কুটনৈতিক সম্পর্কে ইসরেল

জেনিফারের সংগে আমার পরিচয় ১৯৯৬ সালে।ভারতের দার্জিলিং শহরের টাইগার হিলে। আর্লি-মর্ণিং এ টাইগার হিলে আমি গিয়েছি সান-রাইজ দেখতে; ওখান থেকে ভোরের কাঞ্চনজজ্ঞা পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়; বরফে আবৃত পর্বতমালা। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পবর্তশৃঙ্গ এটি।

কিন্তু সেই ভোর বেলার বরফ ঢাকা চুড়ায় যখন দিনের প্রথম সূর্যালোক পড়ে- তখন তার সৌন্দয্য সবকিছুকেই ম্লান করে দেয়। আমার ঠিক পাশেই দাাঁড়ানো দু’টো ফুটফুটে সাদা মেয়েকেও ম্লান করেই দিয়েছিল যদি না ওদের একজন জেনিফার চোখে আমি দুষ্টমি টের না পেতাম।

আমি ভোরের সেই ঠান্ডা আবহাওয়ায় এক কাপ কফি খেয়ে নিজেকে চাংগা করছিলাম। ঠিক তখনই মেয়েটি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, আমি হ্যান্ডশেক করলাম। হাত না ছেড়েই ও সুন্দর ইংলিশে বলল, ‘আমার নাম জেনিফার; তোমার নামটা বলবে?’

আমি একটু অবাকই হলাম। তারপরও হেসে দিলাম, বললাম, ‘আমি পিয়াস’ যোগ করলাম, ‘আমি কি জানতে পারে তোমরা ঠিক কোন দেশ থেকে এসেছো?’


‘হ্যা অবশ্যই’ ওর সংগী মেয়েটির নাম বলেছিল বাট আমি এখন আর মনে করতে পারছি না, সেই সংগে বলল, ‘আমি তেল আবিব থেকে এসেছি। তুমি কি জানো তেল আবিব কোথায়?’

‘হ্যা অবশ্যই, জানবো না কেন? তুমি তাহলে ইসরেলী কন্যা? এই প্রথম আমি কোন ইসরেলী মানুষের সংগে পরিচিত হলাম, নাইস টু মিট ইও’।


তারপর অনেকক্ষন কথা হলো আমাদের দু’জনের। সংগী মেয়েটিও টুকটাক কথা বলছিল। ব্যক্তিগত তথ্য বিনিময়, সামাজিক, টাইগার হিল, কাঞ্চনজজ্ঞা, ইত্যাদি সব প্রসংগ নিয়েই। বিশেষ করে বাংলাদেশ শুনে ও বেশ কৌতুহলী হলো। আমি ওকে জানালাম, তুমি বাংলাদেশে যেত পারবে না আর আমিও ইসরেল যেতে পারবো না।


আমাদের পরিচয়টুকু ওখানেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। জেনিফার তারপরও আমার ঠিকানা নিয়েছিল, বলেছিল সে চিঠি লিখবে আমাকে কিন্তু আমি তো জানতাম যে এ সম্পর্ক আর এগুবে না। যাই হোক, জেনিফারের কথা আমার মনে আছে এখনও। ওর সংগে আমার বেশ কয়েকটা ছবিও আছে এলবামে। দুই যুগ পর ওর আর হয়তো আমাকে মনে থাকার কথা নয়। আবার কে জানে- থাকতেও তো পারে! এই বিশ্ব বড়ই বিচিত্রময়।


ইসরেলী মানুষগুলো খুবই স্লীম। ফর্সা। দেখতে আকষর্ণীয়। এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমি আমার জীবনে আজ পর্যন্ত একজনও কদাকার বা স্থুল দেহের ইসরেলী দেখিনি। এরা জন্মের আগে থেকেই অর্থাৎ নিজ নিজ মায়ের পেটে থেকেই যথেষ্ঠ প্রস্তুতি নিয়ে এই পৃথিবীতে পদার্পণ করে। মায়েরা বেশী বেশী মাছ খান ওই সময়টাতে, আরও অনেক বিশেষ খাবার গ্রহন করে অনাগত সন্তানের জন্য। গর্ভবতী মায়েরা সুন্দর মিউজিক শুনেন, ভালো ভালো গান শুনে। গর্ভবতী মায়েরা জটিল অংক কষে- যখন তার পেটে বেড়ে উঠতে থাকে একটি মানবভ্রণ। উদ্দেশ্য একটাই, সন্তানটি যেন হয় এই পৃথিবীর শ্রেষ্টতম বুদ্ধিমান মানুষ।


এবং হয়ও তা।আলবার্ট আইনসটাইন ওভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন কোন এক ইহুদী মায়ের গর্ভে। আজকের বিশ্বের কনিষ্ঠতম বিলিওনিয়র মার্ক জাকারবার্গ নিজেও ওভাবেই বেড়ে উঠেছেন। আমেরিকার কর্পোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইহুদীরা। প্রযুক্তি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আজকের এই উন্নতির পেছনে ইহুদীদের অবদান রয়েছে। তাদের নেতৃত্ব রয়েছে।


আমেরিকা এই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ইহুদী রাষ্ট্র; বৃহত্তম দেশ ইসরেল। আমেরিকা ছাড়াও ফ্রান্স, পশ্চিম তীর, কানাডা, বৃটেন, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া, জার্মানী এবং অষ্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর প্রতিটিতে ১০০ হাজারের উপরে ইহুদী জনগন বসবাস করছে। এছাড়া তুরস্ক, ইরান, উজবেকিস্তান, মরোক্ক, কাজাকাস্থান, চায়না, জাপান এবং ভারতের মতো দেশেও অনেক ইহুদীদের বসবাস রয়েছে। প্রচুর সংখ্যক ইহুদী বসবাস করছে পুরো ইওরোপ জুড়ে।


ইসরেলে ৮.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম রয়েছে ১.৫ মিলিয়ন। আমেরিকার প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম রয়েছে ৩.৫ মিলিয়ন। অপরদিকে আমেরিকার ৩২৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ইহুদী রয়েছে ৫.৭ মিলিয়ন।


এই বিশ্বে এই পর্যন্ত প্রায় ৯০০ জন মানুষ নোবেল পুরুস্কার অর্জন করেছেন যার মধ্যে প্রায় ১৮০ জনই ইহুদী; অর্থাৎ সংখ্যাটি ২০%। অথচ টোটাল ইহুদীর সংখ্যা এই পৃথিবীতে মাত্র ১৫ মিলিয়ন এরও অনেক কম। যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ১.৮ বিলিয়ন। কতজন মুসলিম নোবেল পুরুস্কার পেয়েছে?


ইহুদীদের সংগে মুসলিমদের বেশকিছু মিল রয়েছে।মুসলিমদের খুবই প্রভাবশালী নবী হযরত মুসা (আ) কে ইহুদীরা তাদের প্রধান নবী এবং রাসুল হিসাবে মান্য করে। ঠিক মুসলিমরা যেভাবে নবী মুহাম্মদ (সা) কে তাদের প্রধান নবী ও রাসুল হিসাবে মনে করে।
ইহুদীরা শনিবারকে তাদের পবিত্র দিন হিসাবে গণ্য করে। তারাও তাদের মসজিদে যায়, সেখানে সালাত আদায় করে। তারাও তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে। তারাও রোজা রাখে তাদের মতো করে। তারাও হালাল খাবার খায়। তারা মুসলিমদের হালাল খাবারকে নিজেদের হালাল হিসাবে খায় আবার মুসলিমরাও ইহুদীদের হালাল খাবার (কোশার) গ্রহন করে। ইহুদী মেয়েরা পর্দা করে। ইহুদী পুরুষরা ছোট টুপি পরিধান করে। দু’টো ধর্মের মধ্যে প্রচুর মিল দেখতে পাওয়া যায়। মুসলিম ও ইহুদীরা উভয়েই হযতর ইব্রাহীম (আ) কে তাদের জাতির পিতা হিসাবে গণ্য করে, এবং আদম (আ) কে সমগ্র মানবজাতির পিতা হিসাবে মান্য করে। মুসলিম ও ইহুদীরা উভয়েই ‘একেশ্বরবাদী’ অর্থাৎ তারা মনে করে তাদের সৃষ্টিকর্তা একক এবং তার কোন শরিক নেই। মুসলিমদের প্রথম কেবলা জেরুজালেম ইহুদীদেরও কেবলা। মুসলিম ও ইহুদী পুরুষরা উভয়েই খৎনা করে। মুসলিম ও ইহুদী কেউ-ই শকুরের মাংস খায় না। নারী ও পুরুষের জন্য পর্দা ও শালীন কাপড় পরার বিধান দুই ধর্মে আছে। দুই ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ- যদিও ইহুদীরা সুদকেই তাদের উপার্যনের অংশ হিসাবে ব্যবহার করে থাকে; মুসলিমরাও বাদ যায় না।


অমুসলিমদের মধ্যে একমাত্র ইহুদি জাতির নারীর সাথে মুসলিম পুরুষের বিয়ের অনুমতি আছে। আলেম ওলামাদের মতে এই বিয়ে জায়েজ- তবে তা মাকরুহ বা পছন্দনীয় কাজ না।


যাই হোক, ইহুদী জাতিটি বর্তমান বিশ্বের সবচে বুদ্ধিমান জাতি হিসাবে স্বীকৃত।
আসলে আজ একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলবো। এরম কথা আমি মাঝে মধ্যেই বলি। এবং প্রচুর সমালোচিত হই। যদিও আমি বরাবরই বলে এসেছি যে আমি সমালোচনাকে ভয় করি না; উপরোন্তু যৌক্তিক সমালেচনাকে শ্রদ্ধা করি- ভুল হলে নিজেকে সংশোধন করে নিতে আমি ১ ন্যানোসেকেন্ডও সময় ব্যয় করি না। কিন্তু যুক্তিহীন সমালোচনাকে আমি গ্রাহ্য করি না। কে আমাকে কি বলল- তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি মানুষকে খুশী করার জন্য কোন কথা লিখি না। আমি লিখি মানুষকে ‘সচেতন’ হতে। আমি লিখি মানুষ যেন বুঝতে পারে সে কোথায় ভুল করেছে, তার কোন ভুল থেকে বের হয়ে আসা উচিত।


আর তাইতো অনেকেই যখন লিখে, ‘আপনার কাছ থেকে এমন কথা আশা করিনি’। তখন আমি মনে মনে বলি, ‘আমি তো আপনার মনের কথা বলার জন্য কলম ধরিনি। আমি আমার দোষ-ত্রুটিটুকু তুলে ধরতে চাই। আমি সত্যকে গ্রহন করতে চাই মিথ্যাকে পেছনে ফেলে।’


আমি আপনার কথা বলবো না, আমি শুধুই সত্যের পক্ষে বলবো। আপনি যদি সচেতন হন এবং সত্যের অনুসারী হন, তাহলে আমার কথাগুলো আপনার নিজের কথাই বলে মনে হবে। আমি যেহেতু নেতা হতে আসিনি, তাই ঢালাওভাবে আপনাকে খুশী করা আমার উদ্দেশ্য নয়।


আমি মুলত আলোচনা করতে চাই ‘বাংলাদেশ-ইসরেল’ কুটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে।
ইসরেল রাষ্ট্রটি ইহুদী নিয়ন্ত্রিত যদিও সেখানে প্রায় ১৮% মানুষ রয়েছে যারা মুসলিম। জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে এখনও আজান হয়, নামাজ হয়। ইহুদীরা জোর করে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করেছে।


আমার প্রশ্ন হলো, এই যে সৌদী আরবে আজ যারা নেতৃত্ব দিয়েছে- তারা কারা? একটি পরিবার নাম আল-সৌদ। এই আল সৌদ বংশটিও তো আজ বৃটিশদের সহায়তায় জবরদখল করে রেখেছে আরাবিয়া নামের বিশাল মুসলিম ভূখন্ডটিকে। আমেরিকা-বৃটেনের তাবেদারী করে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। পাখির মতো গুলি করে মারছে মুসলিম ইয়েমেনীদের।


দেখুন। পৃথিবীটাই এমন।আজ শেখ হাসিনা অবৈধভাবে বাংলাদেশের উপর শাসনব্যবস্থা জারি রেখেছে। পৃথিবীতে কয়টা দেশে ‘অবৈধ শাসন-ব্যবস্থা’ জারি নেই- কোন দেশটিকে দেখাবেন?


মুসলিমরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে প্রায় ৬০০ বছর। সেটা কি ছিল? অবৈধ ছিল না? পারস্য থেকে এসে হিন্দুদের উপর শাসন চালানো কি অন্যায় নয়? এরপর বৃটিশরা এসে ২০০ বছর শাসন করেছে- সেটা কি? অবৈধ শাসন নয়? এখন ভারতে কি হচ্ছে? মুসলিম অধ্যষিত হায়দ্রাবাদকে জবরদখল করা কি অবৈধ শাসন নয়? জম্মু ও কাশ্মিরের ৩৭০ রধ করা কি অবৈধ নয়? কোরিয়া নামের একটি দেশকে দু’ভাগ করে দু;’টি দেশে বিভক্ত করা কি অবৈধ নয়? আদিবাসীদের বিতারিত করে বা হত্যা করে আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়া দখল করা কি অবৈধ নয়? এরকম উদাহরণ হাজারটা উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু সবদোষ শুধুমাত্র ইসরেলীদের। কারণ তারা ইহুদী!


কয়টা বৈধ শাসন-ব্যবস্থা আপনি এই বিশ্বজুড়ে খুঁজে পাবেন যে তারা শতভাগ বৈধ?
রাজনীতিটাই এমন। এখানে বৈধ-অবৈধ বলে কিছু হয় না। যে ক্ষমতায় যাবে- সেই বৈধ। আবার যখন নেমে যাবে- তখন দাবার চাল উল্টে যাবে; ইতিহাসও পাল্টে যেতে সময় লাগবে না।


আপনি বলবেন শিয়ারা খারাপ। আবার শিয়ারা বলবে সুন্নিরাই অবৈধ। বাংলাদেশের এমন মানুষের অভাব নেই যে কথায় কথায় বলছে শিয়ারা তো মুসলিমই না। অথচ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পরিবারটিই ছিল শিয়া। আবার দেখুন সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান দেশটি তৈরী হলো একজন শিয়ার হাত ধরে। আপনি হিসাব মিলাতে হিমসিম খাবেন।


হিসাব মিলাতেই পারবেন না।তাহলে কোন দিকে যাবেন? আপনাকে মানিয়ে চলতে হবে। আপনি যদি বুদ্ধিমান হোন তাহলে আপনাকে মানিয়েই চলতে হবে। মাথা গরম করে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়।


আপনি বলবেন, ইহুদীরা অভিশপ্ত। কোরানে নাকি বলা হয়েছে ইহুদীরা অভিশপ্ত। তাদের সংগে বন্ধুত্ব করা যাবে না। ইত্যাদি।


তো, কোরানের ঠিক কোথায় বলা হয়েছে যে ইহুদীরা অভিশপ্ত? কোথাও নয়। একটি লাইনও এরকম নেই। কোরানে কোথাও বলা হয়নি যে ইহুদীদের সংগে সম্পর্ক রাখা যাবে না। উপরোন্ত ইহুদীদের মেয়েদের বিয়ে করা পর্যন্ত জায়েজ রয়েছে। বন্ধুত্ব না করলাম, সেটাতে পরামর্শ দেয়া রয়েছে। কিন্তু তাদের সংগে সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্পর্ক করা যাবে না- সেটা কোথায় পেলেন?


মুহাম্মদ (সা) নিজে তার নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের সঙগে ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষর করে ইহুদীদের সংগে সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রেখেছেন। তাহলে আপনি কোন স্যার?
বিশ্বের সর্বকালের সর্বত্তোম সংবিধান পবিত্র কোরান শরীফ। কোটি কোটি মুসলিম এতো বড় একটা নেয়ামত হাতে পেয়েও বিশ্বের সেরা জাতির মর্যাদা অর্জন করে উঠতে পারছে না; অথচ সামান্য ১৫ মিলিয়ন ইহুদি আজ নেতৃত্ব দিচ্ছে এই বিশ্বকে। আর সেই পবিত্র কোরন শরীফটি ভাজ করে সেলফের উপর সাজিয়ে রেখে বসে বসে বলছে, ইহুদীরা অভিসপ্ত জাতি। এবং এরা নিজেরাই মার খাচ্ছে ফিলিস্তিনে, মার খাচ্ছে কাশ্মিরে, মার খাচ্ছে আরাকানে, মার খাচ্ছে ইয়েমেনে। এরচে হাস্যকর কিছু খুঁজে পাওয়া কস্টকর!
ইসরেল বর্তমান বিশ্বে অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর। দেশটি বুদ্ধিমান। দেশটি শিল্পোন্নত। তাদের অপরাধ ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন চালায়। মানলাম। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কি ফেরেস্তা? তারা কি করে? তাদের নিজেদেরই তো ঐক্য নেই। তারাই দু’ভাগে বিভক্ত। দুই ভূখন্ডে দুই নেতা। দুই গ্রুপ। যারা নিজেরাই ঠিক না- তারা কিভাবে নিজেদের দাবী ঠিক-ঠাক আদায় করতে পারবে?


মনে রাখতে হবে, ইসরেল শক্তিশালী। তাদের মেধা, বুদ্ধি, পেশী সবই উন্নত। আপনি যদি জেনে বুঝে একজন সাহসী, কৌশলী, বুদ্ধিমানের সংগে মারামারি করতে যান কোন যুক্তি বা বুদ্ধি ছাড়া- তখন কি পারবেন? না কি উল্টো মার খেয়ে আসবেন? সেটাই হচ্ছে। আপনাকে কৌশলী হতে হবে। স্টেনগানের বিরুদ্ধে পাটকেল নিয়ে যুদ্ধ করতে যাবেন- আর বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবেন- এমনটা ভাবা শুধু বোকামী নয়, পাপও।


ফিলিস্তিনিরা ঠিক সেটাই করছে?তারা শুধুমাত্র বোকামীই নয়, পাপও করছে।
একটি দেশর সংগে কুটনৈতিক সম্পর্ক না রেখে তার থেকে কোন দাবী আদায় করা সম্ভব নয়। তাকে বশে আনতে হবে। তার সংগে সম্পর্ক রাখতে হবে। তার থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে হবে। তাকে দিয়ে কৌশলে কাজ আদায় করে নিতে হবে।


বিষয়টা অনেকটা এরকম।ছোট বেলায় দেখতাম আমাদের গ্রামে দু’টো সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের সমাজের একজন আমার এক বৃদ্ধ দাদা ছিলেন আমাদের সমাজপতি। তিনি করতেন কি, সমাজের কেউ পান থেকে চুন খসলেই তাকে ‘একঘরে’ করে দিতেন। তারপর ঐ লোক তার পরিবার নিয়ে কিছুদিন চুপচাপ থাকতো, এবং কোন এক ঈদের আগে অন্য সমাজে চলে যেতো। ব্যস হয়ে গেল! আমি সেই কিশোর বয়সেই আমাদের দাদার এই ‘মুর্খামী’ দেখে হাসতাম। আর বলতাম, এসব ভিত্তিহীন সমাজব্যবস্থার আদৌ কি কোন প্রয়োজন রয়েছে? আসলে আমাদের দেশটাই গড়ে উঠেছো আমার ঐরকম দাদাদের বুদ্ধিতে। ওরমক দাদারাই বাংলাদেশের জাতীয় ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করে। এরা ঐ ‘একঘড়ে’ করে দেয়া ছাড়া আর কি বুঝবে- এরা?


বাংলাদেশের সংগে ইসরেল এর কোন কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই। (যদিও ভুটানের পরেই ইসরেল-ই ছিল বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় দেশ।) কিন্তু তাই বলে কি ইসরেলী ‘বুদ্ধিদীপ্ত প্রডাক্ট’ বাংলাদেশে আসা বা ইমপোর্ট করা বন্ধ রয়েছে? আমি নিজে শত শত ‘ইউরোটেক’ সিংগাপুর দিয়ে ইমপোর্ট করেছি ইসরেল থেকে। যার একএকটা ইউরোটেকের মূল্য ছিল ১২ লাখ টাকা করে। বন্ধ ছিল কি ব্যবসা? তাদের তৈরী প্রডাক্ট বিশ্ব সেরা। আমেরিকান অনেক বুদ্ধিদীপ্ত প্রোডাক্টই ইসরেলী প্রোডাক্টের কাছে মার খায়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে ইসরেলকে একঘরে করে রাখা মানে নিজেকেই বিচ্ছিন্ন করে রাখা। বাংলাদেশের মতো দু’চারটে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ওয়ালা দেশ ইসরেলকে বয়কট করলে তাতে ইসরেল এর কিছুই যায় আসে না। বরং যায় আসে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোরই।


আরব রাষ্ট্র জর্দান, আজকের কথিত ইসলামী দেশগুলোর নেতা তুরস্ক, এবং মিশরও ইসরেল এর সংগে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে বহু বছর হলো। ভারত নিজেও একটা সময় পর্যন্ত ইসরেল এর সংগে কুটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রেখেছিল, কিন্তু নব্বই দশকের শুরুর দিকে তারা ইসরেলকে স্বীকৃতি দেয়। এখন স্বীকৃতি দিয়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন কতে যাচ্ছে আরব আমিরাত সহ আরও ৫টি মুসলিম প্রভাবশালী দেশ খুব শিগগিরই।


আজ যদি ঢাকায় ইসরেলী দুতাবাস থাকতো, আর ইসরেল যখনই কোন ফিলিস্তিনের সাথে অন্যায় নির্যাতন চালাতো বা অন্যায় করতো- আমরা যদি মিছিল নিয়ে ইসরেলী দুতাবাসে যেতাম; সেটাতে কি বেশী টনক নড়তো না? এখন আপনি ঢাকায় ইসরেলের পতাকা পুড়িয়ে বা গালি দিয়ে কাকে শোনাবেন? নিজের গালিতো নিজেই শুনতে হবে- না কি?
আজ আপনার সংগে যদি আমার মুখ দেখাদেখি না থাকে, কোন কথা না হয় যদি- তাহলে আপনি কিভাবে আমার কাছে আপনার দাবী দাওয়া জানাবেন? অন্য একজনের মধ্যেমে? সেটটা কি হয়! আপনি অন্যের মাধ্যমে দাবী জানাবেন- আর আপনার সেই দাবী অন্যের মুখ থেকে একই আন্তরিকতা নিয়ে আসবে বা মাঝখানে তার স্বার্থ সেই দাবীতে সংযুক্ত হবে না- সেটা কি হয় কখনও?


তারচে বরং এটাই কি সুন্দর নয় যে, আমার সংগে সম্পর্ক রেখে আমাকে চাপে ফেলে দাবী জানানো। আমার সংগে কৌশলে দর কষাকষি করে দাবী আদায় করে নেয়া? কোনটা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত?


আমেরিকা বাংলাদেশকে কয়েকবার একটি প্যাকেজ ডিল এর মাধ্যমে বেশকিছু সুযোগ সুবিধা ও আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে ইসরেল এর সংগে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমরা ভাব দেখিয়েছি। কি লাভ হয়েছে সেই ভাব দেখিয়ে? ফিলিস্তিন কি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে?


নাকি পাবে কখনও আমেরিকা বা বিশ্ব শক্তির সহায়তা ছাড়া?বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় কখনোই তা সম্ভব নয়। দু’চারটে ইট বা পাটকেল ছুড়ে দেশ স্বাধিন হয় না অন্তত পক্ষে ইসরেল এর মতো বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী দেশটি যখন প্রতিপক্ষ।
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন হতে হলে- বিশ্বশক্তিকে কৌশলে বসে এনে স্বাধীন করতে হবে। ফিলিস্তিন বর্তমানে যে পথে হাঁটছে সে পথ কোন যুক্তির পথও নয়, কৌশলেরও পথ নয়। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলি ইসরেল-ফিলিস্তিন খেলায় শুধুই ‘ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা’ মাত্র।


আমাদের ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলার জন্য হলেও ইসরেল এর সংগে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে হবে। এখন তো আমরা ইসরেল এর সংগে কথাও বলতে পারি না- দাবী জানাবো কিভাবে?


আপনি আমেরিকা-বৃটেন এর সংগে বন্ধুত্ব গড়বেন কিন্তু যে ইসরেলকে তৈরী করলো আমেরিকা-বৃটেন, যে ইসরেলকে চালিত করে আমেরিকা, যে ইসরেল এর রাজধানী ঠিক করে দেয় আমেরিকা- সেই ইসরেলকে শত্রু ভাববেন- এটা কি দ্বিচারিতা হয়ে গেল না?
এছাড়া ইসরেল এর সংগে সম্পর্ক না হলে, দু’পাশে ভারত ও মায়ানমার ইসরেলকে কাছে টেনে বাংলাদেশকেই বরং আরও চেপে ধরবে। কোন কুলই আমরা ফিরে পাবো না। সম্পর্ক হলে, সম্পর্কের খাতিরেও অন্তত ইসরেল বাংলাদেশের সংগে সুসম্পর্ক রাখতে চাবে। মনে রাখতে হবে মিয়ানমার বা ভারত ইসরেলকে নিয়ে খেলে না; বরং ইসরেলই ভারত-মিয়ানমারকে খেলে দেয়।


হাজারটা বোকা বন্ধুর চেয়ে একজন বুদ্ধিমান কৌশলী মানুষের সংগে সম্পর্ক রাখাটাই সেরা সিদ্ধান্ত।

   Send article as PDF