কর্ণেল তাহের চাপ্টার

প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে তার শত্রুরাও একমত যে তিনি অত্যন্ত সৎ জীবন-যাপন করতেন।
 
এটা অনেক পুরোনো কথা।
কিন্তু তার শত্রুরা যে কথাটা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে তার বিরুদ্ধে বলে থাকেন তা হলো জেনারেল জিয়া শতশত সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন।
 
এবং তারচেও বড় অভিযোগটি তাঁর সম্পর্কে ‘যে কর্ণেল তাহের তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন সেই কর্ণেল তাহেরকেই তিনি হত্যা করেছেন’।
 
জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত তার দেয়াল উপন্যাসে এই কথাটিকেই অত্যন্ত স্বরলীকরণ করে বলে দিলেন-
‘কর্ণেল তাহের তাঁর অনুগত সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে সিপাহী বিপ্লবের সূচনা করেন। সিপাহীরা গগনবিদারী স্লোগান দিতে শুরু করল- ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ’। কর্ণেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে আবেগমথিত কন্ঠে জিয়া বললেন, বন্ধু! তোমার এই উপকার আমি কোনদিনই ভুলব না।
জেনারেল জিয়া কর্ণেল তাহেরের উপকার মনে রেখেছিলেন কি না তা আমরা জানি না, তবে তিনি যে কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন তা আমরা জানি।
 
দুঃখিনী বাংলাদেশের প্রদীপসম সন্তানেরা একে একে নিভে যেতে শুরু করল।’
 
আমি বিএনপি’র নেতা-কর্মী বা জিয়া-পন্থী কাউকে কোনদিন কর্ণেল তাহের প্রসংগে কোন কথা বলতে শুনিনি। তারা বরাবারই ‘কর্ণেল তাহের’ প্রসংগে নীরব।
 
আর আমরা তো জানিই যে ‘নীরবতা সম্মতির লক্ষ্যন’।
 
তার মানেটা দাঁড়ালো, ‘সুবোধ বালক কর্ণেল তাহের নিজেই জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছেন এবং কোন কারণ ছাড়াই জেনারেল জিয়া কর্ণেল তাহেরকে হত্যা করেছেন’।
 
এবং দেশবাসী এটা মেনেও নিয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু নিজেরা কষ্ট করে পড়াশোনা করে না সেহেতু যে-যা বলে দেয় সেটাই তারা বুঝে ফেলে। ইভেন চিলে কান নিয়ে গেলেও আগে কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছন পেছন দৌড়ায়।
 
কিন্তু আমি যে চিলের পেছন দৌড়ানো মানুষ না- তাই মেনে নিতে পারলাম না।
 
ঘাটাঘাটি করা শুরু করলাম, কর্ণেল তাহের সম্পর্কে। এবং কেন জেনারেল জিয়া কর্ণেল তাহেরকে হত্যা করেছেন। কেন জেনারেল জিয়া নামের আপাদ-মস্তক দূরদর্শি সৎ লোকটি হাজার হাজার সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন।
 
অনেকের সংগেই আমি ‘বিষয়টা’ নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনাও করেছি কিন্তু কেউ আমাকে ‘স্যাটিসফেকটরী এনস্যার’ দিতে পারেননি।
 
যাই হোক এর মধ্যেই বেশকিছু বই এবং তথ্য ঘাটাঘাটি করলাম।
 
রক্ষীবাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ মুজিব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংশ করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব সেনাবাহিনীতে অসংখ্য বিভক্তি উসকে দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনী এমনকি পুলিশেরও চেয়ে নিচে নামিয়ে দিয়েছিলেন।
 
পুলিশ পর্যন্ত সেনাসদস্যদের দু’পয়সার পাত্তাও দিত না। কারণ সেনাবাহিনীর না ছিল ক্ষমতা, না ছিল ভালো পোষাক-অস্ত্র আর না ছিল চিইন-অব-কমান্ড।
 
এরকম একটা জগাখিচুরী বাহিনীর শুধু নামই থাকে- কেউ শ্রদ্ধা করতো না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও সেনাবাহিনীকে পরোয়া করতো না বরং উল্টো কোন কোন সেনা অফিসারকে আওয়ামী নেতাদের তোয়াজ করতেও দেখা যেত।
 
১০ থেকে ১২টা গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছিল সেনাবাহিনীতে।
অনেকগুলো গ্রুপই শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য চেষ্টা করেছে। পুরো সেনাবাহিনীই শেখ মুজিবের উপর ক্ষিপ্ত ছিল।
 
জেনারেল শফিউল্লাহর মতো কয়েকজন নপুংসক এবং শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত ও অতিভক্ত কিছু অফিসার ছিল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে। শেখ মুজিবের ধারণা ছিল শুধুমাত্র উচ্চাপদস্ত সেনা অফিসাররাই অভূত্থান ঘটাতে পারে। জুনিয়র অফিসারদের প্রতি শেখ মুজিবের কোন ধারণাই ছিল না।
 
কিন্তু একবুক আশা নিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী দাপুটে সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা রাষ্ট্র কর্তৃক নিজেদের ‘নপুংসকতা’ মেনে নিতে পারেননি বলেই মেজর ফারুকের গ্রুপের হাতে শেখ মুজিব নিহত হয়েছিলেন।
 
কর্ণেল ফারুকের ইচ্ছে ছিল একজন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির হাতে দেশের শাসনভার অর্পন করার। তিনি নিজে বা তার দলের কারো দেশ শাসনের ইচ্ছে ছিল না। শুধুমাত্র দেশের প্রতি একনিষ্ঠ ভালবাসা থেকেই জুনিয়র মেজররা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল।
 
ঐ সময়টাতে সেনাসদস্যদের শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চাওয়টা একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল। অনেক গ্রুপই শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চাইতো। কাজেই মেজর ফারকরা যে খুবই এগ্রেসিভ সেটা কারোরই ধারণা করার সুযোগ ছিল না।
 
শেখ মুজিবকে হত্যার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেবার পর মেজর ফারুক দেশ শাসনের দায়িত্ব নিতে সরাসরি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রস্তাব দিয়ে দেখা করলে জেনারেল জিয়া তা প্রত্যাখান করেন এবং এসব বিষয়ে তিনি আগ্রহী নন বলে জানিয়ে দেন।
 
অত্যন্ত রাগী অফিসার মেজর ফারুক এতে জেনারেল জিয়ার প্রতি ক্ষিপ্ত হন এবং মুজিব হত্যার প্রতিবন্দ্বক হিসাবে পরবর্তীতে এক পর্যায়ে শেখ মুজিবের সংগে জেনারেল জিয়া, খালেদ মোশারফসহ আরও কয়েকজনকেও হত্যা করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছিলেন।
 
মুজিব হত্যায় জেনারেল জিয়ার অনিহার পর মেজর রশিদের প্রস্তাবে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট বানানো হয়।
 
জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর সবচে জনপ্রিয় অফিসার, তার উপর স্বাধীনতার ঘোষনাদানকারী হিসাবে তার ছিল বাড়তি পরিচিতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড ফোর্স এর প্রধান হিসাবেও তার অসীম বিরত্বগাথার গল্প ছিল সাধারণ সেনাদের মুখে মুখে।
 
এখানে একটা বিষয় সকলকে জানতে হবে যে, সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫-১৯৭৫ সালের সময় বা তারও আগে থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের পর জাসদের দারুন জনপ্রিয়তা ছিল। অসংখ্য ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র নেতারা তখন বাম রাজনীতি নিয়েই মেতে থাকতো।
 
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তলনকারী আসম আব্দুর রবরা সেসময়েরই জনপ্রিয় নেতা।
 
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে গণআন্দালনে তখন আসম আব্দুর রব দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন। তাছাড়া মতিয়া চৌধুরী তো শেখ মুজিবের চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছেন অসংখ্যবার আর আজকের মুজিব প্রেমী হাসানুল হক ইনু সেদিন মুজিব হত্যার পর ক্যান্টনমেন্টে সেই গোলাবিহীন ট্যাংকের উপর উঠে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।
 
সেনাবাহিনীর বাইরেও তৎকালীণ জাসদ নেতারাও (কর্ণেল তাহেররা) বেশ কয়েকবার মুজিব হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিজেরা ব্যর্থ হবার পর তারা সেনাবাহিনীকে সমর্থন জুগিয়েছে এই ভরশায় যে- সেনাবাহিনী তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে!
 
যাই হোক, খালেদ মোশাররফ জনপ্রিয় অফিসার জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করে নিজেকের সেনাপ্রধান ঘোষণা করে অভূত্থান ঘটান এবং মেজর ফারুক-রশীদ এর অধীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোসতাককে উচ্ছেদ করার পর ৭ই নভেম্বর সাধারণ সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষনা করে খালেদ মোশাররফ এর বিরুদ্ধে; শুরু হয় সাধারণ সেনা কর্তৃক অফিসার হত্যা। এরই এক পর্যায়ে সাধারণ সৈনিক এবং কর্ণেল তাহেরের জাসদ একজোট হয়ে সিপাহী বিল্পব এর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে তার হাতে কার্যত শাসন ক্ষমতা তুলে দেয়।
 
যে বিষয়টা কেউ উল্লেখই করে না সেটা হলো, মুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ নিযুক্ত হবার পর কর্ণেল তাহের ও তার দল চেয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা কমুনিষ্ট সরকার গঠন করতে। জেনারেল জিয়ার কাঁধে চড়ে তারা এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল মাত্র।
 
কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াকে শুধুমাত্র ‘ব্যবহার’ করতে চেয়েছিল ক্ষমতা গ্রহনের সিড়ি হিসাবে।
 
আর তাইতো সেদিন-ই কর্ণেল তাহের অস্ত্রের মুখে জেনারেল জিয়াকে দিয়ে তাদের ১২-দফা দাবি সংবলিত কাগজটি সই করিয়ে নেন, জিয়া বাধ্য হয়েছিলেন সেই কাগজে সেদিন সই করতে। জিয়াউর রহমানের হাতে কর্ণেল তাহেরের হাতে মুত্যু ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা ছিল না।
 
এবং, সেদিনই কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াকে বাধ্য করেছিলেন দ্বিতীয় দফা রেডিও ভাষন দিতে কিন্তু জেনারেল জিয়া অত্যন্ত সতর্কতা ও কৌশলের সংগে দ্বিতীয়বার রেডিও ভাষন দিলেও সেই ১২ দফার কথা তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেননি।
 
এবং তারপরদিন থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবার জন্য কর্ণেল তাহের এমন কোন কিছু নেই যেটা করেননি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকাকালীণ সময়ে জিয়াউর রহমান কে ২১টি প্রকাশ্য অভ্যূত্থানের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং এই প্রতিটি অভ্যূত্থানই ছিল হয় সেনাবাহিনীর কিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, কখনও মেজর ফারুক-রশিদরা এবং বাদ-বাকী সবই কর্নেল তাহেরদের নেতৃত্বে।
 
এখন প্রশ্ন হলো, কর্ণেল তাহেরররা জেনারেল জিয়াকে উত্থাৎ করার চেষ্টা করবে আর জেনারল জিয়া সাধু পুরুষ হয়ে বসে থাকবেন- এতটা আশা করা কি ঠিক?
 
হ্যাঁ। আর তাই তো কর্ণেল তাহেরকে সেনা আদালতে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলানোর কোন বিকল্প জেনারেল জিয়ার ছিল না- যদি তিনি নিজে বেঁচে থাকতে চাইতেন।
 
নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে এবং শেখ মুজিবের দেয়া বিশৃঙ্খল একটা সেনাবাহিনীকে একক নেতৃত্বে আনতে, এবং একটি শক্তিশালী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে- জেনারেল জিয়াকে অনেক কঠোর হতে হয়েছে, ২১টি অভ্যূত্থান তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এরকমই একটি অভ্যূত্থানে তাকে নিহতও হতে হয়েছে।
 
জেনারেল জিয়ার কঠোরতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিল- নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে অসংখ্য নিরীহ অফিসারকেও জীবন দিতে হয়েছে তার ‘ক্ষমতার খেলায়’। আর তাইতো আমরা দেখতে পাই তাকেও ‘হত্যা’ ক্ষমা করেনি। রক্ত রক্তের পেছনেই ছুটে।
 
হুমায়ূন আহমেদ আরও একটি মিথ্যা বেশ সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলেছেন যে, ‘কর্ণেল তাহের তার অনুগত সৈন্যবাহিনীদের …,’ কথটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কর্ণেল তাহের তখন সেনাবাহিনীতেই ছিলেন না- তিনি অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন।
 
আমি হূমায়ূন আহমেদ এর মতো করে সুবোধ বালোকচিতভাবে স্বরলীকরণ করে বলতে অক্ষম।
 
কর্নেল তাহের জিয়ার জান বাঁচাতে যাননি ৭ই নভেম্বর।
জনপ্রিয় ব্যক্তি জিয়াকে মুক্ত করেছিল সাধারণ সিপাহীরাই, তাহের তার দলবল নিয়ে সেখানে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে এবং জিয়াকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের ধান্ধায় ছিল।
   Send article as PDF