নির্বাচন নির্বাচন

আমি কোনদিন রাজনীতি করিনি।
করতে ইচ্ছে হয়নি।
 
বিশেষতঃ যেদিন থেকে রাজনীতি বিষয়টা বুঝেছি তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিকে আমার কাছে সবচে নোংড়ামী মনে হয়েছে; আর দেশীয় রাজনীতিবিদদের ৯৯%কেই মনে হয়েছে সমাজের আবর্জনা।
 
সুতরাং রাজনীতি আমাকে টানে না।
 
সরি, আরও একটা কারণ রয়েছে।
কারণটাও বলে দিই।
 
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মূল ও একমাত্র লক্ষ্যই হলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতাকে উপভোগ করা। আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রয়েছে- নির্বাচন।
 
যে বিষয়টা আমাকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়েছে, তা হলো- ‘নির্বাচন’ ঘনিয়ে আসলে ‘প্রার্থী’দের ভয়াবহ পরিশ্রম করতে হয়- দিবারাত্র নির্ঘুম ২৪। তাও একটানা প্রায় মাসখানেক সময় নিয়ে- ওটা আমার দ্বারা কোন কালেও সম্ভব নয়।
 
আমি আরম প্রিয় মানুষ।
মাথা খাটাতে অনেক আনন্দ পাই কিন্তু শরীর খাটাতে আমার অরূচি হয়।
 
তাছাড়া রাজনীতিবিদদের সবচে মারাত্মক ও চমৎকার গুন হল- তারা একজন মানুষের চেহারা ও নাম- মাত্র একবার শুনেই বছরের পর বছর মনে রাখতে পারে- যা আমার দ্বারা অসম্ভব একটা বিষয়।
 
আমি আমার অতি পরিচিত কোন ব্যক্তিকেও মাস ছয়েক পরে দেখলে ঠিক-ঠাক মনে করতে পারি না। কাজেই আমি রাজনীতি করলে এবং নির্বাচনে দাড়ালে যে ‘জামানত’ হারাবো- সেটার গ্যারান্টি আমি নিজেই দিচ্ছি।
পাবলিকের কাছে সেটা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না।
 
অথচ, এই আমাকেও একবার বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচনে দাড় করিয়ে দেয়া হল!
 
আচ্ছা। ঘটনাটা প্রথম থেকেই বলি।
চায়নায় গেছি সরকারী ভ্রমণে- অল চায়না ইউথ ফেডারেশনের আমন্ত্রণে। ‘সিনো-বাংলা সম্পর্কের ৩০ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে চায়নিজ গভার্ণমেন্ট বাংলাদেশের ২০ জন ইয়াং সোসাল ওয়ার্কার’কে চায়না ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়।
 
সেটা ২০০৫ এর জুন মাস।
 
কোন এক অজানা কারণে গেন্ডারিয়ার জাকির ভাই আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। জাকির ভাই দু’দুবার বাংলাদেশের শ্রেষ্ট যুব সংগঠক হিসাবে পুরুষ্কার প্রাপ্ত। একবার পুরষ্কার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এবং আরেকবার পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে।
 
জাকির ভাইও আমার মতো রাজনীতি মুক্ত মানুষ তবে পার্থক্য হলো ওনি যদি রাজনীতি ও নির্বাচন করতেন- নিঃসন্দেহে পাশ করতেন; অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারতেন।
কিন্তু কোন লোভ এই নিরাহংকার মানুষটাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি- অন্তত আমি দেখিনি দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতায়।
 
সেই ২০০৫ এর মে মাসের কোন এক দুপুরে জাকির ভাই আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ‘তোমার পাসপোর্ট, দুই কপি ছবি আর পনের হাজার টাকা রেডী রেখ- আমি ২টার দিকে তোমার অফিসে আসবো’।
 
সত্যি বলতে কি আমি একটু হতবাক হলাম।
এবং এর কোন মানে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমি যেহেতু তাকে অসম্ভব সম্মান ও বিশ্বাস করি সেহেতু কোন কিছু না বুঝেই আমার পাসপোর্ট, ছবি আর টাকা রেডী করে রাখলাম।
 
জাকির ভাই আসলেন এবং ওগুলি চাইলেন।
আমি কিছুই জানতে চাইলাম না ঠিক কেন উনি এসব নিলেন- তবে এতটুকু বোঝার মত বুদ্ধি আমার ছিল যে সেটা আমার ব্যক্তিগত লাভের জন্যই ওনি নিয়েছেন। ব্যস্ততায় জাকির ভাই আমাকে কিছুই বললেন না।
 
শুধু প্রশ্ন করলেন, আগামী মাসে দিন দশকের জন্য চায়না যেতে পারবে? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা জাকালাম।
 
সপ্তাহ খানেক পর জাকির ভাই ফোন করে আমার অফিসে আসলেন। পাসপোর্ট দেখলাম- চায়নার ভিসা লাগানো। বললেন জুনের ২৩ তারিখে আমরা চায়না যাচ্ছি। তুমি রেডী থেকে। আর কোন টাকা পয়সা লাগবে না। চায়নিজ গর্ভামেন্টের মেহমান হিসাবে যাচ্ছি; সব খরচ চায়নিজ গর্ভামেন্টই বহন করবে।
 
আমি বরাবরই কৌতহলী।
আর দেশ-বিদেশ ভ্রমণ তো আমার নেশা।
 
ইষ্টার্ণ চায়না’র বাংলাদেশ অপারেশন শুরুর পর ঢাকা-কুনমিং এর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭ বা ২৮ হাজার টাকার মতো। তারা প্রথম ৩দিন সকল যাত্রীদের ৫০% ডিসকাউন্টে এই ভ্রমণটি উপভোগের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমরা প্রথম ৩দিনের একদিন হিসাবে ১৫ হাজার টাকায় রিটার্ণ টিকেট পেলাম।
 
কুনমিং নামটিও আমার কাছে নতুন ছিল।
ঢাকা থেকে মাত্র ২ ঘন্টার যাত্রায় কুনমিং গেলাম।
 
ওখানে ৩দিন আমাদের রাষ্ট্রিয় ভ্রমণ চলছে। আমরা মোট ২০ জন। জাকির ভাই ছাড়া কাউকেই চিনতাম না। অাস্তে আস্তে সকলের সংগেই পরিচিত হলাম। ফাইভ ষ্টার হোটেলে থাকি, ৩ বেলা বুফে খাই।
 
সে এক রাজকীয় আয়োজন- নিজের পকেটের টাকায় এরকম খাওয়া আর ভ্রমণের ক্ষমতা চিন্তাই করতাম না তখন!
 
যাই হোক ওখান থেকে গেলাম সিচুয়ান প্রভিন্সের রাজধানী চেংগদু।
চেংগদু শহরটি অসাধারণ।
 
তবে ওখানে যেতে যেতে যে তথ্যটা জানলাম তা হলো- এই পৃথিবীর সবচে সুস্বাধু এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হলো ‘সিচুয়ান ফুড’।
 
প্রথমদিন দুপুরে সেখানে পৌছানোর পরপরই আমাদের আগে নিয়ে যাওয়া হল একটা রেষ্টুরেন্টে। সেখানে দুপুরের লান্স করলাম।
 
মেনু’র মধ্যে একটা ছিল ‘মুরগীর মাংস দিয়ে বাশের তরকারী’ এবং আরও একটি মজাদার খাবার ছিল পালং শাক ভাজি। পালং শাকটা আমাদের দেশের মতো করেই করা।
 
আর দেশী মুরগীর মাংসের সংগে আমরা যেমন গোল আলু দিই- ওখানে সেটার পরিবর্তে কচি বাশ দেয়া ছিল।
 
দারুন বাশ খেলাম ওদিন।
সিচুয়ানের খাবার আমি সত্যিই খুব মিস করি।
 
এবার নির্বাচনের কথায় ফিরি।
আমাদের টিমে জাকির ভাই ছাড়া আরও উল্লেখ যোগ্য কয়কজনের মধ্যে ছিলেন একজন যুগ্ন-সচিব খালেদ স্যার, ফরেন সার্ভিসের নতুন অফিসার রইস হাসান সারোয়ার, পুরান ঢাকার কিরণ ভাই এবং সস্ত্রীক ইঞ্জিনিয়ার সেহজাদ জহির, প্রমুখ।
 
অফিসিয়ালী আমাদের দলনেতা ছিলেন পদাধিকার বলে খালেদ স্যার।
তবে ন্যাশনাল ইয়ূথ কাউন্সিল অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাকির ভাই ছিলেন মূলতঃ দলনেতা।
 
আমাদের ভ্রমণের দৈনিক স্কাজুয়াল ছিল ভোড় ছয়টায় ওয়েক আপ কল। ৮ টার মধ্যে ব্রেকফাষ্ট শেষ করে বের হয়ে যেতাম কোন সিম্পোজিয়া, পরিদর্শন অথবা অন্য কোন পোগ্রামে।
 
ঠিক কাটায় কাটায় দুপুর ১২টায় কোন এক উচ্চমান সম্পন্ন রেষ্টুরেন্টে রাজকীয় মধ্যাহ্ন ভোজন। তারপর আবার কোন পরিদর্শন বা অনুষ্ঠান।
 
বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যেই ডিনার কমপ্লিট- তখনও ওটা বিকাল।
 
ছয়টার মধ্যে আমাদের আবার হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হত।
 
আমাদের বাঙালী পেটে রাত ৯টার মধ্যেই ক্ষুধা লেগে যেত। আয়োজনকারীদের পক্ষে কিছু নডুলস এর ব্যবস্থা রাখতো আমাদের জন্য রাতের জন্য।
 
কিন্তু এভাবে আমাদের রাতে একটু বেশীই ক্ষুধা লেগে যেত।
 
কিরণ ভাই একদিন আমাদের কেএফসি খাওয়াবেন বলে ঘোষণা দিলেন চেংগদুতে যেয়ে। সবাই মিলে সন্ধ্যায় গেলাম এক কেএফসি’তে। ওখানেই মূলতঃ আমরা ২০জন নিজেদের মধ্যে পরিচিত হওয়ার এবং আড্ডা দেবার সুযোগ পেলাম এক সংগে।
 
আড্ডায় কোন এক পর্যায়ে ‘কিছু দুষ্ট বুদ্ধি’র আবির্ভাব হল ইঞ্জিনিয়ার সেহজাদ জহির ভাই এর মাথায়। তিনি নিজেকে অনেকটা স্বৈরাচারী কায়দায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ ঘোষনা দিয়ে ‘একটা নির্বাচন’ অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন- আমাদের এই ২০ জনের মধ্যে থেকে একজনকে ‘তথাকথিত নির্বাচিত দলনেতা’ বানানো যায় কিনা!
 
বাঙালী নির্বাচন প্রিয় জাতি।
তবে কেউ-ই নিজে নির্বাচন করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না।
 
আমরা কেউ-ই না।
 
কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মহোদয়ও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি নিজেই উদ্যোগ নিলেন- সকলকে উজ্জিবিত করার চেষ্টা করলেন। এবং পরদিন ওনি সরাসরি ‘আমাকে’ এবং ফরেন সার্ভিসের ‘রাইস’কে নির্বাচনে দাড় করানোর ঘোষনা দিয়ে দিলেন।
 
সমস্যা হলো আমি এবং রাইস কেউ ই ওই নির্বাচন মানলাম না; কেউ নিজেদেরকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিলাম না- নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করলাম।
 
কিন্তু ঐ যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, তার সুন্দরী স্ত্রী এবং আরো ক্যাডার বাহিনী বানিয়ে নির্বাচন করেই ছাড়বেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন।
তিনি নিজেই ব্যালট পেপার প্রস্তত সহ, প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
 
নিজ দায়িত্বে তিনি গ্রুপিং ও শুরু করে দিলেন।
 
কিন্তু আমি আর রাইস তখন এক হয়ে গেলাম এবং এসব নির্বাচন-টির্বাচন মানি না বলে নিজেদের গুটিয়ে রাখলাম।
 
অপরদিকে নির্বাচন কমিশনার তো ছাড়ার পাত্রই না।
তার এবং বাকী সকলের আগ্রহ সত্যিই দেখার মতো ছিল- যেখানে প্রার্থীরাই নির্বাচন করতে রাজী নয়।
 
সে এক অদ্ভুৎ নির্বাচন- পৃথবীর কোন জাতি এই বিরল নির্বাচন দেখার সুযোগ পায়নি কোনদিনও, আর পাবেও না; সেহজাদ জহির এর মতো সাকসেসফুল নির্বাচন কমিশনার কোথায় পাবে বিশ্ববাসী?
 
আমি আর রাইস খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। দু’জনে এক সংগে ঘুড়ে বেড়াই। নিজেদের দুরে সরিয়ে রাখি। অপরদিকে অন্যরা ব্যস্ত প্রচারণা নিয়ে।
 
যাই হোক। ঘোষিত নির্বাচনের ডেট চলে আসলো।
সবাইকে অনুরোধ করা হলো নির্বাচনে উপস্থিত থাকার জন্য।
 
আমি, রাইসও থাকলাম।
নির্বাচন কমিশনার সকলের মধ্যে ব্যালট পেপার হস্তান্তর করলেন।
 
আমি রাইস’কে এবং রাইস আমাকে ভোট দিয়ে আমরা ‘নিজেদের মধ্যে ভোট বিনিময়’ করলাম কশিনারকে সম্মান জানিয়ে।
 
ঘন্টাখানেক পরই ফলাফল ঘোষনা করলেন নির্বাচন কমিশনার।
২০টির মধ্যে মোট ১৮টি ভোট কাষ্ট হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার নিজে কোন ভোট দেননি। এবং জাকির ভাই শারিরিকভাবে অসুস্থ থাকায় উপস্থিত হতে পারেন নি।
 
আমি ৯টি এবং রাইস ৯টি করে সমান সমান ভোট পেয়েছি।
 
হা হা হা।
দুজনই বিজয়ী।
 
টিকা:
(1) জাকির ভাই অসুস্থ না হলে- আমি নির্বাচিত হয়ে যেতাম সেই নির্বাচনে; এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ ছিল না।
(1) আর আমার ব্যক্তিগত লাভের মধে যেটা হল- রাইসের মতো একজন তুখোর অফিসার বন্ধু পাওয়া। ও এখন কুয়ালা লামপুর এর বাংলাদেশ হাই কমিশনের মিনিষ্টার।
   Send article as PDF