ইফতার

বিকেলে একটু জ্যাকসন হাইটস (বাংলাদেশী পাড়ায়) গেলাম- ইফতারের জন্য জিলাপী কিনতে।
 
ঠিক তখনই গুয়াংজু (চায়না) থেকে ফোন করলেন মল্লিক ভাই। বললেন তিনি মাত্র সেহরী খেয়েই আমাকে ফোন করেছেন।
 
জানালেন যে প্রথম রোজা শেষ করে দ্বিতীয় রোজার সেহরী ছিল আজ।
 
আমি আমেরিকায় প্রথম রোজার শেষ বেলায় জিলাপী কিনতে গিয়েছি, একটু পরই ইফতার।
 
গোলাকার এই পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে মল্লিক ভাই এই একই পৃথিবীর সর্ব পশ্চিম প্রান্তে আমাকে ফোন করেছেন। আর মধ্যিখানের ভারতীয় উপমহাদেশীয়রা (ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ) তাদের প্রথম রোজাই এখনও শুরু করতে পারেনি!
 
যাকগে, এসব নিয়ে আর হাসতে বা হাসাতে চাচ্ছি না; ভিন্ন প্রসংগে যাই না হয়।
 
ছোটবেলার কথা বলি।
তখন গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
মসজিদে ব্যাটরী চালিত মাইক ব্যবহার করা হতো আজান দেবার জন্য।
 
সেহরী খাবার সময় হলে প্রায়ই মসজিদে গিয়ে মাইকে ডাকা-ডাকি করতাম, সেই উত্তেজনাটা বেশ উপভোগ্যই ছিল। বিশেষ করে সময় শেষ হবার মিনিট ১০শেক আগে থেকে রোজাদারদের সতর্ক করাটাও ভালো লাগতো। অনেক সময় গ্রামে দল বেঁধে সেহরীর জন্য হেঁটে হেঁটে ডাকা-ডাকিও করা হতো।
 
সেই দিনগুলি আর নেই।
কিংম্বা দিনগুলি ঠিকই আছে আমরা নেই, আমাদের জায়গায় এসছে অন্যরা।
 
শীতের দিনগুলিতে তখন রোজা হতো।
প্রচন্ড শীতের ভোড়ে উঠে সেহরী খেতে সে কি আনন্দ। কি উদ্দিপনা, অথচ রীতিমতো কাঁপছি তখন! বাড়ীর সকলে একসংগে বসে সেহরী খাওয়াটা ছিল যেন এক উৎসব।
 
তারপর মসজিদে ফজরের নামাজটা পরে বাড়ী ফিরে আবার একটা ঘুম।
 
তুলনামূলক বিচারে একটু লেট করেই ঘুম থেকে উঠতাম। রোজার মাসটা আসলে একটা ভিন্নতর উৎসবেরই মাস। দিনগুলি পাড় করতাম মসজিদ কেন্দ্রিক। যোহর নামাজ পড়ে অনেক দিন এমনও ছিল আর বের হতাম না, একবারে আসর পরে বের হতাম তখন।
 
রমজানের সবচে বড় বৈশিষ্ঠ হলো ক্ষুধা লাগে না কিন্তু পানির তৃষ্ণাটা খুবই কষ্ট দেয়।
 
আমারচেও যারা ছোট বা আমার বয়সী তাদের মধ্যে লক্ষ্য করতাম থুথু খেয়ে ফেললে রোজা ভেংগে যাবে কি না সেটা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি।
 
আমি যেহেতু তর্কাতর্কি এড়িয়ে চলি, তাই দর্শক থাকতেই ভালো লাগতো।
 
আছর নামাজ শেষে ‘মেসওয়াক’ করা যাবে।
রমজানে দাত ব্রাঁশ করা নিষেধ। ‘রোজাদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়’।
 
যদিও আমি ব্রাঁশ না করে থাকতে পারি না; কিন্তু আসরের পর মেসওয়াকটা করতে বেশ ভালই লাগতো।
 
তারপর ইফতারের জন্য মাগরেবের আজান।
 
বাড়ীতেই ইফতার করতাম।
অন্য দশজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ইফতারের আয়োজন হতো।
 
সাধারণত পিয়াজু বা ডালের বড়া, বেগুনী, ছোলা-মুড়ি, কাঁচা ছোলা (আমি খেতাম না), তারপর চিড়া ভিজানো, কলা (গ্রামে সেসময় অন্য ফল সহজলভ্য ছিল না) ইত্যাদি আর প্রায়ই ‘বড়া পিঠা’ তৈরী হতো- আমার খুব প্রিয় ছিল ওটা। আর ছিল লেবুর শরবত, খেজুর যা ইফতারের শুরুতেই খেয়ে নিতাম। ইফতারের দোয়াটা দিয়েই রোজা শেষ করতাম।
 
এবাড়ী ওবাড়ী থেকে প্রায়ই কিছু ইফতার সংযুক্ত হতো, আমরাও মাঝে মধ্যে ওবাড়ী-এবাড়ীতেও শেয়ার করতাম- সেটাও অন্যরকম আনন্দ।
 
মাগরেব আজানের ২০ মিনিট পর জামাত অনুষ্ঠিত হতো।
সুতরাং ১৫ মিনিটের মধ্যে ইফতার শেষ করে দৌড়ে চলে যেতাম মসজিদে, সকলে এক সংগে জামাতে নামাজ পরে নিতাম।
 
সবেচ অদ্ভুৎ যে বিষয়টা তখন ছিল, মাগরেবের নামাজ পরেই জলদী বাড়ী ফিরতাম ভাত খেতে। এতো ক্ষুধা তখন ছিল! পেট ভরে ভাত খেয়ে আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে অজু করে আবার চলে যেতাম ইশার নামাজ ও সংগে তারাবিহ আদায়ের জন্য।
 
গ্রামের ছেলেরা মিলে মসজিদে একদিন ইফতার পার্টি করতাম, খিচুরী হতো কোন এক রাতে। আরও মনে আছে কোন এক বছর রমজানের প্রতিদিনের ইফতারে পুরো গ্রামবাসীর সকলে মিলে মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতি বাড়ী বাড়ী থেকেই ইফতার আসতো। আমিও ঐ বছর প্রায় প্রতিদিনই (যতটুকু মনে পরছে) মসজিদেই অন্যদের সংগে ইফতার করেছি।
 
প্রায়ই তারাবিহ শেষ করে আবারও ভাত খেতাম।
তারপর ঘুমুতে যেতাম, ভোর তিনটার দিকে উঠে সেহরী খেতাম।
 
প্রতি বছরই লক্ষ্যনীয় ছিল গ্রামের প্রায় সব বাড়ীতেই একদিন কিছু রোজাদারকে ইফতারের দাওয়াত দেয়া হতো। ‘একজন রোজাদারকে ইফতার করালে- একটা পূর্ণ রোজার শওয়াব পাওয়া যায়’।
 
আমরাও একদিন দাওয়াত খাওয়াতাম রোজাদারদের। সুন্দর ইফতারের আয়োজন আর মাগরেব শেষে খাবারের আয়োজন।
 
আমাদের গ্রামের একটা বাড়ীতে প্রতি বছরই ‘রমজানের প্রথম দিনই’ ইফতারের দাওয়াত দেয়া হতো (সম্ভবত এখনও তাদের বাড়ী ওই ধারা বলবৎ রয়েছে)। আমিও সেই দাওয়াতে অংশগ্রহন করতাম। ইফতার শেষে দাওয়াতীরা দলবেঁধে মসজিদে গিয়ে আবারও সেই বাড়ীতে ফিরে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ী ফেরা, তারপর তারাবীর জন্য প্রস্তুতি।
 
সেটাও উৎসব উৎসবই ছিল।
 
তখন এতো খাবার কিভাবে খেতে পারতাম- এই বেলায় এসে হিসাবে মিলাতে পারি না।
 
ঢাকায় যখন ছিলাম, ইফতার করে তারপর রাত ১১টার দিকে খেয়ে নিতাম, সেহরী খেতে পারতাম না। ক্ষুধা থাকতো না একেবারেই।
 
আর এখন এই ‘একাহারী’ মানুষ আমি ইফতার করার পর সারা রাত আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। ক্ষুধাগুলি কোথায় যে হারিয়ে গেল?
 
আহামরি ইফতার যে করি তাও কিন্তু নয়। কিন্তু সামান্যতেই পেট ভরে উঠে।
 
বাঙালি ইফতারের সবচে কমন এবং মজাদার খাবার হলো ছোলা-মুড়ি।
 
আমাদের বাড়ীতে ইফতার শেষে এই ছোলা-মুড়িটা বানাতেন আমার আব্বা। ভোনা ছোলার সংগে কাঁচা পেঁয়াজ, মরিচ কুচি আর সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে সকলের প্লেটে পরিবেশন করতেন নিজ হাতে।
 
ঢাকায় থাকাকালীন রোজার মাসে যখন বাড়ীতে যেতাম- ইফতারে আব্বার হাতে তৈরী সেই ছোলা-মুড়ির আলাদা স্বাদটির জন্য আনমনে অপেক্ষা করতাম।
 
আবারও হয়তো বাড়ী যাবো, আবারও হয়তো রমজান মাসও পাবো, ইফতারও করবো কিন্তু আমার আব্বার হাতের সেই স্পেশাল ছোলা-মুড়ি’টি আর পাবো না।
 
অনেক দূরে রয়েছি বলে আব্বার কথা প্রায়শঃই ভুলে থাকতে পারি।
কিন্তু যেদিন সত্যি সত্যিই দেশের মাটিতে পা রাখবো, আবার গ্রামে যাবো এবং সেখানে গিয়ে দেখবো আমাদের পরিবারের মুখ্য মানুষটিই আর শাসন করছে না, সামনে আসছে না, ইফতারে ছোলা-মুড়ি বানিয়ে দিচ্ছে না; তখন কি তা সহ্য করতে পারবো?
 
আমি জানি না।
আমি তা ভাবতেও পারি না- এত দূরে বসে!
   Send article as PDF