আকাশে বাতাসে …

১৯০৩ সালে রাইট ব্রাদার্স যখন তাদের সাইকেল মেরামতির দোকান থেকে এয়ারক্রাফট বানিয়ে ফেললেন- তারপর থেকে মানুষ আকাশে উড়তে শিখে গেল।
 
এরপর ১৯১৪ সালের পহেলা জানুয়ারী আমেরিকার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে থামফার প্রথম বানিজ্যিক ফ্লাইট (এয়ারবোট লাইন) পরিচালনার মধ্য দিয়ে মানুষ উড়ান যুগে প্রবেশ করে। প্রথম ফ্লাইটটি পরিচালিত হয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে- যেন দুর্ঘটনা হলেও বিমানটি পানিতে আছড়ে পরে এবং কেউ হতাহত না হয়।
 
তবে মূলতঃ ১৯৪০ সাল থেকেই টিডব্লওএ ডিসি-৩ ডগলাস এয়ারক্রাফটের মধ্য দিয়ে মানুষের নিয়মিত দেশ বিদেশ চলাচল শুরুর মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা ঘটে।
 
যাই হোক আমার জন্ম তো আর শতবর্ষ আগে না। সুতরাং আমার কাছে ওসবই ইতিহাস। তবে, আনন্দ উদ্দিপক ইতিহাস। আমি পুলকিত হই। বিস্মিত হই।
 
আর তাই তো সরাসরি নিজের চোখেই সেদিন দেখে আসলাম রাইট ব্রাদার্সের তৈরী করা ১৯০৩ সালের সেই প্রথম বিমানটি।
 
ওয়াশিংটন ডিসির কোন একটা প্রাইমেরী স্কুলের বাচ্চাদের ওদিন দেখানো হচ্ছিল প্রথম এয়ারক্রাফটি। ৫/৬ বছরের ছোট ছোট মাল্টিকালার শিশুরা তাদের গর্বের উজ্জ্বল অতীত দেখছিল খুবই সাদা-মাটা ও স্বাভাবিক নয়নে।
 
কিন্তু এই অর্ধবৃদ্ধ অধমের কাছে ঐ শিশুদের একই লাইনে দাঁড়িয়ে অতৃপ্ত চোখে এবং ক্ষধার্থ মনে- মনে হয়েছিল পুরো দু’টি দিন যদি এখানে দাঁড়িয়ে দাাঁড়য়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও একটু দেখতে পারতাম এই বিস্ময়কর আবিষ্কারটি।
 
পাক্কা ১ ঘন্টা সময় নিয়ে দেখেছিলামও সেই প্রথম সাইকেল প্রযুক্তির বিমানটি। অথচ এই আমি-ই কিনা অন্তত তিন শতাধিক বার বিমান ভ্রমণ করা মানুষ!
 
তারপরও তৃপ্তি মিটেনি।
 
ভাবছি যাবো একদিন সেই সাইকেল মেরামতির ফ্যাক্টরিটি দেখতে ওহাইও’র ডেটনে। যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে চালানোর বাই-সাইকেল মেরামতি করতেন সেই দুই বিখ্যাত ভাই অরভিল রাইট ও ওইলবার রাইট।
 
ওই বাড়ীটির সামনে দাঁড়িয়ে যদি একটা ছবিই না তুলতে পারলাম- তাহলে যেন আমার জন্মটাই বৃথা হয়ে না যায়!
 
জেনারেল এরশাদ যখন দেশের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের সরকারী কেনাকাটায় চুরি-কর্ম-টি প্রতিষ্ঠা করেন তার ঠিক কোন এক সময় জনগণের কষ্টের ট্যাক্সের টাকায় কেনা হলো বাংলাদেশ বিমানের জন্য উচ্চমূল্যের অথচ অতি সস্তা যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরী ‘এটিপি এয়ারক্রাফট’ যা মাত্র কয়েক বছর পরেই গারবেজ করে ফেলা হয়।
 
এই অধম গুলিস্তান থেকে কেনা একটা চটি বইয়ে দেখতে পেল যে চিটাগাং থেকে কক্সেস বাজারের বিমান ভাড়া মাত্র ২৫০ টাকা।
 
আর দেরী করে কি কোন লাভ আছে?
মাস দুয়েকের মধ্যেই হাজার দেড়েক টাকা কোনভাবে জোগার করে, ডলফিন পরিবহনের বাসে ১২০ টাকা টিকেট কেটে চিটাগাং চলে গেলাম।
 
কোন এক শনিবার। বন্ধু মাহাবুবকে সংগে নিয়েছিলাম প্রথম বিমান ভ্রমনে। সেটা সম্ভবত ১৯৯৪ সাল হবে।
 
অনেক জটিলতা করে টিকেট কাউন্টারের একজন কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ম্যানেজ করে নিলাম দু’টি ওয়ান ওয়ে টিকেট। সংগে আরও ৫০ টাকা নিল এয়ারপোর্ট ট্যাক্স; আর এক পিস কেক খেয়েছিলাম সেদিন ৫০ টাকা দিয়ে। সেই ৫০ টাকার দুঃখ আজও ভুলতে পারলাম না।
 
যাই হোক মাত্র ৩০ মিনিট আকাশে উড়ে, এক গ্লাস ফলের জুসে আপ্যায়িত হতে পৌছে গেলাম সমুদ্র শহর কক্সেস বাজার।
 
এরপর তো বিমান ভ্রমনটা হয়ে উঠলো আমার লোকল বাসে যাতায়াতের মতোই। এই পৃথিবীর কত কত এয়ারলাইন্স, কত কত এয়ারপোর্ট যে আমাকে বরণ করেছে- তার আর হিসাব কতদিন রাখা যায় বলুন!
 
যাই হোক আমেরিকায় আসার পর গত দু’বছরে খুব একটা বিমান ভ্রমণ হয়ে উঠেনি।
 
স্কাজুয়াল ঠিক না থাকার কারণে, যথেষ্ঠ ফ্লাইট না থাকা ও আমার মূল্যবান দামী সময় বাঁচাবার জন্য বাংলাদেশ বিমানে খুব একটা উড়তাম না। তবে, বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা কুয়ালা লামপুর ঢাকা ফ্লাইটে এক প্যাকেট বিরিয়ানী খাবার লোভে অনেক চড়া দামেও প্রায়ই বাংলাদেশ বিমানকেই বেছে নিতাম। সেই বিরিয়ানীর স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে।
 
বাংলাদেশ বিমানের পাইলটদের (ক্যাপ্টেন) মাত্র ২/৩ জনের সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল- তবে অধিকাংশদেরই চিনতাম না। চেনার কথাও না। কিন্তু এখানে না উল্লেখ করে পারছি না যে তারা অত্যন্ত সতর্কতার সংগে বিমান অপারেট করতেন বা করেন। আমি যেহেতু অনেক দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্স এ ভ্রমন করেছি সেহেতু অনেক অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি- তারা অত্যন্ত সংযত, ধীরস্থিরভাবে এবং ঠান্ডা মাথায় ফ্লাইট অপারেট করেন।
 
নিউ ইয়র্কের লাগুরডিয়া এয়ারপোর্টটি আমার বাসার খুবই কাছে। প্রতি মিনিটেই আমার বাসার উপর দিয়ে একটি করে বিমান উড়ে যায় ওই এয়ারপোর্টের রানওয়েতে ল্যান্ডিং গিয়ারে। আমি প্রায়ই ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবেও ওদের ফ্লাইয়িং ও ল্যান্ডিং টা দেখি। দেখতে ভালো লাগে।
 
কিন্তু ম্যাক্সিমাম ডোমাষ্টিক ফ্লাইটের এই এয়ারপোর্টে যেসব ক্যাপ্টেনরা এয়ারক্রাফট অপারেট করেন- তারা অত্যন্ত রাফএন্ডটাফ ভাবে ফ্লাইট উঠানামা করান। আমি মাঝে মধ্যে ভয়ই পেয়ে যাই ওদের উঠা-নামার স্টাইল দেখে। অনেক সময়ই দেখি প্রায় খাড়াভাবেই উপরে উড়ে যায়। নামার সময়ও খুবই দ্রুত গতিতে ভয়ংকর বেগে পাক দেয়।
 
ওদের সাহস আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।
কিন্তু কখনও দুর্ঘটনায় পরতে দেখি না, ওদের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমেনা একটুও।
 
বিমানে উঠলে সবসময়ই এয়ারহোষ্টেজদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় সীটবেল্ট বাঁধা নিয়ে। বিশেষতঃ উঠা ও নামার (টেক অন বা টেক অফ) সময় এই ব্যস্ততা চোখে পরার মতো। কিন্তু আমি এই কাজটা নিতান্ত বাধ্য না হলে করতামই না।
 
উঠার সময় তো সীটবেল্ড বাঁধার কোন প্রয়োজনই দেখি না।
নামার সময় যারা নিজেদের ব্যালেন্স রাখতে পারেন না- তাদের অবশ্যই বাঁধা উচিৎ; কিন্তু আমি ব্যালেন্সড ম্যান। (দুঃখিত, প্লিজ আমাকে কেউ ফলো করবেন না- এটার ফল মারাত্মক হতে পারে।)।
 
অনেক এয়ারলাইন্সেই এয়ারহোষ্টেজরা আমার কাছে আসতো চেক করতে- আমি যাষ্ট আইপ্যাড বা ছোট ব্যাগ যখন যা হাতের কাছে থাকে সেটা আমার কোলের উপর এমনভাবে দিয়ে রাখি যে ওরা বুঝে উঠতে পারে না সীটবেল্ট বেঁধেছি কি না। আর আমি ওদের দিকে তাকিয়ে মওদুদ স্টাইলে মিটমিট করে হাসি।
 
অনেকে আবার দেখেও কিন্তু কিছু বলে না- হয়তো আমার স্মার্টনেসের সংগে লাগতে আসে না।
 
জেড ব্ল এয়ারক্রাফটি বোয়িং এর।
নিউ ইর্য়ক জেএফকে থেকে লস এঞ্জলেস ল্যাক্স যাবো।
রাত সাড়ে নয়টার ফ্লাইট।
 
সাবওয়ে ধরে জ্যামাইকা সাটফিন ষ্টেশন থেকে এয়ার ট্রেনে করে চলে গেলাম জেএফকে এয়ারপোর্টে। আমি একটু পাকনামী করে মাত্র দেড় ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে এয়ারপোর্ট কাউন্টারে উপস্থিত হলাম। অথচ এই এয়ারলাইন্স কোম্পানী সেই সকাল থেকেই আমাকে কম করে হলেও ১০বার এসএমএস, ব্লুটুথ, ইমেইলে মেসেজ পাঠিয়েই যাচ্ছে সময় মতো কাউন্টারে পৌছতে।
 
বিধি বাম।
কাউন্টারে বিশাল কিউই।
মানুষের লাইন যেন শেষই হয় না।
সত্যি সত্যিই চিন্তায় পরে গেলাম।
 
আমেরিকায় বোর্ডিং পাস যার যার টা নিজেকেই নিজ দায়িত্বে প্রিন্ট করে নিয়ে যেতে হয়। এদেশে লোকের অভাব তাই সব কাজই অনলাইন এবং সেলফসার্ভিস।
 
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না চাইলে বা ভাল সীট চাইলে আপনাকে অনলাইনে সার্ভিস কিনে নিতে হবে। আমি গরীব মানুষ ইকোনোমী ফ্লাইটে যাবো। বোডিং পাস প্রিন্ট করেছি কিন্তু কোন সীট নাম্বারও পাইনি। পরে হয়তো রানডম কিছু একটা জুটবে কপালে।
 
এরা কোন খাবারও দিবে না ফ্রিতে (কমপ্লিমেনটারী) অথচ ৬ ঘন্টার ফ্লাইট।
 
যাই হোক, আমি তো ঘামছি। নন-রিফানডেবল টিকেট। ফ্লাইট মিস হলে যাত্রা তো বাতিল হবেই একটা টাকাও ফেরত পাবো না।
 
সোয়া নয়টা বাজে। আমার সামনে তখনও প্রায় ২৫-৩০ জন লাইনে।
 
হঠাৎই লক্ষ্য করলাম, খুবই দ্রুতই মানুষ ঢুকে যাচ্ছে আমিও নয়টা পঁচিশে সিকিউরিটি চেকে পৌছে গেলাম। সকলকে জুতা, বেল্ট খুলতে হয়। আমি একটু বাহাদুরী করলাম, বেল্ট খুললাম কিন্তু জুতা খুললাম না।
 
জানি না কোন কারণে বিশ্বের তাবৎ এয়ারপোর্টগুলি আমাকে একটু বিশেষ কদর করে! সিকিউরিটির বিশালদেহী কালো মেয়েটি লক্ষ্য করলো কিন্তু কিছুই বললনা আমাকে- ওয়াকথ্রুতে ঢুকতে বলল। আমি ঢুকলাম, কোন সংকেত না পাওয়াতে চলে যেতে বলল।
 
১ মিনিট সময় আছে আমার হাতে। ১৯ নাম্বার গেট খুঁজে পেতে হবে।
 
দিলাম ভো দৌড়। এমনিতে আমি বেশ ভালই দৌড়াতে পারি। সমস্যা হলো না, কাটয় কাটায় নয়টা ত্রিশে জেট ব্লর গেটে।
 
বোর্ডিং পাস হাতেই ছিল। মেয়ে দু’টি তাদের গেট বন্ধ করতে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থামলো। আমি নিজেই আমার বোডিং পাসটি স্ক্যান করলাম।
 
সুন্দরী সাদা মেয়েটা হেঁসে দিল। আমিও হেসে দিয়ে বললাম, ‘আমি কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবো না কি? ঝপটপ জানালার পাশে আমাকে একটা সীট দিয়ে দাওতো। দেখি পারো কি না?’
 
মেয়েটি আরও মিষ্টি করে হেঁসে দিয়ে বলল, ‘ওকে, তোমাকে আমি বিমানের বেষ্ট সীটটিই দিচ্ছি, ডোন্ট ওরী; এবং তোমার ক্যারীঅনটিও তোমাকে কষ্ট করে নিতে হবে না- আমিই নিয়ে নিচ্ছি, তোমার ফ্লাইট আনন্দময় হোক’।
 
আমি মুগ্ধ হলাম।
জীবনে প্রথমবার শেষ যাত্রী হিসাবে কোন এয়ারক্রাফটে অন বোর্ড হলাম।
 
এয়ারক্রাফটি নড়াচড়া শুরু করলো।
 
সব ঘোষনাই দিচ্ছে কিন্তু সেলফোন অফ বা এয়ারপ্লেন মোডে নিতে বলছে না, কোন ইলেকট্রনিক্সও বন্ধ করতে বলছে না; তবে শুধুমাত্র স্যামসাং সেভেন নিয়ে কাউকে ফ্লাই করতে দেয়া হয় না আমেরিকাতে। ওটার ব্যাটারী রিক্সি বলে। আমি দিব্যি ফেসবুকে ঢুকে গেলাম। সীটবেল্ট বাঁধার কতো তো তুললোই না।
 
ফ্লাইটটি টেক অন করলো। আকাশেও বেশ কিছুসময় পর্যন্ত স্পিরিন্ট মোবাইলের ইন্টারনেট পাওয়া গেল। এরপর এয়ারহোষ্টেজ এসে আস্তে আস্তে বললেন, ‘তুমি তোমার মোবাইলে সম্পূর্ণ ফ্রিতে আমাদের ইন-ফ্লাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে- ওয়াইফাই চেক করো’।
 
আমি ইন্টারনেট পেয়ে গেলাম। ৩৪ হাজার ফুট উপরে আকাশে উড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকিং জীবনে প্রথমবার।
এ আরেক অভিজ্ঞতা।
 
পর্যাপ্ত খাবার পানির বোতল এবং আনলিমিটেড স্নাকস ওরা পরিবেশন করেছে আমার সেই ফ্লাইটে। জেটব্লকে ধন্যবাদ।
 
কোনদিন কি দিন দুয়েকের জন্য একটু চাঁদের উদ্দেশ্যে স্পেসফ্লাইটে উঠার সুযোগ হবে? বা সৌভাগ্য?
 
খুব বেশী ইচ্ছে রয়েছে।
কাকতলীয়ভাবে আমার বেশীরভাগ চাওয়াই পূরণ হয়ে যায়!
 
দেখা যাক সময় কি বলে?
 
 
   Send article as PDF