চাপ্টার ওয়ান

ঘুম ভাংতেই সবকিছু যেন কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছিল।
এমন তো হয় না কখনও। কেন হচ্ছে?
 
চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে খুব।
স্বপ্ন দেখছি না তো?
 
অনেক কষ্টে চোখ খুললাম, খুলতে পারলাম।
কেমন যেন ধোয়াশা ধোয়াশা টাইপ লাগছে।
 
অামি কোথায়?
ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আবার চোখ বন্ধ করলাম। কতক্ষন জানি না চোখ বন্ধ রেখে আবারও চোখ খুললাম। এবার মনে হচ্ছে একটু পরিষ্কার দেখছি।
 
আমার রুমটা আলোকিত।
আমি তো সাধারণত রুম অন্ধকার করে ঘুমাই। অচেনা লাগছে কেন সবকিছু!
 
আমি বেডে শুয়ে রয়েছি। আমার চোখে চশমা।
কিন্তু আমি তো কোনদিন চশমা পরতাম- এমন তো কিছু মনে পরছে না।
 
হঠাৎ পুরাতন একটা স্মৃতি মনে পরলো। সেটা অনেক আগের। অস্পষ্ট মনে পরছে। ঢাকার নিউ এলিফ্যান্ট রোডের রেইন বো ভিশন থেকে একটা চশমা কিনেছিলাম। খুব শখ করে।
 
হাসি পেল। নিজেকে যেন সেই ঘটনায় কেমন বোকা বোকা মনে হলো এত এত বছর পর।
মেয়েটাকে দেখে কি যেন মনে হলো। অসাধারণ দেখতে ছিল মেয়েটি। শুধু মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষন করতে একটা দামী চশমা! সেই বয়সে বিখ্যাত অষ্ট্রিয়ান কোম্পানীর ‘সিলটি’ ব্রান্ডের একটা চশমা।
 
ব্যাটা সেলসম্যানের উপর মেজাজটা চটে গিয়েছিল! হাদারাম বলে কি না ‘এটা অনেক দাম’।
আরি ব্যাটা! তুই দামের কি বুঝিছ? আমাকে অপমান? বলে কি না অনেক দাম?
তখন ঢাকায় সবে মাত্র ক্রেডিট কার্ড প্রচলন শুরু হয়েছিল। আমি ম্যানিব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে দিলাম।
 
আবার চোখ বন্ধ করে ‘সেই স্মৃতি’ স্মরণ করে হাসছি।
কতটা পাগল ছিলাম আমি! ৩৭ হাজার টাকায় একটা চশমা কিনে তার বিল মিটালাম ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। আনন্যাসেছারি!
 
হঠাৎ এই ঘটনাটা মনে পরে গেল।
কিন্তু অনেক বছর আগের ঘটনা। কেমন যেন সবকিছু খুবই অস্পষ্ট মনে হচ্ছে।
 
স্বপ্নে তো কেউ পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন করে না। তাহলে আমি তো কোন স্বপ্ন দেখছি না।
জেগে আছি, ঘুম থেকে উঠলাম।
 
অথচ আমার চোখে চশমা। গ্লোল্ডেন কালার ফ্রেম। পরিষ্কার দেখছি। চশমাটা কি একটু খুলবো। কিন্তু হাত তো তুলতে পারছি না। শরীরটা মনে হচ্ছে পুরো পুরি অবশ হয়ে আছে।
 
আবারও ঘুমিয়ে গেলাম।
 
এবং কতক্ষন পর বুঝতে পারছি না।
চোখ মেললাম। আমি ঠিক সেখানটাতেই।
 
আমার সামনে একটা বড় কাচের ষ্টেজের মতো।
সেখানে একটা মেয়ে দাড়িয়ে। হোয়াইট। ‘গুড অাফটার নুন স্যার’।
 
মেয়েটা কি আমাকে বলছে? কিন্তু সে আমাকে গুড আফটার নুন জানাবে কেন? মানুষের তো ঘুম ভাংগে সকালে। আমি বোধ হয় ভুল করছি। আবার চোখ বন্ধ করলাম এবং মিনিট খানেক পর আবার চোখ খুললাম।
 
‘গুড আফটার নুন, স্যার’। আবারও সেই মেয়েটিই।
আমিও ‘গুড আফটার নুন’ বলতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। আমার ঠোঁট কাপছে। কথা বের হচেছ না। মনে মনে বললাম ‘গুড আফটার নুন’। লক্ষ্য করলাম আমার ঠোঁটদুটি বিরবির করছে শুধুই।
 
হাট নাড়াতে পারছি।
আমার ডান হাতে দু’টি স্যালাইন চলছে। এটা হসপিটাল। সে রকমই তো মনে হচ্ছে।
 
আচছা আমি তাহলে কোথায়?
সেই মেয়েটির দিকে আবারও তাকালাম।
 
সেই মেয়েটিই নেই। অন্য একটা মেয়ে দাড়ানো ওখানে। ইন্ডিয়ান মনে হলো এবারের মেয়েটাকে। শাড়ী পড়া। নীল রঙ এর শাড়ী, কপালে টিপ। গালে একটা কালো বড় তিল দেখা যাচেছ।
 
আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু করে হাসছে। বলল, ‘আপনি কেমন আছেন?’
আমি ‘ভালো’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলাম। সংগে যোগ করলাম, ‘আমি কোথায়?’
‘আপনি এখন আছেন মেডস্টার জর্জটাউন ইউনির্ভার্সিটি হসপিটাল, ওয়াশিংটন ডিসিতে।’
 
আশ্চর্য্য, মেয়েটা বাংলায় কথা বলছে? কেন যেন সবকিছু খুব বিভ্রান্তিকর মনে হচ্ছে আমার কাছে।
প্রশ্ন করলাম, ‘আমি এখানে কেন? কি হয়েছিল আমার?’
মেয়েটা এবার দুষ্টমীর হাসি হাসছে। ‘স্যার, আপনার কিছুই হয়নি। আপনি সুস্থ্য আছেন।’
‘তাহলে হসপিটালে কেন?’
‘স্যার, আপনি এখন ঠিক কেমন ফিল করছেন? আপনার শরীরের কোথাও কোন পেইন আছে? আপনি কি কাইন্ডলি আপনার বাম হাতটা উপরে তুলতে পারবেন?’
আমি আমার বাম হাত এবং বাম পা একসংগে উপরে তোলার চেষ্টা করলাম। তুলতে পারলাম কিন্তু মনে হচ্ছিল খুব কম শক্তি পাচ্ছি।
‘আপনি দারুণ পেরেছেন।’
‘দারুণ পেরেছি মানে কি?’ আমার সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল।
 
তারপর আর কিছু মনে নেই।
 
আবার চোখ খুললাম। সেই চশমা আমার চোখে।
এবার অামার ডান হাতে আর কোন স্যালাইন নেই। শরীরটা খুবই হালকা হালকা লাগছে।
 
রুমের ভেতরে সবকিছু পরিষ্কার দেখছি।
আমি উঠে বসলাম। কিন্তু নীচে নামতে পারছি না। সাহস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল অনেক বছর পর আমি ঘুম থেকে উঠছি। শরীর মন অত্যন্ত ফুরফুরে। কিন্তু শক্তি পাচ্ছি না। সবকিছু এতো এলোমেলো লাগছে কেন? কয়টা বাজে এখন? কত তারিখ আজ? কি বার?
 
মেয়েটাকে খুঁজলাম যেখানে দাঁড়িয়ে আমার সংগে কথা বলছিল।
কেউ নেই এখন সেখানে। আমি নিজে নিজেই বললাম, ‘আপনি কি আছেন?’
‘জ্বি আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। এখন কি একটু ভালো আছেন?’
‘হ্যা, আমি খুব-ই হাংগরী। মনে হচ্ছে অনেক বছর কিছু খাইনি। এক গ্লাস পানি হবে?’
 
মেয়েটা এবার খুবই মিষ্টি করে হেসে দিল। ‘স্যার, আপনার ডান দিকে দেখুন টাটকা কিছু খাবার দেয়া রয়েছে, খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানিও দেয়া আছে। আপনার জন্যই, প্লিজ- আপনার যা যা ইচ্ছে খেয়ে নিন।’
 
ডান দিকে তাকালাম। টেবিলের মতো একটা ট্রেতো দেশী খাবার সাজানো। সাদা প্লেন রুটি, আলু ভাজি, দেশী মুরগীর ভুনা মাংস, গরম দুধ চা- ধোঁয়া উড়ছে এবং একটা মগে পানি এবং অন্য একটা প্লেটে আইস-চিপস।
 
আমি ভিশন রকমের অবাক হচ্ছি। কিছুই বুঝতে পারছি না, কোন হিসাবও মেলাতে পারছি না। গ্লাসে পানি ঢাললাম চামচ দিয়ে অনেকগুলি আইস-চিপস নিলাম। আবারও নিলাম কিছু আইস-চিপস। কয়েকটা আইস চিপস মুখে দিলাম।
 
মুখটা যেন কেমন হয়ে রয়েছে। কেমন যেন ফ্যাতফ্যাতে হয়ে রয়েছে জ্বীভটা।
আচ্ছা আমার মুখটা কে পরিস্কার করে দিল? ব্রাশ করলাম কখনও? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
 
পানি খেলাম এক গ্লাস। আরও এক গ্লাস খেলাম। আরও এক গ্লাস।
ওহ, কত বছরের পানির তৃষ্ণা ছিল এটা? শরীরটা মুহুর্তেই খুব চাঙ্গা হয়ে গেল; মনটাও।
 
খুব ভালো লাগছিল। মাথাটা মনে হচ্ছে কাজ করা শুরু করেছে।
কয়েকটা রুটি, মাংস অার ভাজি দিয়ে খেয়ে নিলাম।
 
চা টা নিলাম। খেলাম পুরোটা।
আমি এখন সম্পূর্ণ ফুরফুরে। কিন্তু, আমি হসপিটালে কেন?
 
আবার সামনে তাকালাম। মিনিট খানেক পর সেই ইন্ডিয়ান মেয়েটি উদয় হলো হঠাৎ করেই। ‘স্যার, কেমন লাগলো আপনার খাবারটা? খাবারগুলি আমরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে আনানো হয়েছে বিশেষ বিমানে করে আপনার জন্য; আপনার কি খাবারগুলি ভালো গেলেছে?’
‘মানে কি? আমি এমন কি বিশেষ ব্যক্তি যে আমার জন্য ঢাকা থেকে বিশেষ বিমানে করে দেশী টাটকা খাবার আনানো হয়েছে?’
 
মেয়েটার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগেই রয়েছে। ‘জ্বী স্যার। আপনি বর্তমান সময়ের অবশ্যই বিশেষ কেউ’।
‘কেন? কে অামি? কি আমার পরিচয়?’
‘কেন স্যার, আপনি কি আপনাকে চিনতে পারছেন না? আপনার তো আপনার সব কিছুই মনে থাকার কথা! আপনার সব স্মৃতি তো আপনার ব্রেনে অক্ষুন্ন রয়েছে। আপনার নাম টা কি আপনার মনে আছে? বলুন তো স্যার আপনার নাম কি?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে থামলো মেয়েটি।
‘আমার নাম …’ হঠাৎ চিন্তায় পরে গেলাম। কি যেন নাম আমার!
‘স্যার মনে করুন …’।
‘আমার নাম সাইফুজ্জামান ইভান’। নিজের নামটা ঠিকই তো বলে ফেললাম।
‘জ্বি স্যার। আপনি সাইফুজ্জামান ইভান। স্যার, আপনি কি কাইন্ডলি আপনার জন্ম তারিখটা বলবেন আমাকে?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। ৭ই অক্টোবর ১৯৭৬।’
‘জ্বি স্যার। ধন্যবাদ।’ হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মেয়েটি রোবটের মতো করে কথা বলছে। মেয়েটার কথায় নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
 
এটা ওয়াশিংটন ডিসি। আমি হসপিটালে ভর্তি। অথচ মেয়েটা আমার সংগে কথা বলছে পরিস্কার বাংলা ভাষায়। কিভাবে কি?
 
‘আচ্ছা আজ কত তারিখ? কি বার? কয়টা বাজে এখন? আমার হাতে তো কোন ঘড়ি দেখছি না।’ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
‘স্যার আজ শনিবার। ৬ই অক্টোবর ২১১৪ সাল। আগামী কাল আপনার ১৩৮তম জন্ম দিন।’
‘কত সাল বললেন? কত সাল? আবার বলেন।’
‘স্যার ১০/০৬/২১১৪।’
‘১৩৮ বছর কি এজন মানুষ বাঁচতে পারে? কিসব বলছেন আপনি?’ হঠাৎ মেজাজ চড়াও হয়ে গেল আমার।
 
আমি ঘুমিয়ে পরলাম বা জ্ঞান হারালাম।
 
 
 
 
   Send article as PDF