ঢাকার যানজট

আপনি যদি কাউকে হয়রানী করতে চান বা দৌড়ের উপর রাখতে চান- তাহলে আপনাকেও কিন্তু তার পেছন পেছন যথেষ্ঠ দৌড়াতে হবে।

নিজে ভালো দৌড়াতে না পারলে কাউকে দৌড়ের উপর রাখাটাও অসম্ভব।

তারচে বরং ভালো কৌশলী হওয়া। যা করবেন কৌশলে করেন। নিজেকে দৌড়াতে হবে না।
বুদ্ধির মাইরটাই বড় মাইর।

জীবনের চলার পথে কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই একমাত্র ‘কৌশল’ই আপনাকে বিজয় দিতে পারে।

কপালের উপর নির্ভরতা কোন কাজের কথা না।

এই ধরুণ মাত্র দেড় লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছো্ট্ট একটা ভুখন্ডে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। কৌশল প্রয়োগের অভাবেই দেশটার আজ এ করুণ দশা।

আমাদের দেশটাকে বিশ্বের সংগে তাল মিলিয়ে সত্যিকারার্থে সামনে নিতে চাইলে কৌশল ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই।

বাংলাদেশে, বিশেষত রাজধানী ঢাকার যানজন এর উপর একটি সহজ কৌশল নিয়ে কথা বলবো।

ঢাকা শহরে আনঅফিশিয়ালী প্রায় দেড় কোটি লোকের বসবাস এবং ঈদের আগে এই সংখ্যাটা দু’কোটিতে গিয়ে দাড়ায়।

আমি যখন ঢাকা থাকতাম, ২০১০-২০১২’র দিকে বছর দু’একের জন্য আমার অফিস নিয়েছিলাম পল্টনে, আর বাসা তো গ্রীনরোড এ-ই।

আমি বাসা থেকে গাড়ী নিয়ে বের হতাম। পান্থপথ চৌরাস্থায় মোড় নিয়ে বসুন্ধরা পর্যন্ত পৌছতেই অনেকটা সময় চলে যেত। অপর দিকে মাঝে মধ্যেই বসুন্ধরা ও কাওরান বাজার-সোনারগাঁও সিগন্যালে ভয়াবহ ট্রাফিক!

আমি কি করতাম?

বসুন্ধরার সামনে গিয়ে গাড়ী থেকে নেমে যেতাম। ড্রাইভারকে বলতাম ‘তুমি আস্তে আস্তে গাড়ী নিয়ে অফিসে চলে আসো’।

অতপর অামি সুন্দরবন হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে বাংলা মোটর ধরে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ এর ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে হোটেল শেরাটনের পেছন দিয়ে রমনা পার্কের ভেতর হয়ে বাতাস খেতে খেতে মৎস ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে পৌছে যেতাম পল্টন।

আমি খুব ভালো হাঁটতে পারি।

ফরটি ফাইভ থেকে ফিফটি মিনিটস এর মধ্যেই আমি অফিসে পৌছে যেতাম। তারও প্রায় আধ ঘন্টা পর আমার ড্রাইভার বেচারা অফিসে পৌছতো গাড়ী নিয়ে।

এটা বলতে গেলে আমার রেগুলার চলার রুটিন হয়ে গেল।

ওসময় হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছুই চোখে পড়তো।

– ঢাকার ফুটপাতগুলি চলাচলের অনুপযোগী, নোংড়া, ভাংগা এবং সরু। কিন্তু তারচেও বিরক্তিকর দু’টো বিষয় ছিল অপ্রসস্থ ফুটপাত দিয়ে মোটর সাইকেলওয়ালারা কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে যেভাবে ইচ্ছে চলে যেত। যেন ঢাকার ফুটপাত মোটরসাইকেলওয়ালাদের জন্যই তৈরী হয়েছে!

চাকুরীজীবি বা বেকার ছেলেরা ঐটুকুন ফুটপাতে ৪/৫ জন মিলে সিগারেট খেত আর ফুটপাত বন্ধ করে গোল হয়ে দাড়িয়ে আড্ডা দিতো- এবং পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে পারছে কি পারছে না তাতে তাদের কি এসে যায়?

এবং, সবচে বিরক্তিকর আরও একটা বিষয় ছিল সেই ফুটপাতটা যেন একটা উম্মুক্ত টয়লেট। আমরা ইন্ডিয়ানদের কথায় কথায় টয়লেট দেবার প্রস্তাব করি- অথচ নিজেদের দিকে কিন্তু খুব একটা তাকাই না।

এই তিনটি ভয়বহ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে আমি সেই ফুটপাত ব্যবহার করতাম।

বিরক্ত হতাম। কিন্তু আমার তো আর কোন বিকল্প ছিল না।

একটা শহরকে যানজট মুক্ত করতে সামান্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেই চলে।

কিন্তু এই সামান্য পদক্ষেপগুলি নিতে হলে একজন মানুষকে আগে অসাধারণ, মেধাবী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে এবং বুক ভরা সাহস থাকতে হবে।

নিম্ন-উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি নিতে ব্যর্থ হলে- আগামী ৫ বছর পর ঢাকা শহরে বসবাস করা সম্পূর্ণভাবেই অসম্ভব হয়ে পরবে:

১) ঢাকা শহরে ব্রান্ডনিউ গাড়ীর জন্ম সাল থেকে অনুর্ধ ৫ বছরের পুরাতন গাড়ী চলাচল করতে পারবে; কোন ইন্ডিয়ান গাড়ী ঢাকা শহরে চলতে পারবে না- ওগুলি অত্যন্ত বাজে কোয়ালিটির।

২) গাড়ীর বর্তমান ক্রয় মুল্য কমানো চলবে না। উপরন্তো বর্তমান ট্যাক্স ১৫০০সিসি সেডান কারের ক্ষেত্রে কমবেশী ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করতে হবে এবং বার্ষিক রিনিওয়াল এর জন্য সর্বমোট ফি ৫ লাখ টাকায় উন্নিত করতে হবে। ঢাকা শহরে ব্রান্ড নিও ছাড়া কোন গাড়ীর রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ করতে হবে। বাদবাকী গাড়ী ঢাকার বাইরে চলাচল করতে পারবে- তবে, সেখানেও ট্যাক্স ও রোড পার্মিট ইত্যাদি কয়েকশগুন বাড়াতে হবে। ওসব গাড়ী ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। মোদ্দকথা শুধুমাত্র অত্যন্ত ধনীরা ‘অতিরিক্ত খরচ’ সাপেক্ষে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট ইউজ করতে পারবে। সকলের গণহারে প্রাইভেট কারের জন্য ঢাকা শহর উপযোগী না- এটা সকলকে কনসিডার করতে হবে।

৩) ঢাকা শহরের ভেতরের প্রধান রাস্তাগুলির লেনে একসংগে শুধু দু’টি গাড়ী চলার উপযোগী করতে হবে- মানে রাস্তার প্রশস্ততা অনেক কমাতে হবে। এবং সেই স্থানে ফুটপাতের প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। যা বর্তমান ফুটপাতগুলিকে চার থেকে পাঁচগুন বেশী প্রশস্ত করতে হবে। এবং রাস্তার দু’পাশের ফুটপাতগুলিকে মানুষের চলার উপযোগী করার্থে কিছু কিছু স্থানে ‘এয়ারকন্ডিশনড চলমান সড়ক’ স্থাপন সহ চমৎকারভাবে সাজাতে হবে যেন মানুষ হেঁটে মজা পায় এবং হাঁটতে উৎসাহী হয়। এসব ফুঁটপাতের একটা লেনে চাইলে হকাররা তাদের পসরা নিয়ে বসতে পারবে কিন্তু তাতে ফুটপাতরে সৌন্দর্য্য যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়- সেটা সিটি কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।

৪) ঢাকা শহর থেকে সকল রিক্সা উঠিয়ে দিতে হবে, ঢাকায় কোন রিক্সা চলাচল করতে পারবে না। সকল সিএনজি অটোরিক্সাও তুলে দিতে হবে। রাজধানীতে উন্নতমানের ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করতে হবে।

৫) সিএনজি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে যেন গাড়ী চালাতে গ্যাসের অপচয় রোধ হয়। অন্যান্য জ্বালানী তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সংগে সবসময় (অনলাইন) সমন্বয় রাখতে হবে এবং এমন মূল্য নির্ধারণ করতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই তা অন্য দেশে পাচার না হতে পারে।

৬) রাজধানীতে পর্যপ্ত সংখ্যক আর্টিকুলেটেড ও ডাবল ডেকার পাবলিক বাস পরিচালনা করতে হবে- পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে যুযোপযোগী ও মডার্ণ করতে হবে। সেই সংগে তৈরী করতে হবে সাবওয়ে সিষ্টেম ও স্কাই ট্রেন। পাবলিক বাসগুলি এবং সাবওয়ে ও স্কাই ট্রেন একটি একক কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বর্তমানের মতো ‘যাচেছ-তাই’ স্টাইলে বেসরকারী খাত দিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন হতে কোন লাভ হবে না। ঢাকা শহরের চলাচলের জন্য আধুনিক রোড ম্যাপ তৈরী করা কোন বিষয়ই না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সিষ্টেম একটির সংগে অন্যটি সংযুক্ত থাকবে মাকরসার জালের মতোই প্রতিটি পয়েন্টে। যেন একজন মানুষ অতি সহজে ও দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌছে যেতে পারে।

৭) কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন, গাবতলী-মহাখালী-সায়দাবাদ এই চারটি প্রধান ট্রান্সপোর্ট পয়েন্টকে একটি ‘একক বহুতল ও পাতাল’ বিশিস্ট ভবনে নিয়ে আসতে হবে। ঢাকার বাইরে থেকে এই মেইন টার্মিনালটি সাবওয়েতে সংযুক্ত থাকবে।

৮) এবং, সবচে গুরুত্ব দিয়ে যে বিষয়টা চিন্তা করতে হবে- তা হলো, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং কার্যালয় একই কমপ্লেক্স এ হতে হতে যাতে তাদের যাতায়াত সীমত হয় এবং সাধারণ জনগণ এর সুফল ভোগ করতে পারে। এছাড়া, এয়ারপোর্টকেও স্কাইরেল ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এর সংগে যুক্ত করতে হবে। ‘এয়ারপোর্ট রেল ষ্টেশন’ থেকে সাবওয়েতে ঢাকা এয়ারপোর্টকে হাঁটা পথে সংযুক্ত করতে হবে এবং সেই সংগে লং ডিষ্টেন্স বাসগুলিও যেন ঢাকা এয়ারপোর্টকে টাচ করতে পারে যাত্রী উঠা-নামা করতে সেদিকেও নজর দিতে হবে। 

মানুষ বিশাল প্রশস্ত ও চমৎকার ফুটপাত পেলে কখনওই রিক্সায় চড়তে চাবে না। কোলকাতা শহরে গিয়ে দেখে আসুন সকলে অফিসে যাবার সময় এবং ফেরার সময় কত চমৎকার ভাবে হেঁটে চলাচল করছে। নিউ ইয়র্কের ব্যস্ততম ম্যানহ্যাটনও তাই।

আরেকটু দূরে হংকং যান।

হংকং খুবই ছোট্ট একটা শহর, সেখানকার জনঘনত্ব এই বিশ্বের মধ্যে সবচে বেশী। আপনি দেখতে পাবেন মূল রাস্তা অত্যন্ত সরু- কোন রকমে দু’টো গাড়ী একসংগে চলতে পারে। কিন্তু রাস্তার চেয়েও বেশ কয়েকগুন বড় তাদের ফুটপাত এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্নও। ওরকম ফুঁটপাত পেলে কে না হাঁটতে চাবে? হংকং এ প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টেশন অত্যন্ত হাতে গোনা। অথচ হংকং এমন একটা দেশ- যে দেশের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ৫৫ হাজার ডলার যা আমেরিকার সমান।

আপাত দৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি সমস্যা সামনে আসবে। যেমন সিএনজি ও রিক্সাওয়ালারা কি করবে? এটা কোন সমস্যাই না। উপরিউক্ত কাজগুলি করতে প্রচুর জনশক্তির প্রয়োজন পড়বে, দেশের অর্থনীতি অনেক চাংগা হয়ে যাবে। এরা বেকার হবে না, ওই কাজে তারা নিজেদের সংযুক্ত করে নেবে। তাছাড়া এতে ঢাকা ব্যয়বহুল শহরে পরিণত হবে এবং ঢাকার উপর থেকে মানুষের চাপ অটোমেটিকভাবেই কমে যাবে এবং মানুষ অন্যান্য শহরের দিকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে যাবে। ঢাকা কেন্দ্রিক কর্মকান্ড কিছুটা হলেও কমে যাবে।

সবচে বড় কথা, একটা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল মেরুদন্ড হলো- যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালি হলে এমনিতেই দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

ঠিক একইভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শহরগুলিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।

আসলে একটু মাত্র কৌশল অবলম্বন করলে- অনেক কঠিন কাজও কত সহজেই না করে ফেলা সম্ভব।

এছাড়া ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করা সম্ভব হবে না।

ভালো, এয়ারকন্ডিশন্ড, মডার্ণ ও পরিচ্ছন্ন পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন থাকলে আপনার আমার প্রাইভেট গাড়ীর দরকারটা কি?

ভাব নিয়ে দুনিয়া চলে না, বস!

   Send article as PDF