আজান

আমার গলায় সুর নেই; তাই গান গাইতে পারিনা।
এটা নিয়ে আমার অবশ্য কোন দুঃখ নেই। কারণ গানের বিষয়ে আমার আগ্রহ যথেষ্ঠ নয় কোন কালেও।
 
গলায় সুর না থাকলেও কৈশরে যখন আমি স্কুলে পড়তাম তখন প্রায়ই মসজিদে গিয়ে আজান দিতাম। আমার আজান মোটেও সুন্দর ছিল না- তারপরও দিতাম, দিতে হতো। আমাদের গ্রামের ইমান ভাই দারুণ আজান দিতেন- তার আজানের সুরটা অনেকটাই ছিল বায়তুল মোকাররাম জাতীয় মসজিদের আজানের মতোই। সেই ইমান ভাই এখনও গ্রামেই থাকেন কিন্তু আজান দেন কিনা ঠিক বলতে পারছি না।
 
ব্লাক আফ্রিকান ক্রীতদাস সাহাবী বেলাল (রা) কে তার মুনিব ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার জন্য মারাত্মক রকমের শাস্তি দিতো। মরুর ভয়াবহ উত্তপ্ত বালুতে তাকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হতো। তাঁর জিহ্বাও কেটে ফেলা হয়েছিল যেন সে কলেমা উচ্চারণ করতে না পারেন।
 
বেলাল (রা) ঠিকমতো কথাও বলতে পারতেন না।
 
অথচ এমন একটা সময় আসে যখন বেলাল (রা) আজান না দিলে- মহান আল্লাহর আরশ পর্যন্ত আজান পৌছতো না; এবং তাতে বাধ্য হয়ে বেলাল (রা) কে-ই আজান দিতে হতো নিয়মিত।
 
আসলে সুর’টা মূখ্য বিষয় নয়- বিষয়টা হলো ভালবাসা।
কে কতটা ভালবেসে, দরদ দিয়ে কাজটা করছে- সেটাই আসল বিষয়।
 
মুহাম্মদ (সা) সপ্ত আসমান ভ্রমণ শেষ করে ফেরার পর একদিন বেলাল (রা) কে ডেকে বললেন, ‘বেলাল (রা)- তুমি কি কোন বিশেষ ইবাদত করো- যেটা আমি জানি না? কারণ আমি দেখলাম বেহেশতে আমার আগে আগে আরেকজন মানুষের পায়ের আওয়াজ যেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম- তুমি সেটা।?’
 
বেলাল (রা) কিছুটা ভয় এবং বিব্রতবোধ নিয়ে বললেন, ‘জ্বী হুজুর একটা বিশেষ কাজ সবসময় করি আর সেটা হলো- আমি কখনও অপবিত্র থাকি না; সবসময় ওজু রাখি।’
 
যাই হোক, বলছিলাম আজান নিয়ে।
আমেরিকায় আজান শোনা যায় না- বিষয়টা নিয়ে আমি একটা আর্টিকেলও লিখেছিলাম গেল বছর। আমেরিকায় ‘আইন’ই সবকিছু; আইন-ই আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে- আইনের বিরুদ্ধে কোন কাজ এখানে করা অসম্ভব। তো, নির্ধারিত শব্দসীমার বেশী আওয়াজ এদেশের ভূমিতে অনুমোদনযোগ্য নয়। আর সে কারণে শুধুমাত্র আজানের বাড়তি শব্দই নয়- অন্য কোন ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক আওয়াজও এখানে করা যায় না।
 
সুতরাং আজান শোনারও কোন সুযোগ নেই (২-একটা বিচ্ছিন্ন বিশেষ অনুমতি ব্যতীত)।
সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ঘড়ির সময় দেখে; পবিত্র রমজানেও ঘরে ইফতার করলে ঘড়ি দেখেই ইফতার করতে হয় বা চোখ রাখতে হয় লোকল ইসলামী টিভি চ্যানেলের দিকে।
 
এতসব আইন-নিয়মনীতির বাইরেও আমেরিকায় বেশ কিছু মজার বিষয় রয়েছে।
যেমন, আগেই বলেছিলাম আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে ঘোষনা দেয়া একটা বড় স্ট্যান্ড লাগানো রয়েছে- যেখানে বলা হয়েছে ‘মুহাম্মদ (সা) এই বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইন-প্রণেতা’।
 
ব্রুকলিন বোটানিক্যাল গার্ডেনের লাগোয়া ব্রুকলিন মিউজিয়ামের মূল ভবনের চারপাশে বড় বড় করে খোদাই করে এই পৃথিবীর সব ধর্মীয় পথ-প্রদর্শকদের নাম লেখা রয়েছে অত্যন্ত সম্মান ও যত্ন সহকারে এবং সেখানে বড় বড় হরফে ইংরেজীতে ‘মুহাম্মদ’ (স) লেখাটিও যে-কারোরই চোখে আটকাবেই।
 
নিউ ইয়র্ক সিটিতে বা ম্যানহ্যাটনে বিশাল একটা পার্ক রয়েছে যার নাম সেন্ট্রাল পার্ক।
আমি সুযোগ পেলেই ঐ পার্কে যাই, বসি, ছবি তুলি। ম্যানহাটনে আমার ভাললাগাগুলি ঐ সেন্ট্রাল পার্ক আর টাইমস স্কোয়ারেই আটকে রয়েছে।
 
গেল উইকেন্ডে হঠাৎই কোন পরিকল্পনা ছাড়া গেলাম ‘আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিষ্টরী’ দেখতে। সেন্ট্রাল পার্ক লাগোয়া ৮১ ষ্ট্রিটে- কলম্বাস সার্কেলেরও নর্থে, আপটাউনে।
 
মেইন মিউজিয়ামে এন্টারেন্স ফি ১৮ ডলার, আমি ওখানকার থিয়েটারে (প্লানেটারিয়াম) এ ৩০ মিনিটের ‘স্পেস শো’টাও দেখবো- তাই টিকেট কাটতে হলো ২৩ ডলার দিয়ে।
 
মিউজিয়ামটি অনেক বড়।
বলতে গেলে আমেরিকার জৈব বৈচিত্র তো বটেই- পুরো পৃথিবীকেই এই মিউজিয়ামে তুলে ধরা হয়েছে। আর আপনি যদি ‘স্পেস শো’ দেখেন তাহলে তো শুধুমাত্র পৃথিবী-ই নয়; সম্পূর্ণ মহাবিশ্বটা-ই দেখে ফেললেন।
 
কোলকাতায় বিড়লা প্লানেটারিয়াম এ সেই ১৯৯৬ সালেই (আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমনে) প্রথম তারামন্ডল দেখি। সেই স্মৃতি আমার তো রয়েছেই, স্যাংহাইতেও একবার দেখেছিলাম প্লানেটারিয়াম। ঢাকার ভাষানী নভোথিয়েটার দেখার সময় করতে পারিনি।
 
তবে, সবকিছু ছাড়িয়ে আমেরিকার এই স্পেস শো’টি সত্যিই অনেক এডভান্সড।
 
সে যাই হোক, ২৩ ডলার দিয়ে যে টিকেট কাটলাম- সেই টাকার কাছে এসব খুব বেশী একটা সম্মানজনক মনে হলো না।
 
ফিরে আসবো।
ফাষ্ট ফ্লরে হঠাৎ ‘আফ্রিকান পিপল’ প্যাভেলিয়ানটা চোখে পড়লো।
তখনই মাথায় আসলো, আফ্রিকান পিপল যেহেতু রয়েছে সেহেতু এজিয়ান পিপলও থাকবে। যাই-ই না, গিয়ে একটু দেখে আসি ‘আমাদের’-কে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এই মুল্লুকে।
 
আফ্রিকান ব্লাক পিপলদের নজরকাড়া অনেক কিছুই দেখলাম।
ভালো লাগলো। তার পরের প্যাভেলিয়ানটি-ই ‘এজিয়ান পিপল’দের। ঢুকলাম।
 
ঢোকার সংগে সংগে আমার শরীরটা এক অসাধারণ পবিত্র পরশে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। প্রথমেই এজিয়ান মুসলিমদের ঐতিহ্যসমূহ তুলে ধরা হয়েছে- কিন্তু সেসব নয়! আমার কানে ভেসে আসলো অত্যন্ত সুমধুর কন্ঠে আজানের ধ্বনি … আছছালাতু খায়রুন মিনাননাউ …; আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ই-লাহা ইল্লাললাহ!
 
আজানের ধ্বনি-তে যে এতটা সৌন্দর্য্য, এতটা পবিত্রতা, এতটা আবেদনময়তা, এতটা গা হিম করা স্পর্শ লুক্কায়িত থাকে- সেটা আগে কোনদিনও বুঝতে পারিনি। আগে হয়তো কোনদিনও এভাবে আজানের এই কয়েকটি লাইন ভেবে দেখিনি।
 
অনেকটা সময় লেগেছিল আমার সম্বিত ফিরে পেতে।
আমি ফজরের আজানের ডাক শুনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখন দুপুর আড়াইটা বাজে। আর তখনই আমার বার বার কেন যেন বেলাল (রা) এর কন্ঠ’র কথাটাই মনে হচ্ছিল।
 
আমেরিকার মাটিতো এভাবে আজান শুনবো- এটা আমার ধারণারও বাইরে ছিল।
   Send article as PDF