চাপ্টার টু

শরীর এবং মন দু’টোই বেশ হালকা লাগছে।
 
চোখ খুললাম। রুমে আলো জ্বলে উঠলো কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই। আমি একটু চমকে উঠলাম। মনে হলো আমার চোখের সংগে আলো জ্বলার একটা সম্পর্ক রয়েছে।
 
আচ্ছা মেয়েটি কত সাল বললো যেন? ২১১৪!
ওহ মাই গড! কিভাবে সম্ভব? আমার বয়স কিভাবে ১৩৮ হয়ে গেল!
 
আমার একটা মিরর দরকার। নিজেকে দেখতে হবে।
কেবিনটাতে তো কোন মিরর দেখছি না।
 
আমার কোন ঘড়ি নেই? আচ্ছা আমার মোবাইল ফোন?
আমি তো আইফোন ব্যবহার করি। আমার আইফোনটা কোথায়? পরিস্কার মনে আছে আছে ওটা আইফোন সেভেন প্লাস। আমার বালিশের নীচে খুঁজলাম। নাহ্ নেই তো!
 
মেয়েটা কোথায়?
মেয়েটাকে খুঁজতে হবে?
 
‘এক্সকিউজ মি। এনিবডি ইন এরাওউন্ড মি?’ আমি উচ্চারণ করলাম।
১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড এর মধ্যে সেই স্টেজটাতে একটা মেয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটা কোথাও থেকে আসলো বলে মনে হলো না। মনে হলো হঠাৎ উৎপত্তি হলো মেয়েটির। হ্যাঁ, গতকালের সেই মেয়েটাই।
 
‘গুড মর্নিং; আমায় ডাকছেন, স্যার?’ সেই মিষ্টি হাসি মেয়েটার ঠোঁটে। ‘আপনার ঘুম হলো? ভালো আছেন? হ্যাপী বার্থডে টু ইউ স্যার’। আজ লাল একটা শাড়ী মেয়েটার শরীরে।
 
‘আপনার নাম কি?’ আমি প্রশ্ন করলাম। ‘আচ্ছা, আমার আইফোনটা কোথায় বলতে পারেন? ফোনটা দরকার। সবার সংগে একটু কথা বলবো।’
 
মেয়েটার মুখের হাসি কমেই না।
‘স্যার আপনি ব্রেক ফাষ্টে আজ কি নিবেন? আপনার ডাক্তার বাবু আসছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনিই অবশ্য মেনু ঠিক করে দেবেন- তারপরও আপনার পছন্দ থেকেই সেটা করা হবে। তবে আমার কাছে যতটুকু ইনফরমেশন রয়েছে তাতে আপনাকে সকালে পুরো ৫০০ ক্যালরীই দেয়া হবে। তারমধ্যে ১৫০ ক্যালরীর প্রটিন, আড়াইশ ক্যালরী আসবে কার্ব থেকে এবং বাকী ১০০ দেয়া হবে ফ্যাট থেকে। অফিসিয়াল আপনাকে আজই পূর্ণ মাত্রার ক্যালরী সবরাহ করা হবে।’ থামলো মেয়েটি।
 
‘আপনি কিন্তু আপনার নাম বলেন নি আমকে?’ আমি ওর দিকে গুরুত্ব দিলাম।
 
মেয়েটি আবারও হেসে দিল। ‘স্যার, আপনি যে কোন একটা নাম দিয়ে দিন আমাকে। আমার অফিসিয়াল নেইম আইকে২৬০৭এক্সওয়াইডিসি। এটা একটা ইউনিক রোবটিক নেইম। আপনি আমাকে আপনার মনের মতো করে কাষ্টমাইজড করে নিতে পারবেন।’
 
আমি মেয়েটার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বলছে সে এসব? ‘আমাকে কি প্লিজ আমার আইফোনটা একটু দিবেন?’ আমি চেচিয়ে উঠলাম অনেকটা।
 
‘স্যার। আমার কাছে যা তথ্য রয়েছে- সেমতে, আপানার আইফোনটি এখন আর চলবে না। কারণ ওগুলি শত বছরের পুরাতন হার্ডওয়ার তাছাড়া ওটার ওএসও পুরাতন এবং বাতিল। ওসব টেকনোলজী এখন আর ব্যবহৃত হয় না। তাছাড়া ডিভাইসটাও নষ্ট হয়ে আছে। আপনার জন্য নতুন ‘ওয়ান কার্ড’ ডিজাইন করা হয়েছে। আমাদের ম্যানেজমেন্ট এর প্রেসিডেন্ট আজ আপনার হাতে সব তুলে দেবেন। আপনি ব্রেকফাষ্ট করার পর ওনি আসবেন।’
 
‘আমি বাথরুমে যাবো।’
‘জ্বী স্যার। আপনি আজ হেঁটেই বাথরুমে যেতে পারবেন। আপনার বাঁ দিকে বাথরুম। আপনি নামুন স্যার।’
 
আমি পা দু’টো নামালাম বেড থেকে। আমার হাতের সামনে একজোড়া নতুন সকস্। আমি সকস জুড়া পায়ে পরে নিলাম। স্বাভাবিকভাবেই বেড থকে নীচে নামলাম।
 
আমি বাথরুমে ঢুকলাম।
বাথরুমে ঢুকার সংগে সংগে অটোমেটিক বাতি জ্বলে উঠলো।
আমেরিকার বাথরুমগুলি এমনিতেই খুব পরিচ্ছন্ন ও গোছানো থাকে। এটা আরও বেশী পরিচ্ছন্ন। মেঝোতে লাল কোমল কার্পেট বিছানো।
 
হঠাৎ মিরর এর দিকে আমার দৃষ্টি গেল। মিরর এর সামনে গেলাম। আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। মিররটার উপর একটা সুইচ। অনেকটা টিভি স্কীন এর মতো। সুইচটার একপাশে ‘এস’ অন্যপাশে ‘এম’ লিখা। আমি এম এ টাচ করলাম। স্কীনটা মিরর হয়ে গেল।
 
আমাকে দেখতে পাচ্ছি।
আমি আমার মতোই আছি। শুধু অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছি। আরেকটু ফর্সা মনে হলো নিজেকে। মুখ ভর্তি দাড়ি-গোফ। বড় বড় হয়ে রয়েছে; চুলও স্বাভাবিক রয়েছে। হঠাৎ আমার নখের দিকে তাকালাম। হাত-পায়ের নখগুলি খুবই সুন্দর করে কাটা। শুধুমাত্র দাড়ি-গোফগুলিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
 
বাথরুমে এক্সট্রা ড্রেস দেয়া রয়েছে।
 
আমি সম্পূর্ণ ফ্রেস হয়ে বাথরুম থেকে বের হলাম।
খুব ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। মাথার ভেতর শুধু ফোনটা কোথায়, ফোনটা কোথায় চিন্তা কাজ করছে। হঠাৎ বুকের ভেতরে চিনচিন করে উঠলো।
 
আমার মা’র কথা মনে হলো।
আমার মা কেমন আছে? কতদিন কথা হয় না।
 
আমার কেন এমন মনে হচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে হাজার হাজার বছর আমি ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। সবকিছু সত্যিই এতো অন্যরকম লাগছে কেন?
 
বুকটা আরও চিনচিন করছে। মুন কোথায়? মুন? আমার মুন!
মাথাটা ঝাকি দিয়ে উঠলো। বুকটা ফেটে যাচ্ছে মুন’র কথা মনে হতেই। মুন তো মারা গেছে। ক্লোন ক্যানসারে মারা গেছে মুন। আমি ওর হসপিটালে যাই নি। মুন নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। দু’চোখ ভরে কান্না পাচ্ছে।
 
সবাইকে ফোন করতে হবে। তাড়াতাড়ি ফোন করে সকলের খবর নিতে হবে।
 
কিন্তু পরিস্কার মনে হলো মেয়েটি বলছিল এখন ২১১৪ সাল। না। এটাতো হতেই পারে না। ওই হিসাবে আমার বয়স তো ১৩৮ হবার কথা! কিন্তু গ্লাসে নিজেকে দেখলাম সেই ৩৮-৩৯ বছরের আমিই তো রয়েছি। কিভাবে আমার বয়স ১৩৮ হবে?
 
মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
ফোনটাও নাকি ব্যাক ডেটেড হয়ে গেছে। তাহলে?
 
কি হচ্ছে এসব?
মেয়েটা যেন কি নাম বলল? আমাকে নাম দিতে বলল! কাষ্টমাইজড করে নিতে বলল!
 
মানে কি এসবের?
আচ্ছা আমার কি হয়েছিল?
আমি হসপিটালে কেন?
 
কেবিনে সুন্দর করে সোফা সাজানো রয়েছে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
 
এই প্রথম লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা একটা কাচে ঘেরা ষ্টেজ এর ভেতরে দাড়ানো। তারমানে?
 
মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
 
‘স্যার কিছু লাগবে?’
‘হ্যা, আমি হেয়ার ক্রিম ব্যবহার করি। ব্রাইল ক্রিম। ওটা ইংল্যান্ডের। কোথায় পাবো?’
 
মেয়েটা আমার কথার কোন উত্তর দিল না। বলল, ‘আপনার পিসিপি ডাক্তার বাবু আসছেন। আপনি সোফায় বসুন। উনি অাপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। স্যার, আমাকে কি কোন নাম দেবেন?’
 
‘মনোরী’। আমি হঠাৎ বলে বসলাম। ‘আপনার নাম দিলাম মনোরী’।
মেয়েটা নিজে নিজে উচ্চারণ করলো, ‘মনোরী’।
 
‘হ্যাই, হ্যাপী বার্থ ডে মিষ্টার ইভান’ বিশাল দেহী সাদা ডাক্তার ভদ্রলোক। আরও বললেন, ‘আমি আর্নল্ড ক্লোবার্ড এমডি, আপনার পিসিপি; আপনি কেমন আছেন?’ বলেই আমার সংগে হ্যান্ডসেইক করলেন।
 
বসলাম আমরা দু’জনেই।
আমি বললেম, ‘জ্বী ভালো খানিকটা’।
আজ আপনার ১৩৮তম জন্মদিন। কিন্তু আপনার এপিয়ারেন্স এ আপনার সর্বশেষ বয়সটাই রয়ে গেছে। আপনার কি মনে পরে আপনাকে নিয়ে আমরা একটা বিশাল পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। আজ থেকে ৯৯ বছর আগে মানে ঠিক ২০১৫ সালের ১৭ই আগষ্ট আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল গবেষক মানুষের উপর প্রথম বারের মতো ‘কৃত্রিম হাইবারনেশন’ ব্যবহার করে। অবশ্য এজন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার হতে হয়েছে সেই সময়ের এডমিনিষ্ট্রেশনকে। কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নেবার পর প্রেসিডেন্ট সেই পার্মিশন দেন। বিষয়টা নিয়ে কোর্টেও চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। আপনার কি এসব কথা মনে আছে?’
 
আমি চোখ বন্ধ করলাম। প্রায় মিনিট দু’য়েক।
আমার মনে পরছে আস্তে আস্তে। আমি একটা অনলাইন এড দেখেছিলাম। মানুষের উপর আর্টিফিসিয়াল হাইবারনেশন পদ্ধতি এপ্লাই করা হবে। আমি জীবনের উপর বিরক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে গিনিপিগ বানাতে রাজী হয়েছিলাম।
 
সব মনে পড়ছে আমার।
সব কিছু। আমার মাথা ঘুড়াচ্ছে। সবকিছু এখন পরিষ্কার।
 
আমি আবার বেঁচে উঠেছি! ৯৯ বছর পর! ওহ মাই গড! কিভাবে সম্ভব হলো।
তাহলে?
 
হঠাৎই আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।
তাহলে- অামার আর কেউ জীবিত নেই এই পৃথিবীতে? আমি একা!
 
আমার চোখ ভিজে গেল।
আমার মা তো তখন জীবিত ছিলেন। আমার ছোট বোনটি কোথায়?
ওহ নো! কোন হিসাবেই তো তাদের পাওয়া সম্ভব নয় আর!
 
তাহলে, আমি এখন কি করবো?
আমি চিন্তা করতে পারছি না।
 
ফ্যাল ফ্যাল করে আমার পিসিপি’র দিকে তাকালাম। ওনার মুখ গম্ভীর। বললেন, ‘আপনার ব্রেক ফাষ্ট আসছে। আপনি খেয়ে নিন। আপনার শরীরের প্রতিটি অর্গান অত্যন্ত সুন্দরভাবে কাজ করছে। আপনি অনায়াসে আরও ৪০ থেকে ৫০ বছর বেঁচে থাকবেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন বৈপ্লবিক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। আমরা এখন অনেক শক্তিশালী। আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনাকে বিশদভাবে সবকিছু বলবেন। আরেকটি বিষয়। আপনাকে আগামী ৯ মাস মেডিকেশন এ থাকতে হবে। আপনার জন্য একটা ১০০মিলিগ্রাম এর কাষ্টমাইজড ট্যাবলেট তৈরী করা হয়েছে- সেটা আপনাকে দেয়া হবে। প্রতি রবিবার রাতে ঘুমানোর আগে আপনাকে ঐ ট্যাবলেটা খেতে হবে। আগামী মাসে আপনার হেলথ এক্সজামিন করে প্রয়োজন হলে রিকাষ্টমাইজড করা হবে আপনার মেডিকেশন।’ ডাক্তার ক্লোবার্ড বিদায় নিলেন, আবার আসবেন বলে।
 
আমার কাছে সব গল্পের মতো শোনাচ্ছে। বুকটার ভেতরে এখনও ব্যাথা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে মা’র কথা মাথা থেকে বের করতে পারছি না। আর মুন? ওহ, মুন’র মৃত দেহটাও দেখতে পারিনি।
 
আমি কি করবো এখন?
এই ১০০ বছরে এই পৃথিবীর তো অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবার কথা!
 
আমি নিজেকে কিভাবে মানিয়ে নিবো?
আমি কি করবো?
 
সেই দিনগুলির কথা মনে করার চেষ্টা করছি।
 
অপারেশন থিয়েটারের মতো একটা রুমে আমাকে নেয়া হলো। তার আগে আমার শরীরে সবকিছু চেকআপ করা হলো। কতগুলি স্যালাইন এর সূচ বিধানো হলো আমার ডান হাতে।
 
ডাক্তার ভেনসিস, হ্যাঁ নামটা মনে পরছে। ডাক্তার ভেনসিস আমাকে শেষ বিদায় জানালেন। বললেন, ‘আপনি আবার জেগে উঠবেন আজ থেকে শত বর্ষ পরে। আপনি নতুন পৃথিবী দেখবেন। নতুন মানুষ দেখবেন। শত বছরে বিজ্ঞান আরোও অনেক দূর অবধি চলে যাবে। আপনি দেখবেন মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপতি হয়েছে। আপনি আরও অনেক কিছুরই স্বাক্ষী হবেন। তবে আপনিই থাকবেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ আপনি তখন হবে ১০০ বছরের পুরাতন মানুষ। আপনাকে নিয়ে হৈ-হুল্লর পরে যাবে বিশ্বময়।’
 
‘স্যার আপনার ব্রেকফাষ্ট। খেয়ে নিন। আচ্ছা স্যার, মনোরী শব্দের মানে কি? আমি তো ওয়ার্ল্ড ডাটাবেজ থেকে শব্দটির কোন অর্থ খুঁজে পেলাম না।’
 
মনোরী।
মনোরী শব্দটির মানে কি?
 
আমি মনোরীর কথা ভাবতে ভাবতে ব্রেকফাষ্টে নজর দিলাম।
   Send article as PDF