মূল্য মাত্র ২০ হাজার টাকা

বাংলাদেশের একজন মানুষের জীবনের মূল্য ২০ হাজার টাকারও কম; কোন কোন ক্ষেত্রে তাও নেই!
 
তারপরও নাকি কেউ কেউ এখানে নাকি বিস্ময়কর উন্নতি খুঁজে পায়।
 
ম্যাক্সিমাম ১০ হাজার কোটি টাকা দামের পদ্মা সেতু তৈরীতে খরচ করা হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা! ৬০০ কোটি টাকার স্যাটেলাইট কেনা হয় নগদ ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যে!
 
৬ টাকা ইউনিটের বিদ্যুৎ কেনা হয় ৩০ টাকায় আর গল্প শোনানো হয় উন্নয়নের- মাঝখান থেকে খেয়ে দেয়া হয় ২৪ টাকা আর সে টাকায় সিংগাপুরের সেরা ধনী হিসাবে স্বীকৃতি পায় কোন এক বাংলাদেশী যার শরীরে রয়েছে শুধুই ১৭ কোটি মানুষের পরিশ্রমের তাজা ঘাম!
 
আচ্ছা, উন্নয়ন কি দিয়ে হয়!
মাটি? বহুতল ভবন? ব্রীজ-কালভার্ট? রোড-হাইওয়ে?
 
না কি মানুষের জীবনের মুল্যে’র মাপকাঠির উচ্চতায়?
 
বিল ক্লিনটন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকান জ্বালানী মন্ত্রী বিল রিচার্ডসন হঠাৎই ঢাকা সফর করেন ৯০ এর দশকে কোন ঘোষনা ছাড়াই। ১ দিনের সফর শেষে ফিরে যান নিজ দেশে।
 
আমেরিকান জ্বালানী মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর!
বিষয়টা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
 
যাই হোক, দিন কয়েক পর জানা গেল আসল খবর।
ব্যাংকক থেকে ঢাকায় আসা এক মার্কিন তরুনী বিমানবন্দরের কাষ্টমস এ গ্রেফতার হয় হিরোইন পাচারের অভিযোগে। তারপর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে পাঠানো হয় এবং বিচার শেষে যাবৎজীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
 
রায় ঘোষনার দিন কয়েক পরই মার্কিন মন্ত্রী ঢাকা সফর করেন এবং যাবার সময় সংগে করে সেই মার্কিন সিটিজেন তরুনীকে নিয়ে চলে যান বিশেষ বিমানে উড়িয়ে।
 
উত্তর কোরীয়ার সংগে আমেরিকার কোনরূপ কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই দীর্ঘদিন। এই তো ২০১০ সালের ফ্রেব্রুয়ারীতে ৩০ বছর বয়সী এক মার্কিন যুবক চায়না ভ্রমণে গিয়ে সখ বা ভূল করে বর্ডার ডিংগিয়ে ঢুকে পরে উত্তর কোরীয়ার সীমানার ভেতরে।
 
ব্যস। উত্তর কোরীয় সীমান্ত রক্ষীরা তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়।
 
এরপর কি হলো শুনবেন?
 
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার নিজেই স্বশরীরে পৌছে যান পিয়ংইয়ং; আগষ্টেই। তখন আমেরিকার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা।
 
জিমি কার্টার সেই যুবককে পরদিনই বিশেষ বিমানে সংগে করে নিয়ে ফিরেন ওয়াশিংটন ডিসি।
 
এসবই হলো বিশ্বব্যাপী আমেরিকান নাগরিকদের জীবনের মূল্য। একজন আমেরিকান এই বিশ্বের কোথাও জেল খাটবে- এটা মেনে নেয়া যায় না; এমনটাই ভাবনা আমেরিকানদের। হোক সে যতবড়ই খুনী বা আসামী। সব কিছুর উপরে আমেরিকা! এটাই তাদের মুলনীতি।
 
আর বাংলাদেশের নাগরিকরা!
আপনি কি জানেন মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডের বনে জংগলে এই মূহুর্তে ঠিক কতজন বাংলাদেশী পালিয়ে বেড়াচ্ছে? কতজন বাংলাদেশী এই মুহূর্তে উত্তাল ভূমধ্যসাগর বা আটলানটিক কিংম্বা দক্ষিন ভারত মহাসাগর পাড়ি দেবার অকুল চেষ্টায় কোন এক ভাংগা নৌকায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে সময় পার করছে? কতজন বাংলাদেশী এই মুহূর্তে আমাজান জংগলে রয়েছে স্বপ্নের আমেরিকা যাবে বলে?
 
না। আপনি জানেন না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও জানেন না এসব তথ্য।
 
জানার কোন প্রয়োজনও তাদের নেই। কারণ ওদের জীবনের মূল্য যে ২০ হাজার টাকারও কম। শুধুমাত্র রাজধানী নিমতলী, চকবাজার বা বনানীর আগুনে মারা গেলে সম্ভবত হাজার বিশেক করে পাওয়া গেলেও যেতে পারে!
 
পুলিশ বা ছাত্রলীগ যখন প্রকাশে গুলি করে বা হাতুরী পিটা দিয়ে হত্যা করে তখন ঐ ২০ হাজারও মিলে না উপরোন্ত ট্যাগ জুটে জংগী বা মাদকপাচারকারীর!
 
ঢাকা একজন মাস্তান, ক্ষুদে সন্ত্রাসী অথবা পুলিশ বা রাবকেও নাকি মাত্র বিশ হাজার টাকার কন্ট্রাকে একজন মানুষকে হত্যা করে ফেলা যায় যখন তখন। পাথ্যর্ক শুধুমাত্র সেই মানুষটা একটু প্রভাবশালী বা বেশী পরিচিত হলে ২০ হাজার টাকা জায়গায় হয়তো খরচা করতে হয় লাখ খানেক টাকা!
 
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ এর গুলি বা তাদের প্রতিনিধি বিজিবির গুলিতে মরলে তো দু’পয়সাও মিলে না- বরং হয়ে যায় চোরাকারবারীর খেতাব!
 
অর্থাৎ গড়ে বাংলাদেশের মানুষদের জীবনের মূল্য তাহলে ২০ হাজারও হয় না!
 
অথচ এই, এদেশেই একটা মাঝারী সাইজ গরুর মূল্যও নাকি এখন ৭০ হাজার টাকা! তাহলে কার মূল্য বেশী দাঁড়ালো?
 
তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়নটা কোথায়!
মাটি? বহুতল ভবন? ব্রীজ-কালভার্ট? রোড-হাইওয়ে?
 
এদেশে যত সংগীত রচনা হয়েছে তার সবগুলিতেই দেশ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘মাটি’। কেউ বলেছেন সোনার বাংলা, বাতাস, গন্ধ, মাটি এসব নিয়েই না কি দেশ! কেউ আবার সুজলা সফলা শস্য শ্যামলা এসবও!
 
পাকিস্তানীরা মাটি রক্ষা করতে ৭১ এ মানুষ হত্যা করেছে নির্বিচারে!
তখনও তাদেরও দরকার ছিল ৬৮ হাজার বর্গমাইল জমির।
 
কিন্তু ১৯৪৭ সালে কিন্তু ভারত ভাগ হয়েছিল মাটির হিসাবে নয়! ভারত ভাগ হয়েছিল মানুষের হিসাবে! যে মাটিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্ষ্য সেই মাটি পেয়েছিল পাকিস্তান আর ঠিক অনুরূপভাবেই হিন্দ সংখ্যাগরিষ্ঠরা পেয়েছিল হিন্দুস্থান।
 
৪৭ এ মানুষের মুল্য বেশী থাকলেও ৭১ এ এসে মাটির মূল্যমান বেড়ে যায়।
 
আর সেই থেকেই বাংলাদেশের মানুষ আজও দেশ বলতে বুঝে ‘মাটি’। এবং মাটির মূল্য উর্ধমুখী হলেও মানুষের মূল্য মারাত্মকভাবে নিম্নমূখী!
 
আর তাইতো ওদেশে মানুষে নয়, মাটিতেই মানুষ বেশী বিনিয়োগ করে, করছে।
 
একটা জাতি কতটা বেকুব হলে, কতটা বুদ্ধিহীন হলে ‘মাটি’কেই দেশ মনে করে তার মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়- সেটা ভাবতেও আমার গা হীম হয়ে যায়!
 
‘মানুষ’ নিয়ে যেদিন থেকে দেশ ভাবতে পারবেন- সেদিন থেকেই বাংলাদেশ হয়তো সভ্যতায় পা রাখতে পারবে।
 
চলুন না ১৮০ ডিগ্রী ইউটার্ণ নিয়ে দেখি- পারি কি না?
 
সেদিন দেখা যাবে এই একজন পথহাড়া বাংলাদেশী ‘মানুষ’কে বাঁচাতেই দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেই চলে যাবে আমাজন জংগলে, অষ্ট্রেলিয়ার-পপুয়া নিউ গিনির বর্ডারে অথবা মরোক্কা-ইতালীর সংযোগস্থলে।
 
এমন একটা দেশ কি আপনি চান না যেখানে ‘মানুষ’ নিয়ে দেশ ভাবা হবে?
   Send article as PDF