এটা একটা ছোট গল্প

 
রাত এগারোটা ৫০শে সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট। আমি এয়ারপোর্টে ঢুকলাম ঠিক ১১টার সময়। নিঃসন্দেহে অনেক দেরী করে ফেলেছি। সিংগাপুর এয়ালাইন্সের বোর্ডিং কাউন্টারে গেলাম- বন্ধ হবার মুহুর্তে।
কাউন্টারপারসন আমার টিকেট চেক করে বলল, আপনার তো রিজার্ভেশন নেই; কিভাবে যাবেন?
আমি বললাম, আপনি রিজার্ভেশন করে এখুনি বোডিং পাস ইস্যূ করে দিন, তাহলেই তো হয়ে যায়। রিজার্ভেশন থাকার দরকার কি? এতো দামী এয়ারলাইন্সে কি বেশী মানুষ যায় নাকি? আপনাদের সিট তো খালিই পরে থাকে!
ভদ্রলোক বিব্রত, হকচকিত এবং একটু হেসে আমার কথায় সায় দিল। বলল, সময় শেষ তাড়াতারি বোর্ডিং ব্রীজে যান।
বোডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনে গেলাম। ইচ্ছা করেই রিটার্ণ টিকেট ছাড়া পাসপোর্ট আর বোডিং পাস দিলাম। এসবি’র ইমিগ্রেশন পুলিশ অফিসার আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, আপনার রিটার্ণ টিকেট নাই?
আমি উত্তর দিলাম না। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিলাম, এটা কোন প্রশ্ন না!
তিনি নাছোর বান্দা। এবার বললেন, ফিরবেন কবে?
আমি এবারও উত্তর দিলাম না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করলাম।
এবার বেচারা নতুন কোন প্রশ্ন করার শক্তি হারালো। এক্সিট সিল দিয়ে আমার হাতে দিয়ে দিল।
২দিন থাকলাম সিংগাপুর। ৩/৪ সিংগাপুর ডলারে পেট ভরে ভাত খাওয়া যায় মোস্তাফা’র আশে পাশের বাঙালী রেষ্টুরেন্টগুলিতে। হোটেল ভাড়া একটু বেশী। ৮০ সিংগাপুর ডলারের মধ্যে মোটামুটি মানের হোটেল পাওয়া যায়। মোস্তাফা এলাকাটি বাংলাদেশী অধ্যূষিত।
সিংগাপুর আমার ভালো লাগে না। ২ দিনের জন্য মালয়েশিয়া বেড়িয়ে আসলাম, ওখানেও ভালো লাগলো না তেমন একটা, কিছু জরুরী কাজ ছিল কুয়ালা লামপুরে।
কিন্তু সিংগাপুরে আমার কোন কাজ নেই। শুধু শুধু সিংগাপুর আসা। আগে আসা হয়নি কখনও, তাই। ডাবল এন্ট্রি ভিসা ছিল সিংগাপুরের। সিংগাপুরকে এশিয়ার ইউরোপ বলা হয়। খুব পরিচ্ছন্ন শহুরে দেশ। আইন-শৃঙ্খলা ভালো। পোর্ট সিটি। তবে খুব এক্সপেনসিভ। আমার ভালো লাগে না। হংকং এরচে অনেক মজার দেশ, মজার শহর।
রাতে ফোন করলো পানপান, তুমি কেমন আছো? ডিনার করেছো? তোমার ফ্লাইট কখন?
আমি বললাম,কাল টিকেট করবো। জানি না।
ওপাশ থেকে একটু অভিমানের সুর অনুধাবন করলাম; ‘তুমি সত্যিই আসবে তো?’
আমি বললেম, আসবো।
পরদিন সিংগাপুর – স্যাংহাই – সিংগাপুর টিকেট কিনলাম। পানপানকে ফোন দিলাম। আজই আসছি। রাত ২টায় ফ্লাইট, চায়না ইষ্টার্ণ এ।
‘ঠিক আছে। আমি ব্যস্ত। রাতে তোমাকে ইমেইল করবো। আর তোমার ফ্লাইট নাম্বারটা টেক্সট করে দাও এক্ষুনি।’ পানপানের স্মার্ট এনসার।
রাতে খাওয়া শেষ করছি ঠিক তখনই ওর ফোন পেলাম, ‘তোমাকে বিস্তারিত ইমেইলে জানালাম, মেইল চেক করো। কোন কিছু বুঝতে অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করবে। আমি সকালে তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক করবো।’ একমুখী কথা বলে ফোন কেটে দিল মেয়েটি। বুঝলাম খুব ব্যস্ত। একটা বড় অফিসের জিএম সে এখন। ব্যস্ততো থাকবেই।
হোটেলে পৌছে ল্যাপটপে ইমেইল দেখলাম।
‘মোটেল ২৬০’ তে আমার জন্য রুম বুক করেছে পানপান। সকালে এয়ারপোর্টে আসছে। নাইন-বি গেটে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে সে সরাসরি অফিসে চলে যাবে। আজ রাতে আমার সাথে থাকতে পারবে না। কি যেন সমস্যা আছে, মেয়েলি বিষয়, আমাকেও বলা যাবে না, সাই ফিল করছে। পরদিন থেকে আমাকে ফুল টাইম সময় দিবে। ইত্যাদি।
আমি ছোট রিপ্লে দিলাম, ওকে।
ল্যাপটপ বন্ধ করতে যাবো। ইয়াহুতে ‘হাই’ পেলাম; সংগে ‘কেমন আছো?’
– ভাল। তুমি? কাল তোমার কি সমস্যা?
কোন উত্তর নেই।
আবারও প্রশ্ন করলাম, বল্লে না?
এবার সে একটা ‘সাই’ ইমেজ পাঠালো। আমি মনে হয় বুঝতে পারলাম। কিন্তু ওকে দিয়ে আমি বলাবোই যদি আমার ধারণা ঠিক হয়। আবারও বললাম, ‘আমাকে বলতে হবে। না বললে তোমাকে আজ রাতে ঘুমাতে দেব না।’
‘তুমি টায়ার্ড। তাছাড়া তোমাকে এক্ষুনি রেডী হয়ে চাংগি পৌছতে হবে। তুমি রেডি হও। আমি ঘুমুবো।’ টেক্স পেলাম।
আমি বলালাম, না। তোমাকে দেখবো। দেখাও।
‘না আজ না। কালতো সামনাসামনিই দেখবে।’ এখন রেডী হও। আমি ঘুমালাম।
আমি জানি, পানপান আমার কোন কথাকেই অগ্রায্য করার ক্ষমতা রাখে না। সে ইয়াহু থেকে যাচ্ছে না।
আমি চুপ করে রইলাম। দেখি ও কি করে।
‘তুমি রেডী হও। আমি ঘুমুবো।’ পানপান আবারও বলল।
‘না’। আমি শুধু এটুকুই বললাম।
‘তোমার দেরী হয়ে যাবে। কাল আমি থাকবো এয়ারপোর্টে। সাইন আউট করলাম।’
আমি জানি, ওর ক্ষমতা নেই- আমাকে অবহেলা করবে। গত ২টি বছর তো পানপানকে আমি চিনি। আমি চুপচাপ।
ওর একটা ছবি পাঠালো। বলল, দেখো।
আমি বললাম, ‘না। হবে না। লাইভ।’
এবার সে ভিডিও কল দিল। খুব পাতলা সাদা নাইটি পড়ে আছে। রুমে লাইট জ্বলছে। চুলগুলি উস্কখুসকো। হাসছে।
কি খেয়েছো আজ? আমার প্রশ্ন।
ডামপ্লিং।
ফিস ছিল?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে, আমাকে রান্না করা শিখাবে।
ওকে। আর কি কি শিখতে চাও।
‘সাইকেল চালানো।’ আমি বললাম।
তুমি তো পারো! তাহলে? ও মিটিমিটি হাসছে।
‘তোমার কাছে শিখবো’। আমার উত্তর।
না। হবে না।
‘আমি জানি হবে।’
কিভাবে জানো?
তুমি আমাকে অগ্রায্য করার ক্ষমতা রাখো না; তাই জানি।
অগ্রায্য করবো।
পারবে না।
পারবো। পানপান হাসছে।
দেখা যাক পারো কি না? আচ্ছা কি প্রব্লেম তোমার আগামীকাল? কেন কাল আমাকে একা থাকতে হবে?
তুমি বুঝবে না।
তুমি বোঝাও।
না।
হ্যা।
বললাম তো না।
বললাম তো হ্যা। আমিও নাছোরবান্দা পানপানের কাছে।
কালকে বলবো, তুমি আসো, তারপর।
ঠিক আছে। তুমি ঘুমাও। গুড নাইট।
‘হুম। গুড নাইট। আই লাভ ইও, বাবু।’ বাংলাভাষার অনেকগুলি রোমান্টিক শব্দই পানপান আমার কাছে শিখেছে।
আই লাভ ইও টু।
রাত ১২টার কিছু পরে চাংগি এয়ারপোর্টে পৌছলাম। ল্যাগেজ বুকিং দিয়ে বোডিং পাস নিলাম। ইমিগ্রেশনে গেলাম। লাইনে লক্ষ করলাম আমি ছাড়া ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের আর কোন প্যাসেঞ্চার নেই এই ফ্লাইটে। বেশীরভাগই চায়নিজ, জাপানিজ, সিংগাপুরিয়ান এবং বেশকিছ অষ্ট্রেলিয়ান হোয়াইট সহযাত্রী আমার সাথে। আমি একাই বাংলাদেশী।
ইমিগ্রেশনে পিচ্চি একটা মেয়ে বসা। আমার সবুজ পাসপোর্টটি আর বোর্ডি পাস হাতে নিয়ে কি যে করছে আমি বুঝতে পারছি না। অনেকটা সময় নিচ্ছে মেয়েটি। আমি বিরক্ত হলাম। প্রশ্ন করলাম, ‘কোন প্রব্লেম’?
মেয়েটি আমার দিকে তাকালো, কিন্তু কোন উত্তর দিল না।
আমি আরও বিরক্ত হলাম। আমি জানি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মানুষের কোন মূল্য নেই। তবে, আমি নিজে কোনদিন কোন ইমিগ্রেশনে কোনরকম বিব্রতকর সমস্যার মুখে পরিনি।
এবার আমি কিছুটা উত্তেজিত। বললাম, ‘আমাকে বল কি দেখছো তুমি? কি জানতে চাচ্ছ? আমাকে শেয়ার না করলে তোমার সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে?’
মেয়েটা এবার আমার দিকে তাকালোও না।
আমি মনে হয় উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি! আমি একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের ক্ষমতা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখি। কিন্তু আমি আমার অধিকার সম্পর্কেও সচেতন একইসাথে। এবার আরও জোরে, অনেকটা চিৎকারের মতো করে (যাতে, ওর উপরের অফিসারের কান পর্যন্ত পৌছায় আমার কথাগুলি) বললাম, ‘তোমাকে কি এখানে যথাযথ ট্রেনিং ছাড়াই বসানো হয়েছে? সিংগাপুরের মতো দেশে এতটো অসল কর্র্মী তো থাকার কথা নয়? তুমি কোন কারণ ছাড়াই আমাকে দাড় করিয়ে রেখেছো কেন? এনসার মি! আমি তো তোমার দেশে এন্ট্রি চাচ্ছি না। আমি এক্সিট চাচ্ছি। তোমার দায়িত্ব আমাকে এক্সিট দেয়া। তোমার কোন অধিকার নেই আমার টাইম কিল করার। তুমি কি চাও? আমি তো তোমার দেশে থাকতে চাচ্ছি না, চলে যেতে চাচ্ছি।’
এবার মেয়েটা আমার দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। নরম গলায় বলল, ‘দেখ, তুমি রেগে যাচ্ছো। আসি সরি। তুমি তোমার দেশে ফিরবে কোন দেশ দিয়ে? আই মিন, তোমার রিটার্ণ ট্রানজিট কোথায়?’
‘তো, এই সামান্য প্রশ্নটা তো তুমি আরো ২০ মিনিট আগেও আমাকে করতে পারতে! করলে না কেন? এই ২০ মিনিট তুমি কি করলে?
আই এম সরি। মেয়েটি এবার সত্যিই দুঃখ প্রকাশ করলো।
আমি সিংগাপুর হয়েই দেশে ব্যাক করবো। তোমর চিন্তার কোন কারণ নেই, তোমার দেশে ট্রানজিট নিলেও এন্ট্রি চাইবো না। ২ ঘন্টার ট্রানজিট নিবো শুধু। সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের কানেকটিং ফ্লাইটেই বাংলাদেশে ব্যক করবো।
রিটার্ণ টিকেট আছে সংগে? না কি পরে করে নিবে?
হ্যা রয়েছে। তুমি কি দেখতে চাও? বের করে দেখাবো তোমাকে?
না না, ইটস ওকে, দেখাতে হবে না। আই এম সরি। এন্ড হ্যাভ এ সেইফ জার্নি টু স্যাংহাই। মেয়েটা এবার ভদ্রতা দেখাতে শুরু করলো।
দীর্ঘ ৬ঘন্টার ক্লান্তিকর ফ্লাইট, তার উপর রাতের ফ্লাইট। রাতের ফ্লাইট আমার পছন্দ নয়, আমার দিনের ফ্লাইট ভালো লাগে; কোন কারণ নেই। ২টি চকলেট নিলাম। বোর্ডিং ব্রিজের দিকে রওয়ানা দিলাম।
চায়নার ইমিগ্রেশন অফিসারদের আমার বরাবরই ভালো লাগে। এরা অত্যন্ত স্মার্ট ও হেল্পফুল। কোন বিরক্ত করে না। সর্বোচ্চ সভ্যতা দেখায়। কোন কথা না বলেই আমাকে এন্ট্রি সিল দিয়ে দিল স্যাংহাই পুডং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। বিশাল এয়ারপোর্টটি আমার খুব পরিচিত, খুব পছন্দেরও। স্যাংহাই যে আমার সবচে প্রিয় শহর।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে নাইন-বি’র সামনে দেখতে পেলাম পানপানকে, দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার জন্য। আমাকে হাগ করলো। আমিও জরিয়ে ধরলাম পানপানকে। বাসের টিকেট কিনেই রেখেছিল। উঠলাম সামনে দাড়ানো বাসে। বসলাম। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। তারপরও ক্লান্তি লাগছে না। ঈশ্বর মেয়েদের ভেতরে কিছু একটা দিয়ে রেখেছেন যা শত ক্লান্তির মধ্যেও ছেলেদের উজ্জিবিত রাখতে সহায়তা করে। মেয়েরাও এমন উজ্জিবিত হয় কিনা জানা নেই।
বাস স্টপেজ থেকে মোটেল ২৬০ হাটা পদে দূরত্ব ৫/৬ মিনিট হবে। হোটেলে যাবার পথে পানপান আমাকে ম্যাকডোনাল্ডস দেখিয়ে দিল। আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে নীচ থেকেই বিদায় নিল, অনেক অনুরোধে উপরে গেল না। আমায় বলে গেল ঠিক ৬টায় সে আবার আসবে। এক সংগে রাতের খাবার খাবো তারপর ১০টায় চলে যাবে।
আমি সকালে রুমে ঢুকেই একটা লম্বা ঘুম দিলাম। দুপুরের পরপর ঘুম ভাংলো। গোসল দিয়ে, রেডি হয়ে ম্যাকডোনাল্ড এ গেলাম। আলু ভাজি আর মুরগি ভাজি খেলাম। এমনিতে ম্যাগডোনাল্ড আমি খুবই পছন্দ করি কিন্তু চায়নার ম্যাকডোনাল্ড খেয়ে আমি মজা পাই না। কারণটা আমার জানা নেই। তবুও খেতে হয়। চায়নাতে সবচে বেশী যেটা আমার পছন্দ তা হলো এখানকার রেডী মিল্ক। বোতলে ভরা; দাম মাত্র ৩ আরএমবি। ৩/৪টা রেডী মিল্ক নিয়ে রুমে ফিরলাম।
৬টায় দরজায় নক করলো পানপান।
খুলে দিলাম। আমার জন্য বেশ কিছু গিফট নিয়ে এসেছে। প্যাকেট খুললাম। ২টা টি-শার্ট, বলল মাস তিনেক আগে হংকং গিয়েছিল, তখনই আমার জন্য কিনে রেখেছে। বায়না ধরলো তখনই আমাকে পড়তে হবে। ওর সামনে জামা চেঞ্জ করতে একটু আনইজি ফিল করছিলাম। ও আমাকে সুযোগ দিল নিজে বাথরুমে যেয়ে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে নতুন জামায় আমাকে দেখলো অনেকক্ষন। তারপর হঠাৎ আমার বুকে চলে আসল মেয়েটি। আমাকে নির্দেশ দিল আমি যেন ওর শরীরের কোথাও হাত না দিই তবে শুধুমাত্র জড়িয়ে ধরে রাখতে পারবো। আমি বাধ্য, অনুগত, বিশ্বস্ত বরাবরই। কতক্ষন জড়িয়ে থাকলাম মনে নেই।
ও বসলো সোফায়।
আমি আমার লাগেজ থেকে ওর জন্য নেয়া একটি লাল শাড়ী বের করলাম। আমি জানতাম ও অনেক খুশী হবে কিন্তু খুশীর মাত্রাটা এতো বেশী হতে পারে সেটা ভেবে দেখিনি।
সে, তখনই শাড়ী পড়বে। কিন্তু কিভাবে শাড়ী পরতে হয় তা তো সে জানে না। আমিও তো জানি না। ভীষন সমস্যায় পড়ে গেলাম আমরা দু’জনে। ওকে আমি ল্যাপটপে শাড়ী পরা কিছু মেয়েকে দেখালাম, কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান হল না। শেষটায় আমাকে দায়িত্ব নিতে হলো।
আমি ওর জন্য ব্লাউজ আর পেটিকোটও নিয়েছিলাম। আমি বললাম ঠিক আছে, আমি পরিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে তো সব খুলতে হবে। সে আমাকে সহায়তা করলো কিন্তু সেই পুরোনো শর্তেই। আমি নিজেকে সংযত রেখে ওকে শাড়ী পরিয়ে দিয়েছিলাম। আমি জানি সেটা পৃথিবীর সবচে বাজে ভাবে পরা শাড়ী ছিল কিন্তু ওকে দেখে মনে হয়েছিল- এই পৃথিবীর সবচে সুন্দভাবে শাড়ীটি তাকে পরানো হয়েছে। বেশ কয়েকটা ছবি তুললো ও আমার সাথে বিভিন্ন ভংগিমায়।
হঠাৎ পানপান আমাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ওর স্পর্শে আমি অভিভূত। এবং কিছুক্ষন পর ছেড়ে দিল আমাকে।
একটা স্থানীয় চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে গেলাম আমরা। কিসব অর্ডার দিল। তারপর প্রতিটি খাবারের কোনটি কি কি নাম, কি দিয়ে তৈরী, কেভাবে খেতে হয় সব শিখিয়ে দিল এবং নিজে আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল।
রাতে ১০টা দিকে বলল, আজ আর না। কোন প্রশ্নও করা যাবে না ওকে। সে চলে যাবে। ওর লাগেজ নিয়ে কাল বিকেলে আসবে। কাল থেকে ও ৩ দিনের ছুটি নিয়েছে। আমরা কাল বিকেলে যাবো ইও সিটিতে। ওখানে আমার কিছু কাজ রয়েছে। ২দিন ওখানে কাটাবো। চলে যাবার আগে চমৎকার বিদায় দিল আমাকে।
স্যাংহাই থেকে ইও সিটি যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘন্টা। চাইনিজ রাস্তাঘাট, বাস সার্ভিস অত্যন্ত আধুনিক। রাত সাড়ে দশটায় আমরা পৌছলাম ইও সিটি। আমার পূর্ব পরিচিত একটা হোটেলে উঠলাম। রাতে আর কিছু খাবো না। ক্লান্ত। ফ্রেস হয়ে আসলাম আমরা।
পানপানের কাছে সমর্পিত হলাম; কিছু করার নেই। ওর ভালোবাসা অবহেলা করা অসম্ভব। সকালে হোটেলেই কমপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাষ্ট করে নিলাম। ১টার মধ্যে আমি আমার প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ফেলাম।
সামাচান তন্দ্রামাসন নামে একটা এলাকায় ‘দিল্লী কা দরবার’ নামে একটি ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট রয়েছে। পানপানকে বললাম, আজ তোমাকে আমাদের দেশী খাবার খাওয়াবো। ওতো মহাখুশী। আমার সংগে হাত ধরে রওয়ানা দিল। টেক্সি নিলাম। রেষ্টুর্টেটি ও খুরে দেখলো, খুব খুশী। ওকে খাবার সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলাম। আমি ভাত খাবো চিকেন কারী দিয়ে কিন্তু ও খেতে চাইলো সংগে রুটিও। চাইনিজরা স্পাইসী খাবার খায় না। প্রচন্ড ঝাল। ওর নাক-মুখ দিয়ে পানি পড়ছে কিন্তু সে খাবেই। এটা নাকি পৃথিবীর সেরা খাবার। প্রচুর খেলো। আমি ওর খাবার খাওয়া দেখে অবাক। ভালবাসলে বুঝি এরকমই হয়।
দিল্লী কা দরবার থেকে বের হবার পর ও বলল, আমরা হেঁটে হেঁটে যাবো। আর আমিতো হাঁটার জন্য পাগল। দু’জন হাঁটতে শুরু করলাম।
‘আমরা প্রতিদিন রাতে খাবারের পর ৩০ মিনিট এভাবে বাইরে নিয়মিত হাঁটা-হাঁটি করবো। তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি। আমি একটা ছোট এপার্টমেন্ট কিনেছি স্যাংহাইতে। আমাদের দু’জনের চলে যাবে সেটাতে। শুধু কিছু ফানিচার নিতে হবে। তোমাকে আগামীকাল ওই এপার্টমেন্টে নিয়ে যাবে। আরো ৪ মাস পর হ্যান্ডওভার করবে। ২৩ তলার উপর। প্রচুর বাতাস জানালা খুললে। তোমার ভাল লাগবে।’
আমি ওর কথা শুনছিলাম, কিছুই বলছি না। আমাকে নিয়ে একটি ষ্টোরে ঢুকলো, বালিশ, বেডিং ইত্যাদি। আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলো, কি কি দিয়ে সাজাবে সেব পরিকল্পনার কথা বললো।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা সাইকেল এর বিষয়টা যে বলবে বলেছিলে- সেটা বলবে?
আমি হেঁসে দিলাম। আমি জানতাম পানপান জানতে চাইবে, ভুলবে না। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলাম।
কিন্তু ও ছাড়বে না।
আচ্ছা্ বলছি। কিন্তু মাইন্ড করতে পারবে না। বললাম।
ঠিক আছে, মাইন্ড করবো না। বলো।
অনেক বছর আগে একটা মেয়ে আমার সাথে পরিচয় হলো। সেই মেয়েটা আমাকে পরিচয়ের ২য় দিনেই একটি প্রেমপত্র ছিয়ে বললো আগামীকাল এসে উত্তর নিয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। আমি বললাম ঠিক আছে।
মেয়েটা চলে যাবার পর আমি চিঠিটি খুললাম, পড়লাম। এক পৃষ্ঠার চিটিতে প্রায় ১৫টি বানানই ভূল। আমি বিরক্ত হলাম। একটি লাল কলম নিলাম। ভূল বানানগুলি লাল কালি দিয়ে মার্ক করে শুদ্ধ কি হবে সেটা লিখে দিলাম। নীচে একটু জায়গা ছিল, সেখানেই লিখলাম, ‘বানান শুদ্ধ করে আবার সাবমিট করো- তখন বিবেচনা করে দেখবো উত্তর দেয়া যায় কি না।’।
মেয়েটা আমার চিঠি পেয়ে তো মহাখুশী। কিন্তু খুলে পড়ার পর নিজের চিঠি ফেরত পেয়ে প্রচন্ড মর্মাহত। চলে গেল।
কিন্তু এই মেয়ে হাল ছাড়ার মেয়ে ছিল না। পরদিন সে আবারও আসলো। আরও একটা কাগজ অামাকে ধরিয়ে দিল এবং বলল, আগামী কাল আসবে।
আমি খুললাম, ইংলিশে লেখাটা পড়লাম নির্ভূল বানানে:
What is the difference between a Cycle and a Girl?
Cycle: you have to pump and then ride.
Girl: you have to ride and then pump.
আমি ওর ইংগিত বুঝতে পারলাম, সে কোন দিকে যেতে চায়। পরদিন ওকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে একটা সাইকেল দিতে পারবে? আমি কিন্তু সাইকেলই পছন্দ করি।এরপর আর আসেনি সেই মেয়েটি; সম্ভবত খুব অপমানিত হয়েছিল সেদিন।
পানপান আমাকে রাস্তায় প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, আমি হতভম্ব। তারাতারি ছাড়িয়ে নিলাম ওকে।
রাতে বেডে শুয়ে রয়েছি। আগামীকাল দুপুরের পর ইও সিটি ত্যাগ করবো। স্যাংহাইতে আরও ১দিন থেকে দেশে ব্যাক করার পরিকল্পনা। হঠাৎ আমার নাকে সে আদর করলো; তারপর নাকটা ধরে বলল ‘আমার বেবীর নাকটা ঠিক এরকম হবে, অনেক উচুঁ। চাইনিজ মার্কা ভোতা নাক আমার একদম পছন্দ নয়। আর চোখগুলিও ঠিক তোমার মতোই। চাইনিজ চোখও আমার ভাল লাগে না।’
আমি বললাম, ‘যদি না হয়? যদি চাইনিজ স্টাইলই হয়? আগে থেকে তো অার বলা সম্ভব নয়; তাই না?’
‘না। হতেই হবে। আমি চাই। তোমার মতোই হতে হবে। আমি অন্য কিছু মানি না।’
আমি হেসে দিলাম। তুমি তো অনেক স্মার্ট, বুদ্ধিমতি। এসব কি বলছো?
না। আমি ঠিকই বলছি। আমি তোমার কাছে তোমারই একটি কপি চাই। আমি জানি না তুমি আমার সাথে থাকবে কি না সারাজীবন! আমি সত্যিই সন্দিহান! আমি এখনও জানি না, তুমি সত্যিই আমাকে ভালবাস কি না? আমি তোমার ভালবাসা বুঝি না। তুমি মাত্র ৩টি মিনিট আমাকে দিতে পারো না সারাদিনে। মাত্র ৩টিই মিনিট, তোমার কাছে কত আঁকুতি করেছি। আমি ফোন করবো, তুমি শুধু রিসিভ করে বলবে কেমন আছো, আমার কথা ভেবেছো কি না! সেটাও তুমি করবে না। আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো যে তুমি আমার কাছে থাকবে? আমাকে নিয়েই থাকবে? কাজেই, তুমি আমাকে বিয়ে করবে; তোমার যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিনই করবে। কিন্তু আমাকে শুধু তোমার একটা কপি করে কিউট বেবী দিবে। আর কিছু আমি তোমার কাছে কোনদিন চাইবো না।
আমি পানপানের মুখের দিকে তাকালাম। ও কাঁদছে। অনেকক্ষন সময় নিয়ে ওর কান্না দেখলাম। ওর মাথাটা আমার বুকের সাথে চাপ দিয়ে ধরে রাখলাম। অনেকক্ষন।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাই আমি জানি, পানপান এবার কোন বেবী পাচ্ছে না; ওকে তা বললামও না।
সবকিছু বলতে নেই।
(ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কাকতালীয়ভাবে কারো সাথে মিলে গেলে আমার কিছুই করার নেই)
   Send article as PDF