‘স্বাধীনতা বিরোধী’

কৈশরে আমি খুব ভালো মুসলিম ছিলাম, গ্রামের মসজিদে ইমামতি পর্যন্ত করতাম, জুম্মার নামাজে খুতবাও দিতাম প্রায়ই। সেই দিনগুলি ভালই ছিল। এখন নষ্ট হয়ে গেছি! তখন প্রচুর ইসলামী বইও পড়তাম। অন্য বইতো পরতামই।
মেট্রেক পরীক্ষার পরপরই ছাত্র শিবিরের কিছু স্থানীয় নেতা আমাকে শিবিরে যোগদানের আহ্বান জানায় এবং আমি তাদের আহ্বানে সাড়া দিই। রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বোঝার জন্যই মূলত আমি ছাত্র শিবিরের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিই।
জামায়াত ও শিবির সম্পর্কে খুব দ্রুত আমি অনেক কিছু জানার সুযোগ পাই। তাদের কাজের ষ্টাইল, দল পরিচালনার ধরণ, নেতা নির্বাচন, কর্মীদের ট্রেনিং এবং কঠোরভাবে নিয়ম-নীতি মেনে চলা ইত্যাদি সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। বিশেষ করে ওদের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটা অসাধারণ! ‘সবাই প্রাথী সবাই নেতা’ এই কৌশলের কারণে জামায়াত বা শিবিরে কোন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেই বা হওয়ার সুযোগও নেই। কোন একজন চাইলেই জামায়াত বা শিবিরের বড় নেতা হতে পারবে না। সবাইকে সমর্থক থেকে কর্মী, সাথী, সদস্য এভাবে এগুতে হবে। এবং প্রতিটি স্তরেই নিজেকে কঠোরভাবে প্রমাণিত করতে হয়।
আমি বরাবরই কৌতুহলী মানুষ। আমার আগ্রহ বেশী। অার যুক্তির বাইরে আমাকে কেউ কিছু করাতে পারে না। অন্যদিকে সবচে বড় বিষয়টা হলো, নেতা হবার কোন আগ্রহই আমার মধ্যে কোন কালে ছিল না অথবা এখনও নেই।
শিবিরের কর্মী হিসাবে জয়েন করার মাস তিনেকের মধ্যেই আমি সাথী প্রার্থী হয়ে গেলাম। থানা পর্যায়ের একটা মিটিংএ দেখলাম তৎকালিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তুখোড় ছাত্র লীগ নেতা (নামটা বললাম না) সেই মিটিং এর প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত। তিনি আমার পরিবারের সাথে বেশ ঘনিষ্ট ব্যক্তি; এবং তিনি যে ছাত্র লীগ নেতা ও আওয়ামী লীগের অনেক বড় সমর্থক সেটা এলাকার সবাই জানে। যাই হোক, তার পরিচয় পেলাম শিবিরের একজন সদস্য তিনি। জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতির একটা কৌশল এটা। আমি খুব উৎসাহ পেলাম। শিবিরের ক্যাডার সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা পেলাম। আমি মোটামুটি মুগ্ধ।
কিন্তু আমার ভেতের ৩টি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়াতো সবসময়। প্রশ্নগুলি আমি সেই মিটিং এ উপস্থাপন করলাম।
১) জামায়াতে ইসলামী কেন স্বাধীনতা বিরোধী অপবাদ থেকে মুক্ত হতে পারছে না!
২) ইসলাম প্রতিষ্ঠাই যদি তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে কেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করতে হবে!
৩) জামায়াত বা শিবির তাদের শুভাকাংখীদের থেকে নিয়মিত দান বা অনুদান নিয়ে থাকে; এটা আমার কাছে ভাল কোন পদক্ষেপ মনে হয় না।
আমার এই ৩টি প্রশ্নের কোন যথার্থ সুন্দর উত্তর দিয়ে কেউ আমাকে কোনদিনও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমার মোটামুটি যা যা শিখার দরকার ছিল শিবিরের কাছ থেকে- আমি সম্ভবত ততটুকু শিখে নিয়েছিলাম। সুতরাং ৪ মাসের মাথায় আমি শিবিরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি।
এখানে একটা প্রসংগের অবতারণা না করে থাকতে পারছি না। সম্পূর্ণ মেমরী থেকে বলছি, তথ্যগত কিছুটা ভূল হতেও পারে তবে মূল ঘটনাটা ছিল:
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর কখনও নামাজ কাজা করতেন না; সবসময় যথা সময়ে তিনি নামাজ আদায় করতেন। একদিন ফজরের সময় ইবলীশ শয়তান হযরত উমরের পেছনে লেগে পড়লো- তাকে ঘুম থেকে উঠতে দেবে না; নামাজ কাজা করিয়ে ছাড়বেই। খুব নাকি হাত-পা টিপা-টিপি শুরু করে দিল। আরেকটু সময় যেন ঘুমিয়ে থাকে তার সব আয়োজন চালিয়ে গেল ইবলিশ শয়তার; যে-কোন মূল্যে তাঁর নামাজ যেনো কাজা হয়ে যায়। এবং শয়তান সফল হলো।
নামাজের ওয়াক্ত শেষে ঘুম ভাংলো হযরত ওমরের। তিনি তো প্রচন্ড ভেংগে পড়লেন। কিভাবে তাঁর নামাজ কাজা হলো। খুবই কস্ট পেলেন তিনি। সংগে সংগে ওজু সেড়ে নামাজে বসে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি জুরে দিলেন।
যাই হোক, পরের দিন ফজরের ওয়াক্ত হবার সংগে সংগে শয়তান এসে ধাক্কাধাক্কি করে হযরত ওমরের ঘুম ভাংগিয়ে দিল। হযরত ওমর প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? আমার ঘুম ভাংগিয়ে দিলে কেন?
শয়তার উত্তর দিল, স্যার, আপনি নামাজ আদায় করতে যান, আজানের সময় হয়েছে।
হযরত ওমর তো হতবাক। তুমি শয়তান আমাকে বলছো নামাজে যেতে? ঘটনা কি?
ইবলিশ শয়তান উত্তর দিয়েছিল, হুজুর গতকাল আপনাকে প্ররোচনা দিয়ে একটু বেশী ঘুম পারিয়ে নামাজ কাজা করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি মহান আল্লাহর দরবারে এতো বেশী কান্নাকাটি করেছেন আমার ধারণা আপনার গুনাহ তো মাফ হয়েছেই বরং আগের কোন পাপ থাকলে তাও মাফ হয়ে গেছে। তাই আমরা আর ঝুকি নিচ্ছি না। আপনি ওঠুন। নামাজ আদায় করুন।
আমার যুক্তিটা ছিল- জামায়াতে ইসলামী কি সেই সুযোগটাও পায়নি? তারা কি বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিজেদের পরিষ্কার করার দায়িত্বটা ঠিক মতো কেন পালন করলো না?
কেন তারা দীর্ঘ ৪৫ বছর সময় পাওয়া সত্বেও নিজেদেরকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ জঘণ্য অপবাদটা থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হলো।
এরপর, আমাদের স্থানীয় দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি যেহেতু সাহিত্য অনুরাগী হিসাবেই পরিচিত সেহেতু প্রথমে একদিন ছাত্র লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আমাকে প্রস্তাব পাঠালো ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে যেন আমি ‘সাহিত্য সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ পদের নির্বাচন করি। আমাকে কোন টাকা পয়সাও খরচ করতে হবে না; তারা সব রকমের সহযোগীতা করবে। আমি রাজী হলাম না।
ঠিক তার পরদিনই একই রকম প্রস্তাব পেলাম কলেজের ছাত্র দল শাখা থেকেও। আমি হাসলাম। অামি নেতা হতে চাই না। রাজনীতিতে কোন আগ্রহই আমার নেই। তারাও হতাশ হলো, আমি ইলেকশন করলে নাকি নিশ্চিন্তে পাশ করে যেতাম।
এরপর কোনদিনই আমি রাজনীতির ধারে-কাছে যাই নি। অার বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’কে তো আমি রীতিমত ঘৃণা করি। এরা নোংড়ামী ছাড়া কিছুই বুঝে না। দেশের মানুষগুলি হলো গিনিপিগ আর এরা জমিদার। এভাবেই চলছে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষনা করে এবং বিজয় অর্জন করে। বাংলাদেশকে প্রথম স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতদাতা দেশ হলো ভূটান। এটা মনে হয় সবাই জানেন।
কিন্তু দ্বিতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃতি দানকারী দেশ কোনটি, জানেন?
অনেকেই জানেন না।
উত্তরটা হলো ‘ইসরেল’।
হ্যাঁ, সেভেনটি ওয়ানে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী আমেরিকা, সৌদী আরব, চায়না এসব দেশকে বৃদ্ধ আংগুল দেখিয়ে রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে ইসরেল রাষ্ট্রটি বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় দেশ।
কিন্তু বাংলাদেশও এ বিষয়ে বিচক্ষনতা দেখাতে কাপর্ণ্য করেনি। নব গঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ইসরেলের স্বীকৃতিকে তো গ্রহন করেই নি বরং ইসরেলকেই অবৈধ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে তখনই।
আচ্ছা, চেতনাধারী, চেতনা ব্যবসায়ী, ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলনকারীরা বা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির লোকগুলি কি আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবেন যে, সেদিন বাংলাদেশের ‘চেতনা-ফেতনা’ কোথায় ছিল?
ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনা-ই নিয়েই যদি বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ করে থাকে, তাহলে সেদিন কোন চেতনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালীন সরকার ইসরেলকে অবজ্ঞা করেছিল?
তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে- বাংলাদেশ কোন কালেই এসব চেতনা ফেতনার উপর স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশ এর দামাল ছেলেরা ধর্মনিরপেক্ষ বা ওসব ফালতু চেতনা ফেতনার জন্য যুদ্ধ করতে যায়নি। তারা নিজস্ব একটি ‘গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ভূমি’র অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ করেছিল।
চেতনাজীবিরা কৈ?
   Send article as PDF