দিল্লী ফ্লাইট

দুই হাজার সালের দিকে জীবনের প্রথমবার দিল্লী যাই।
সকাল আটটায় ঢাকা থেকে সরাসরি আমাদের দিল্লী ফ্লাইট- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। তখনও আমি বিমান ভ্রমনে ততটা নিয়মিত হয়ে উঠিনি। ডিসেম্বর মাস, ভোর ছয়টায় ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌছে গেলাম।
তারপরের এক লম্বা ইতিহাস!
৯টা, ১১টা, দেড়টা, তিনটা করে করে অবশেষে বিকেল সাড়ে চারটায় আমাদের ফ্লাইটটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আকাশে ডানা মেললো। আমি ততক্ষনে এয়ারপোর্টে শরীরের যাবতীয় ক্যালরী, এনার্জী, ঘুম ইত্যাদি যা যা থাকে তার সব শেষ করে বিধ্বস্ত।
যা ই হোক ‘দিল্লী যে সত্যি সত্যি বহুত দারাস্থ হায়’ সে টা আমি ঠিকই বুঝে গেলাম প্রথম যাত্রায়ই।
ও হ্যা ভাড়া ছিল ২৬,০০০ টাকা রিটার্ণ ঢাকা-দিল্লী-ঢাকা রুটের; এখনও যতদুর জানি এই রুটের ভাড়া ঐ ২৬ বা ২৭ হাজার টাকার মধ্যেই উঠানামা করে।
তবে, আমার আজকের লেখাটি দিল্লী বা বিমান বা বিমান ভাড়া অথবা ভারত কিংম্বা ভ্রমণ নিয়ে নয়। বিষয়টি একটু ভিন্ন। অনেক অনেক বছর যাবৎই ভাবছি কিনতু লেখা হয়ে উঠেনি। আজ লিখছি।
ভারত নিঃসন্দেহে অনেক বড় এবং বুদ্ধিমান আঞ্চলিক শক্তি; অন্তত বাংলাদেশের তুলনায়।
তারা কথার মারপ্যাচ, ধমকের যুক্তি বা বড়-ভাইয়ের বাহাদুরী দেখিয়ে অনেক অনেক কিছুই ছোট প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বাগিয়ে নিতে সর্বদা-ই সোচ্চার এবং যথেষ্ঠ পটু।
আমি তাদের যোগ্যতাকে অসম্মান করবো না; কারো যোগ্যতাকেই আমি কোনদিন অসম্মান করি না- survival of the fittest বাক্যটাকে আমি সম্মান করি; পৃথিবী এভাবেই এগিয়ে চলছে এবং চলবে। ছোট মানুষরা বড়দের খোঁচা দিয়ে মজা পায় কিনতু আমার যুক্তি ভিন্ন; আমার হিসাব অতি সাধারণ- ‘সারা জীবন ছোট না থেকে বড় হয়ে গেলই তো হয়ে গেল; কেন ছোট হয়ে পরে থাকবো?’।
চেষ্টা থাকলে survival of the fittest এর উপর তো আমিও রাজত্ব করতে পারবো; তাই না?
যা-ই হোক, মুল আলোচনায় ফিরি।
এরপরও আমি অনেক বার দিল্লী গেছি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ত্যাগ করেছি- ঠান্ডা মাথায় হিসাব করে সেই ২০০০ সালেই। বেছে নিয়েছিলাম অন্য দেশী বা বিদেশী ফ্লাইটকে। কলকাতা থেকে মাত্র ৪/৫ হাজার রুপীতে দিল্লী যাওয়া যায়- সেটাও পুরান খবর।
একবার হঠাৎ মাথায় একটা পোকা ঢুকলো। দিল্লী যাবার সবচে সহজ এবং সাশ্রয়ী খরচ বের করার চিন্তা শুরু করলাম। আর আগেই বলেছি আমি একবার যেটা ভাবি সেটা করে ছারি।
এবং, খুঁজেও বের করে ফেললাম রাস্তাটি।
হ্যাঁ। আগরতলার কথা বলছি। ভারতের ‘সেভেন সিষ্টারস’ খ্যাত অন্যতম রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী এই শহরটি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার আখাউড়ার সাথে একদম বর্ডার ঘেষা একটি শহর। অর্থাৎ আখাউড়া বর্ডার পার হলেই রাজধানী আগরতলা শহর। খুব ছিমছাম, ছোটখাটো, পরিচ্ছন্ন একটি গ্রামীন শহর এই আগরতলা।
আগরতলা অন্য আর একটি কারণে আমার আরোও পছন্দের শহর।
সেটা হলো- আমার দেখা সারা পৃথিবীর সমস্ত বাঙালীদের মধ্যে ‘সবচে সভ্য, ভদ্র এবং শিষ্টাচার জানা বাঙালী’রা বসবাস করে এই আগরতলা শহরে। ওদের ব্যবহার দেখে আমি সত্যি অবাক হয়েছি- অনেকবার এই ভেবে যে, ‘বাঙালীরাও তাহলে এতো ভদ্র হতে পারে?’
দুইটি ছোট্ট উদাহরণ দিই।
বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের অনেকগুলি ল্যান্ড বর্ডার রয়েছে। বেনাপোল থেকে দর্শনা, হিলি, বুড়িমাড়ী ইত্যাদি। আমি সবগুলি বর্ডারেই দেখেছি ভারতীয় এবং বাংলাদেশ পাড়ের ইমিগ্রেশন, কাষ্টমস অফিসার এবং স্থানীয় দালালদের ‘খাই খাই’ ব্যবহার। যতভাবে সম্ভব একজন নিরীহ যাত্রীকে যতটা সম্ভব ওরা হেনেস্থা করবেই দুটি পয়সা কেড়ে নেবার জন্য।
কিনতু, এই আগরতলা ইমিগ্রেশন ও কাষ্টমসে দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। না কোন দালাল তো নেই-ই সেখানে; অফিসারদের মুগ্ধ করা ব্যবহার আমাকে রীতিমত উচ্ছসিত করেছে। আমি একদিন বিষয়টি এক অফিসারকে বলেও ছিলাম।
তিনি হাসলেন, জবাব দিলেন- ‘দাদা এটাই কি ভাল না? আমরা তো সরকার থেকে বেতন পাচ্ছি, অন্যদের প্রতি লোভ করবো কেন?’
আর দ্বিতীয় উদাহরণটিও দিই।
আমি ঢাকার পাবলিক বাসে চড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম সেই ১৯৯৭ সাল থেকেই। যারা পাবলিক বাসের যাত্রী তারা ভালই এর উত্তরটা জানেন। তবে রিক্সাতো আর ছাড়তে পারিনি। অনেক বিব্রতকর দূরত্ব বা গলিমুখে অনেকসময় রিক্সাই একমাত্র ভরসা, যদিও আমি হাঁটতেই সবচে ভালবাসি।
তো, ওসব রিক্সাওয়ালাদের যদি প্রশ্ন করতাম, ‘ভাই ওমুক জায়গায় যাবেন?’
এলাকা পছন্দ না হলে অনেক রিক্সাওয়ালা জবাব দেবারও প্রয়োজন বোধ করে না আমাদের ঢাকা শহরে। সীটের উপর পা’তুলে বিড়ি খেতে থাকে অদ্ভুৎ ভংগিতে।
আর আগরতলায়?
হ্যাঁ। ওখানেও আমি অনেক রিক্সাওয়ালাকে প্রশ্ন করেছি, ‘ওমুক জায়গায় যাবেন?’
এবং অবাক হয়ে দেখেছি, সে চট করে রিক্সা থেকে নেমে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বলে, স্যার আমি তো যাব না, একটু দাড়ান আমি আপনাকে অন্য রিক্সা করে দিচ্ছি। এবং দেয়ও।
ভদ্রতা শিখতে দোষ কোথায় আমি বুঝি না?
যাক, ভদ্রতা প্রসংগও বাদ। আবারও মূল প্রসংগে ফিরি।
আগরতলায় একটি এয়ারপোর্ট রয়েছে, নামও আগরতলা এয়ারপোর্ট। বাংলাদেশ – ভারত বর্ডারের কাটাতার ঘেষা অংশ থেকে এয়ারপোর্টটির রানওয়ে শুরু। বিমানগুলি উঠানামা করে বাংলাদেশের ঠিক উপর দিয়ে। এখান থেকে কলকাতার ভাড়া কমবেশী ২০০০ রুপি; গৌহাটি ১৭০০ বা ১৮০০ রুপি, মুম্বাই বা দিল্লীর ভাড়াও মোটামুটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার রুপি।
ঢাকা থেকে ট্রেনে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া হয়ে আখাউড়া যেতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা; ২০ মিনিট রিক্সায়।
তাহলে দিল্লী যাবার কোন রাস্তাটি সহজ?
আমাদের বাংলাদেশ সরকারের জ্ঞান-বুদ্ধির দৌড় আমার জানা আছে; এসব নিয়ে ভাবার মতো যোগ্যতা তাদের কোন কালেও ছিল না এখনও নাই।
কিনতু একটু যদি নজর দেয় হতো, ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত কয়েকটি ডাইরেক্ট ট্রেন করে দেয়া যায় তবে সময় লাগবে ম্যাক্সিমাম ২ ঘন্টা।
বাংলাদেশের স্থানে ভারত হলে- তারা ওই এয়ারপোর্টটি ফ্রি হিসাবে নিয়ে নেবার চিন্তা করতো।
কিনতু বাংলাদেশ কি নীচের সামান্য চিন্তাগুলিও করতে পারে না?
১) ঢাকা, চট্রগাম, সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ডাইরেক্ট ট্রেন সার্ভিস চালু করা
২) আখাউড়াস্থ আগরতলা এয়ারপোর্টের এপাড়ে একটি নতুন ইমিগ্রেশন অফিস স্থাপন করে আগরতলা এয়ারপোর্টে সংযুক্ত থাকা
৩) একটি সম্পূর্ণ ফ্রি ভারতীয় এয়ারপোর্ট এবং ভারতীয় আভ্যন্তরিণ বিমান যোগাযোগে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা
বাংলাদেশের কি অতটুকু বুদ্ধি আছে?
 
বাংলাদেশ কি কোন দিন পারবে এরকম একটি প্রস্তাব ভারতে দিতে? না কি সেই সাহসও নেই?
   Send article as PDF