সৌদী আরবের অভিজ্ঞতা

কুয়ালা লামপুরের বিশাল (কুয়ালা লামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বা KLIA) বিমানবন্দরটি সত্যিই অনেক বিশাল এবং ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। দেখতেও অসাধারণ সুন্দর, এর ভেতরের পরিবেশও মনোরম, সার্ভিস দারুন।

যাই হোক, এয়ারপোর্টটির ব্যস্ততা বেড়ে গেলে বর্তমান এই এয়ারপোর্টটির সংগেই মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ আরও একটি এয়ারপোর্ট তৈরী করে যার নাম দেয়া হয় – কুয়ালা লামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট-২ বা KLIA-2; বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক এবং সুন্দর। সভ্যতার পরিচায়কও।

অর্থাৎ আপনি কোথায় বা ঠিক কোন এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন- সেখান থেকে ট্রানজিট নিতে পারবেন কি না ইত্যাদি খুব সহজেই বুঝে ফেলবেন। যেহেতু দু’টি ভিন্ন এয়ারপোর্ট সেহেতু আপনি যদি অন্য এয়ারপোর্ট থেকে ট্রানজিট নিতে চান তাহলে আপনাকে মালয়েশিয়ার ফর্মাল এন্ট্রি করে তারপর অন্যটিতে যেতে হবে। অর্থাৎ আপনার মালয়েশিয়ার ভিসা থাকতে হবে। কিন্তু যদি আপনি সেইম এয়ারপোর্ট থেকে ট্রানজিট নিতে চান তাহলে কিন্তু আপনি মালয়েশিয়ার ভিসা না নিলেও কোন সমস্যা হবে না।

এবং কুয়ালা লামপুর এয়ারপোর্ট দু’টো থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ‘কেএল সেন্টার’ যাবার জন্য ৩০ মিনিট পরপর স্পেশাল শ্যাটল ট্রেন রয়েছে। এমনকি আপনি চাইলে সেই ’কেএল সেন্টার’ স্টেশন থেকেই যে-কোন এয়ারলাইন্স এর বোডিং পাশ নিয়ে নিতে পারবেন; তাদের কাছেই লাগেজ বুকিং দিয়ে দিতে পারবেন।

আমেরিকার নিউ ইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্ট (JFK) এর নাম শুনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। এয়ারপোর্টটি খুবই ব্যস্ত; এমনকি প্রতি মিনিটে এই এয়ারপোর্টটি থেকে ৪ টি ফ্লাইট ওঠা-নামা করার রেকর্ডও রয়েছে। তাহলে বুঝুন কতটা ব্যস্ত এয়ারপোর্ট এটি। কেনেডি এয়ারপোর্টে মোট ৮টি বিশাল টার্মিনাল রয়েছে।

যাই হোক, তারপরও এই একটি এয়ারপোর্ট দিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটির এয়ার সার্ভিস কুলায় না। (আমি কিন্তু নিউ ইয়র্ক স্টেট এর কথা বলছি না- নিউ ইয়র্ক স্টেট এ ১৬২টা এয়ারপোর্ট রয়েছে।) আমি বলছি শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক সিটির কথা। নিউ ইয়র্ক সিটি আমেরিকার সবচে ব্যস্ততম এবং জনবহুল সিটি। ৫টি বরো বা কাউন্টি নিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটি অবস্থিত।

আর এই নিউ ইয়র্কে সিটির কুইন্স কাউন্টিতেই রয়েছে আরও একটি এয়ারপোর্ট যার নাম লা গুরডিয়া এয়ারপোর্ট (LGA)। কিন্তু তাতেও নিউ ইয়র্ক সিটির চলে না। আর সেজন্য এই সিটির জন্য আরও একটি বড় এয়ারপোর্ট তৈরী করা হয়েছিলো যেটা টেকনিক্যালী নিউ ইয়র্ক এর বাইরে নিউ জার্সীতে অবস্থিত। এটার নাম নিইয়ার্ক লিবার্টি এয়ারপোর্ট (EWR)।

অনেকেই হয়তো জানেন না যে নিইয়ার্ক এয়ারপোর্টটি নিউ জার্সীতে হলেও এটা আদতে নিউ ইয়র্কের একটি এয়ারপোর্ট। এবং এই ৩টি এয়ারপোর্টকেই ১টি এয়ারপোর্ট হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এর পরিচালনা কমিটিও একটি।

একটি হলেও সকলের বোঝার সুবিধার্থে ৩টি নামে ৩টি ভিন্ন এয়ারপোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। কারো বিভ্রান্ত হবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

বেইজিং শহর কর্তৃপক্ষ এই তো সেদিন আরও একটি বিশাল এয়ারপোর্ট তৈরী করেছে – Beijing Daxing International Airport (PKX) নামে যদিও একটু কাছেই বিশালাকার পুরাতন Beijing Capital International Airport (PEK) টি এখনও সচল রয়েছে। এয়ারপোর্ট দু’টির দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার বা ২০ মাইল। নাম ভিন্ন, এয়ারপোর্ট কোডও ভিন্ন। পুরাতন এয়ারপোর্ট পিকিং এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত। আর নতুনটি তৈরী হয়েছে মাত্র ৩ বছর আগে। পিকিং এয়ারপোর্টে আমার পা করেছে কম করে হলেও ১০ বার। নতুনটি দেখার সুযোগ হয়নি এখনও। যাই হোক, দু’টো এয়ারপোর্টই রাজধানী বেইজিং শহরে অবস্থিত একটি PEK এবং অপরটি PKX নামে চিহ্নিত; বিভ্রান্ত হবার বিন্দুমাত্র চান্স নেই।

সেকেন্ড নিউ ইয়র্ক শহর হিসাবে খ্যাত স্যাংহাই শহরেও ২টি বিশাল এয়ারপোর্ট অবস্থিত। এর একটি Shanghai Pudong International Airport (PVG) অন্যটি Shanghai Hongqiao International Airport (SHA)। দু’টি এয়ারপোর্টের দূরত্বও খুব একটা বেশী না। কিন্তু আপনি সহজেই PVG বা SHA দিয়ে বুঝে ফেলতে পারছেন কোথায় যাচ্ছেন বা কোথায় ল্যান্ড করছেন।

বিশ্বব্যাপী এভাবেই এয়ারপোর্টগুলো চিহ্নিত।

মানুষ এইভাবেই চলাফেরা করে। বুঝে ফেলে কিভাবে কোথায় যাতায়াত করতে হয়।

আমার মার বয়স ৭০+; তিনি কখনওই ইতিপূর্বে বিমান ভ্রমণ করেননি বা বিদেশেও যাননি। আর তাই মার সংগে আমার ছোট আপা এবং পন্ডিত দু’জনেও উমরাহ করার জন্য জেদ্দা আসবেন – তাদেরও বিমানে বা বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের সংগে আমার দেখা হবে জেদ্দা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যার এয়ারপোর্ট কোড JED এবং আমি এই JED কোড দেখেই বিমানের টিকেট পার্সেস করেছি।

আমি দুবাই থেকে সৌদী আরবের রাস্ট্রিয় এয়ারলাইন্স সংস্থা ফ্লাইনাসের একটি ফ্লাইটে জেদ্দা (JED) ল্যান্ড করবো সন্ধ্যা সাড়ে ৯টায়। এবং আমার মা জেদ্দা (JED) এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে রাত সাড়ে ১০টায়। আমার হিসাব অনুযায়ী আমি ১ ঘন্টা ওয়েট করবো এবং এক সংগে সকলে ইমিগ্রেশন শেষ করে গাড়ী নিয়ে হোটেলে যাবো।

সৌদী আরব সম্পর্কে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। যেহেতু তেল বেচা একটি দেশ, ট্রিলিয়ন ডলার ফ্যামেলি হিসাবে সৌদী রাজার পরিবার স্বীকৃত সেহেতু আমার বিশ্বাস ছিলো দেশটি যথেষ্ঠ উন্নত। তাছাড়া কতটা উন্নত হলে একটি দেশ ৩১৯ বিলিয়ন ডলার খরচা করে নিওম নামে উচ্চাভিলাসী একটি শহর তৈরীর কাজ শুরু করতে পারে সেটাও আমি বুঝি এবং যার ইস্টমেট বাজেট ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু তারপরও আমার মনের কোথায় যেন একটু খুঁত খুঁত করছিলো। আমি জানি আমার মনে যদি কিছু আসে – তাহলে তার কোন কারণ থাকে। আমি ভাবছিলাম আমার মা, আপা, দুলাভাই সৌদীতে এসে কোন বিপদে পরবে না তো? হয়তো দেখা গেলো তারা সঠিক সময়ে ল্যান্ড করেছে – কিন্তু আমার ফ্লাইটে দুবাই থেকে কোন সমস্যা হয়েছে। তখন তারা ৩ জন জেদ্দা এয়ারপোর্টে নেমে কি করবে? তারা একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলেও পৌছতে পারবে বলে আমার মনে হচ্ছিল না। তারা তো বিপদে পরবে।

সুতরাং তারা যেন কোন রকম অযাচিত বিপদে না পরে সেটা চিন্তা করে আমি জরুরী ভিত্তিতে একটি ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সীমকার্ড ব্যবস্থা করে আমার বোনকে দিয়ে দিই। এবং আমি যেহেতু আমেরিকার টি-মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করি এবং এটা পুরো পৃথিবীর সকল দেশের সকল নেটওয়ার্ক এই কাজ করে সেহেতু তাদের হাতে একটি একটিভ নাম্বার থাকলে যে-কোন অযাচিত সমস্যাকেই আমি তুরি মেরে সমাধান করে দিতে পারবো।

আমার ফ্লাইট জেদ্দা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো যথা সময়ে অর্থাৎ সাড়ে ৯টায়। এয়ারপোর্টটি ছোট হলেও সুন্দর। আমি ল্যান্ড করলাম টার্মিনাল-১ এ। আর আমার মাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এর ফ্লাইটটি ল্যান্ড করবে সেইম এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-এন এ।

আমি এয়ারক্রাফট থেকে বের হয়ে টার্মিনাল ’এন’ এর কোনও ডিরেকশন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যেহেতু একটাই এয়ারপোর্ট, একটাই কোড (JED) সেহেতু নিশ্চয়ই আমি টার্মিনাল এন খুঁজে পাবো। কিন্তু পাচ্ছিলাম না।

বাধ্য হয়ে এয়ারপোর্ট অথিরিটির কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলাম যে ‘টার্মিনাল এন’ কোথায় বা কিভাবে যাবো?

কিন্তু ভন্দরনোকেরা কেউ ‘ইংরেজী’ বুঝে না।

প্রায় ১৫ মিনিট বিভিন্ন লোককে জিজ্ঞেস করলাম এবং কোন একজন ভদ্দরনোকও ইংলিশ এর একটি আলফাবেটও জানে না।

যাই হোক, অবশেষে একজন পুলিশের দয়া হলো হয়তো। তিনি আমাকে হাতের ইশারায় তাকে ফলো করতে বললেন। আমাকে একটি কামড়া দেখালেন যেখানে ইংলিশে লেখা ছিলো ‘অন-এরাইভাল ভিসা’। আমার মনে সাহস উদয় হলো। এরা তো ইংলিশ জানবেই।

৪/৫ টি পিচ্চি পিচ্চি সৌদী কভার করা মেয়ে বসে আছে। আমি রুমে ঢুকে জানতে চাইলাম – ‘এটা জেদ্দা এয়ারপোর্ট কিনা এবং এখানে আমি যেহেতু টার্মিনাল ১ এ আছি; টার্মিনাল এন এ কিভাবে যাবো?’

ওনারা ’টার্মিনাল এন’ বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে বলে জানে না। আমি তাদেরকে আমার আইফোন থেকে বিমান বাংলাদেশ যে টার্মিনাল এন এ ল্যান্ড করবে এবং সেটা এই একই এয়ারপোর্টে (JED) – তাদের দেখালাম। কিন্তু তারপরও তারা কিছুই জানে না। তারা আমাকে কোন উপদেশও দিতে পারলো না। এবং কার্টেসি স্বরূপ কোনরকম ‘সরি’ও বললো না।

আমি বিভ্রান্ত।

যেই আমি এই পৃথিবীর কমচে কম ৩৫টা দেশ ভ্রমণ করেছে; ৫ হাজারের বেশী শহরে গিয়েছে; ২০০ উপরে এয়ারপোর্ট ক্রস করেছি – সেই আমি আজ জেদ্দা এয়ারপোর্টে বিভ্রান্ত! এখানে কোন কুল নেই, কিনার নেই!

আমার অবচেতন মন আমাকে সেল্পগাইড করলো।

বুঝতে পারলাম আমি আজ বিশ্বের সবচে ‘অসভ্য’ ও ‘অশিক্ষিত’ একটি দেশে এসে পৌছেছি। আগে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হবে এবং বাংলাদেশ বিমানের ল্যান্ডিং পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ইমিগ্রেশন শেষ করে বের হলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার মেয়েটিও কোন তথ্য দিতে পারলো না – তারাও ইংলিশ জানে না। পাসপোর্টে এন্টি্র সীলে ডেট লিখলো হিজরী সাল হিসাবে এবং আরবীতে।

ল্যাগেজ সংগ্রহ করে ভাবছিলাম কি করবো; তখনও সাড়ে ১০টা বাজেনি। আমি কোন বিপদে ঘাবড়াই না; বরং এনজয় করি বিপদকে। আজও এনজয় করছিলাম কিন্তু একটা ভয় হচ্ছিল আমার মাকে নিয়ে – ওনি তো ধকল সইতে পারবেন না। যাই হোক আমি জানি যে-কোন বিপদ-ই অস্থায়ী এবং তা কাটবেই। সুতরাং টেনশন করার কিছু নেই।

দূরে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন অল্পবয়সী ’ক্লিনার’ বাংলায় কার সংগে যেন ফোনে কথা বলছে। আমি ল্যাগেজ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির কাছে গেলাম। তার ফোন শেষ হবার পর তাকে সালাম দিয়ে আমার ডিটেইল সমস্যাটি তাকে বোঝালাম এবং জানতে চাইলাম টার্মিনাল এন কোথায়?

ছেলেটি খুব সুন্দর করে আমাকে বললো, ‘বাংলাদেশ বিমান তো এই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে না। ওটা তো অন্য একটি এয়ারপোর্ট।’

’মানে? তাহলে ঐ এয়ারপোর্টের নাম কি?’ জানতে চাইলাম।

’ওটাও জেদ্দা এয়ারপোর্ট; এরম আরও ২টি এয়ারপোর্ট আছে জেদ্দায়। সবগুলির একই নাম। বিমান ল্যান্ড করে যেটিতে ওটা এখন থেকে ৩০/৩৫ কিলোমিটার দূরে।’

’আমি ওখানে কিভাবে যাবো? কোন শ্যাটল ট্রেন বা বাস রয়েছে ওটাতে যাবার?’ জানতে চাইলাম ছেলেটির কাছে।

ও বললো, ‘নাহ। নেই। আপনাকে ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হবে। ৩০ কিলোমিটারের ভাড়া ২০ রিয়ালও হবে না কিন্তু এরা কেউ ১০০ রিয়াল এর কমে যাবে না।’

যাই হোক, আমি বুঝে ফেললাম আমার কি করনীয়।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গেলাম। অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি একটু শব্দ করেই বললাম, ‘যে ইংলিশ জানো না সে আমার সামনে থেকে সড়ে যাও। শুধুমাত্র ইংলিশ জানা কেউ থাকলে আমার সামনে আসো।’

মধ্য বয়স্ক একজন আরবী ড্রাইভার এগিয়ে আসলো। একটু ভাংগা ইংলিশে সে অত্যন্ত ভদ্রভাবে নিজের নাম বলে বললো, ’আমাকে বলো – আমি ইংলিশ বুঝি।’

তাকে আমি বুঝিয়ে বললাম, যে আমি ’বাংলাদেশ বিমান’ যে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে সেই এয়ারপোর্টে যাবো; ওখানে আমার মা সাড়ে দশটায় ল্যান্ড করবে; তাদের নিয়ে মক্কা শরীফের লাগোয়া ‘ইলাফ কিন্ডা হোটেলে’ উঠবো।

সে বললো, ৪০০ রিয়াল হলে সে যাবে।

আমি তার সংগে কোন দরদাম না করে তার ট্যাক্সিতে (মাইক্রো বাস) উঠে বসলাম।

ততক্ষনে বিমান ঐ এয়ারপোর্টটিতে ল্যান্ড করেছে। আমার বোনের সংগে কথা হয়েছে। তাদের এডভাইস দিলাম তারা যেন ইমিগ্রেশন করে লাগেজসহ বের হয়ে আসে – আমি ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করবো।

আমার ড্রাইভারটা বেশ ভদ্র ও হেল্পফুল ছিলো।

ড্রাইভারই আমাকে জানালো যে, মক্কা শরীফ লাগোয়া আয়েশা মসজিদ শুধুমাত্র মক্কার অধিবাসীদের জন্য ‘মিকাৎ’ হিসাবে গন্য হবে। মক্কার বাইরে থেকে কেউ উমরাহ বা হজ্জ করতে আসলে তাকে নির্ধারিত মিকাৎ থেকে ইহরাম বাধতে হবে। আমি যেহেতু মক্কায় প্রথম তাই আমি আয়েশা মসজিদে ইহরাম বাধতে পারবো না। আমাকে যেতে হবে তায়েফ মিকাতে যা এখন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। বিস্তারিত বোঝানোর জন্য ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিলাম। ২০০ রিয়ালের ভাড়া ৪০০ রিয়াল দেবার কস্ট দূর হয়ে গেলো মন থেকে।

জেদ্দা ঐ এয়ারপোর্টের গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। ড্রাইভার তার নাম্বার আমাকে দিয়ে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। এই এয়ারপোর্টটি ঢাকার এয়ারপোর্ট এর চেয়েও ছোট, অনুন্নত ও বিশ্রী দেখতে। অপরিচ্ছন্ন। নোংরা। এবং এখানকার কর্মচারী ও পুলিশ-সিকিউরিটির আচরণ আরও নিম্নমানের। বাংলাদেশের আওয়ামী পুলিশের আচরণ আরও উন্নত। আওয়ামী পুলিশ তবুও ইংলিশ জানে, অনুরোধ করলে সহযোগীতা করে। এরা তাও জানে না বা সহযোগীসুলভ মানসিকতা ওদের নেই।

আমাকে গেট থেকে তাড়িয়ে দিলো।

দূরে অপেক্ষা করতে বললো আরবী ও হাতে ঈশারায়।

আমি দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এই গেট দিয়ে যাত্রীরা বের হয়ে ১০ মিনিট হেঁটে আমাকে ক্রস করেই গাড়ী নিবে। সুতরাং আমার মাও এখান দিয়েই আসবে।

অনভিজ্ঞ মা-আপু-দুলাভাই অনেকটা সময় নিয়ে প্রায় ১-দেড় ঘন্টা পর বের হলো। এবং ঠিক তখনই সিকিউরিটি কিছু ছেলে তাদের অন্য দিক দিয়ে যেতে নির্দেশ দিলো – যে দিকে গেলে মিনিমাম ১ কিলোমিটার হাঁটতে হবে – যা আমার মা’র পক্ষে অসম্ভব।

দীর্ঘ ৮ বছর পর আমার মাকে দেখলাম দূর থেকে। দৌড়ে গেলাম। সিকিউরিটিকে রিকোয়েস্ট করলাম আমার মা বৃদ্ধ এবং অসুস্থ, তিনি এতটা ঘোরা পথে হাঁটতে পারবেন না; অনুগ্রহ করে অনুমতি দিলে তাকে এই সোজা পথ দিয়ে নিয়ে যাই।

৪/৫ জন সৌদী সিকিউরিটি দৌড়ে আসলো আমার দিকে। আরবীতে গালাগাল করতে লাগলো; মনে হচ্ছিলো আমাকে হয়তো ধরে মাইর-ই দিবে।

মা আমার সামনে।

৮ বছর পর দেখা অথচ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

মুহাম্মদ (সা) নাকি আরবদের গালী দিতে নিষেধ করেছেন।

আমি এই নিষেধাজ্ঞা মানতে অপারগ; মুখে গালি উচ্চারণ করার সক্ষমতা হারিয়েছি আর ৩ যুগ আগেই। কিন্তু অন্তর থেকে এই জাতির উপর যে গালীগুলো নির্গত হচ্ছিল অবচেতন মনে – তা ঠেকানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না।

আমার অতি প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এর এই নির্দেশ (আমি জানি না এটা কতটুকু সত্য!) আমাকে ব্যথিত করেছে। এই নির্দেশনা বরং এই জাতিটিকে আরও উগ্র হতে সাহায্য করে চলছে। উৎশৃঙ্খল করেছে এই জাতিকে; মহান ইসলামকে ক্ষুদ্র করেছে।

পবিত্র ভূমিতে নিজের পকেটের হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে উমরাহ করতে এসে এই মুর্খ অসভ্য জাতির এমন ব্যবস্থাপনা, এমন নিম্নশ্রেনীর আচরণ আমাকে ব্যথিত করেছে।

অনেক কস্টে আমার অসুস্থ মাকে দীর্ঘ পথ হাঁটিয়ে ঘোর পথে গাড়ীর কাছে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। ওখানে হুইল চেয়ারের কোন ব্যবস্থাও ছিলো না।

যাই হোক, মক্কায় পৌছে আরেক বিড়ম্বনা।

এমনিতেই মক্কা শহরে কোন এয়ারপোর্ট নেই। জেদ্দায় বিভ্রান্তকর এয়ারপোর্ট, অসভ্য আচরণ তার উপর আরও প্রায় দেড়শ কিলোমিটার রাইড। রাস্তাও যথেষ্ঠ ভালো নয়।

আমার হোটেলটি একটি ফাইভ স্টার হোটেল যা হারাম শরীফ লাগোয়া। কিন্তু অনেক দূর থেকেই গেট বন্ধ করে দেয়া। আমার ড্রাইভার পুলিশকে অনেকভাবে বোঝালো যে ঐ হোটেলে আমরা যাবো, এতোগুলো লাগেজ নিয়ে অসুস্থ বয়স্ক মানুষগুলো হেঁটে যেতে পারবে না। যাই হোক, আমার ড্রাইভার অনেক কস্টে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে এবং জোর করে বাধাযুক্ত রাস্তা পার হয়ে আর কাছে পৌছলো এবং আমাকে বললো হোটেলের বয়দের নিয়ে আসতে যারা ল্যাগেজ ক্যারী করে নিয়ে যাবে।

রাত প্রায় দেড়টায় হোটেলে পৌছলাম।

আমার পন্ডিত দুলাভাইও ক্লান্ত। তিনি ইহরামের পোষক পরে এসেছিলেন ঢাকা থেকে। মা, আপাও ইহরাম বেঁধে ছিলেন – এসেই উমরাহ করবেন।

আমি অভিজ্ঞ মানুষ।

আমি জানতাম, দুবাই থেকে ইহরাম বেঁধে যাওয়াটা আমার জন্য বোকামী হবে। আমি ইহরাম বাঁধিনি।

দুলাভাই বললেন, ‘আজ আর আমার পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব না। একটু ঠিক হই, তারপর মিকাতে যেয়ে ইহরাম বেঁধে এক সংগে উমরাহ করবো।

আমার মা বললেন, ২/৩ দিন রুমে শুয়ে রেস্ট নিতে পারলে তিনি ঠিক হয়ে উঠবেন।

মহান আল্লাহ ২ দিনের মধ্যে আমার মাকে সুস্থ করে দিলেন। তৃতীয় দিন তায়েফ মিকাতে গিয়ে ইহরামের নিয়ত করে হারাম শরীফে উমরাহ পালন করলাম। এর মধ্যে লক্ষ্য করেছি ২-৩ ঘন্টা পরপর কোন কারণ ছাড়াই হারাফ শরীফে ঢোকার রাস্তা বন্ধ বা ঘুরিয়ে দেয়া হয়। মানুষের কস্টকে ওরা থোরাই কেয়ার করে!

মা’র পক্ষে হেঁটে কস্টকর ইবাদত উমরাহ পালন সম্ভবপর ছিলো না। একজন আরবী হুইলচেয়ারওয়ালাকে পেলাম। ২০০ রিয়েল এর বিনিময়ে সে মাকে হুইল চেয়ারে করে ওমরাহ করিয়ে দিবে। সৌদী আরাবিয়ান লোকটা ইংলিশ জানে না কিন্তু সে আরবী ও ইশারায় আমাকে সুন্দর করে সব বোঝাচ্ছিল।

এবং মার কাছে জেনেছি সে সত্যি সত্যিই খুবই আন্তরিকতা দিয়ে মাকে হুইল চেয়ারে নিয়ে উমরাহ পালন করিয়েছেন। মা তার উপর খুবই সন্তুষ্ট, আমিও খুশী।

মক্কার সাধারণ আরবী মানুষগুলোকে আমার কাছে বেশ ঠান্ডা এবং ভালো মনে হয়েছে। কিন্তু অফিসিয়ালী সৌদী আরব একটি অসভ্য দেশ। নষ্টদের দেশ।

হতবাক হই আমি যে, পুরো পৃথিবী থেকে যে শহরে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ উমরাহ ও হজ্ব করতে আসেন, সৌদী সরকার ট্রিলিয়ন ডলার আয় করে সে মক্কা শহরকে কেন্দ্র করে সেই মক্কা শহরে একটি এয়ারপোর্ট নেই। দেড়শ কিলোমিটার দূর থেকে কস্ট করে কোটি কোটি মানুষকে গাড়ীতে করে মক্কায় আসতে হয়। আর হারাম শরীফের আশে পাশের রাস্তাঘাট ফুটপাত ঢাকার রাস্তা-ফুটপাতের চেয়েও অনুন্নত, অপরিচ্ছন্ন, অগোছালো।

একটা জাতি কিভাবে এতটা অসভ্য হতে পারে?

আমার বুদ্ধিতে কুলায় না।

   Send article as PDF