলাম এই তো সেদিনও, তিন বছর এখনও হয়নি।
 
সম্ভবত দীর্ঘ প্রায় ৪০ মিনিট ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম আমার ফেলে আসা পান্থপথ, গ্রীনরোডের সেই রাস্তাগুলি, দোকান পাট, ভবন, হেলথ এন্ড হোপ হসপিটাল, ফিরোজ টাওয়ার, কনসেপ্ট টাওয়ার।
 
কতটা ভালোবাসা জমে রয়েছে এই নোংড়া শহরটির জন্য- বুঝতে পারলাম চোখে পানি জমে গেছে দেখতে পেয়ে।
 
চোখ মুছলাম টিস্যু দিয়ে।।
এই ঢাকার সংগে আমার ভালবাসা দীর্ঘ ২০ বছরের।
 
নিউ ইয়র্ক আমাকে উন্নত জীবন-পরিবেশ দিয়েছে, সভ্যতা শিখাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, টেনশন ফ্রি নিরাপদ চলাফেরার ভরশা দিয়েছে, পকেটে টাকা থাকা না থাকার তোয়াক্কা না করে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিয়েছে কিন্তু আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে পেরেছে কি?
 
কিছু না দিয়েও ভালবাসা ধরে রাখা যায়!
ঢাকা তা শিখিয়েছে।
 
   Send article as PDF