‘উন্নয়নশীল’

‘স্বল্পোন্নত’ এবং ‘উন্নয়নশীল’ শব্দদুটি নিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম।
বিপদটা হতো না- যদি না আমার ব্রেনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য একটিভ না থাকতো।
 
আমার মুখস্ত-শক্তি নেই বললেই চলে।
তবে, আমি যদি কোন বিষয় বাহ্যিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিধায় সেটাকে লজিক এপ্লাই করে মনে রাখতে চাই- তাহলে সেটা আমি কোনদিনও ভুলি না। চাইলেও ভুলতে পারি না। আবার কোন কিছু যদি প্রয়োজন বিধায় কষ্ট করে হলেও একবার মুখস্থ করে ফেলি, তাহলেও সেটা মাথার মগজে এমনভাবে আটকে যায় যে- সেটাকে আর ব্রেন থেকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না।
 
উদাহরণ দিতে পারি, বিজ্ঞানের ছাত্র আমি- বিষয় ভিত্তিক পড়াশোনার সংগে সম্পর্ক নেই বলতে গেলে প্রায় ২২ বছর কিন্তু এখনও আমি ‘সাবান’ এর প্রতীক ‘সোডিয়াম ষ্টয়ারেট’ (সি১৭এইচ৩৫সিওওএনএ) বলে দিতে পারি। আমি পরিস্কার জানি বৈজ্ঞনিক নাম ‘হিবিসকাসরোজা সাইনানসিস’ ও ‘বুফোমেলানো ষ্টিকটাস’ মানে যথাক্রমে ‘জবা ফুল’ ও ব্যাঙ। আমি এখনও ‘প্রটোজোয়া’, ‘পরিফেরা’, ‘স্লান্টিরেটা’ ইত্যাদি ১০ নামই ‘লোলাস্কা’, ‘কর্ডাটা’ পর্যন্ত মুখস্ত বলতে পারি। আকাশের দিকে তাকালে- এখনও ‘ট্যাপেস্ফিয়ার’, ‘স্ট্র্যাটোসফিয়ার’ ও ‘আয়োনস্ফিয়ার’ও দেখতে পাই।
 
‘সেই আমি’ আমার কৈশর বেলা থেকেই জেনে এসেছিলাম যে ‘বাংলাদেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ’।
 
বিষয়টা নিয়ে আমার শিক্ষকদের সংগে আমি আর্গুমেন্টও করেছিলাম- কিভাবে উন্নয়নশীল দেশ হয়, কেন গরীব দেশ বলা হবে না ইত্যাদি। তারা আমাকে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। আমার ব্রেন থেকে তা চলে যায় নি।
 
‌’সেই বাংলাদেশ’ কবে আবার ‘উন্নয়নশীল’ থেকে একধাপ নীচে নেমে ‘স্বল্পোন্নত’ দেশ হয়ে গেল এবং আবার এখন নাকি নতুন করে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে এবং সেটা নিয়ে শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার দেশে তুমুল লঙ্কাকান্ড বাধিয়ে বসেও রয়েছে!
 
দোষটা আমি আমার ব্রেনকে দিতেও রাজী ছিলাম, কিন্তু গেল বছর যখন আমেরিকা সফরে এসে শেখ হাসিনা তার ছেলের বাসায় বেড়াতে গেলেন, এবং সেদিনই ‘তার পাশের বাড়ী’র একজন ডাক্তার রাত ৮টার সময় গলব্লাডার সার্জারী করে ফেলল তখন-ই ভাবনাটা আরও এলোমেলো হয়ে গেল।
 
আমার স্মৃতিশক্তি আমাকে নিশ্চয়তা দেয় যে- একজন মানুষের একটাই গলব্লাডার থাকে এবং শেখ হাসিনার সেই গলব্লাডারটি ২০০৬ সালে একবার অপারেশেন করা হয়েছিল।
 
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর আমেরিকায় বসবাস করার অভিজ্ঞতায় আমি জানি যে আমেরিকায় ‘পাশের বাড়ীর কোন ডাক্তার’ কোন রোগীকে দেখতে পারে না- আইন নেই। এদেশে ৯১১ এর কল করতে হয় এবং হসপিটালে নিয়ে নির্দিষ্ট চেক-আপ শেষেই কেবল সার্জারী করা যায়।
 
আর শর্ট ভিজিটে যারা আসে তারা তো ‘পাশের বাড়ীর ডাক্তার’ দেখাতে পারবেই না- কারণ তাদের কোন ‘পিসিপি’ থাকে না। তারা শুধুমাত্র হসপিটালের ইমার্জেন্সীতেই চিকিৎসা নিতে পারে।
 
আমার নিজের গলব্লাডার যেহেতু গেল বছরই ল্যাপারসকপি করে বাদ দেয়া হয়েছে- সেহেতু আমি অারও জানি যে- রাত ৮টায় একজন রোগীকে হসপিটালে নিয়েই সার্জারী করা হয় না। অনেক কিছু করতে হয় এদেশে- মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেবার ভয়ে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ খুবই হিসাব-নিকেশ করে ডিসিসান নেয়।
 
যাই হোক, আমার আরও পরিস্কার মনে রয়েছে যে ১৯৯০ সালের দিকেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৫০ ডলার এবং তখনই বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ হিসাবে তালিকাভূক্ত করা হতো।
 
১৯৯০ সালে ১৫০ ডলার (প্রায় ৫৩০০ টাকা) দিয়ে বাংলাদেশে আড়াই ভরি স্বর্ণ কেনা যেত আর এখন হাচিনা সরকারের জমানায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৫০০ ডলার মানে ১২৮,০০০ টাকা দিয়েও আড়াই ভড়ির বেশী স্বর্ণমূল্য মেটানো সম্ভব হয় না।
 
সুতরাং, আমি আজও ‘উন্নয়নশীল দেশ’ কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না।
 
সে যাই হোক, আমি আসলে কয়েকটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম হাচিনা সরকারের বর্তমান ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ কথাগুলি নিয়ে।
 
সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমি চিনতাম।
চিনতাম মানে বেশ ভালোভাবেই তাকে চিনতাম যখন সে ১৯৯৪ সালে ঢাকার ধানমন্ডি ৬ নাম্বারে ইন্টিলিজেন্ট ট্রেড সিষ্টেমস লিমিটেড (আইটিসিএল) এ কমপিউটার সেলসম্যান কাম এবং সফটওয়্যার ইষ্টটল করার চাকুরী করতেন। সুদর্শন সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলা বলতে পারতেন না ভালো, চমৎকার ইংলিশ বলতেন।
 
সেই সজীব ওয়াজেদ জয় ২০০৮ এর নির্বাচনের আগ দিয়ে কোন এক ইন্টারভিও এ প্রেসকে বলছিলেন যে, ‘বাংলাদেশ কে ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে থাইল্যান্ড, সিংগাপুরের মতো উন্নত করে ফেলা করা সম্ভব’।
 
আমি হেসেছিলাম।
ইন্ডিয়াতে কৈশর কাটানো সজীব ওয়াজেদ জয় থাইল্যান্ড আর সিংগাপুরকে গুলিয়ে ফেলে কি বোঝাতে চাইলেন- সেটাই আমি তখন বুঝিনি।
 
সিংগাপুর আর থাইল্যান্ড এক জিনিস না রে বেকুব! দুই’টায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
 
যাই হোক, তারা (সে ও তার মা) বিগত ১০ বছর প্রায় ক্ষমতায়।
তারা এখন প্রচার করে ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল’, ‘বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা আরও বলে ‘বেশী উন্নয়ন এবং কম গণতন্ত্র’ দিয়ে শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই নাকি বাংলার মাহথির মোহাম্মদ হয়ে গেছে!
 
আসুন, অতি সাম্প্রতিক ৩টি স্ট্যাটিসটিকস দেখি।
এক) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর মধ্যে চতুর্থ।
দুই) বিশ্বের মোট ১১৩টি দেশের এর মধ্যে আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২ নম্বরে।
তিন) এশিয়ার সবচেয়ে খারাপ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শুধু নেপালের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া এশিয়ার অন্য সব দেশের সড়কই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।
 
আমি এখানে আর বলতে চাচ্ছি না যে শেখ হাসিনা সভ্যতা, আইন বা সংবিধানের কোন তোয়াক্কা না করে সেদিন এক লাথি দেয়ে দেশের প্রধান বিচারপতিকে অষ্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল।
 
শেখ হাসিনাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, কয়েকটা ব্রীজ-কালভার্ট বানালেই ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হওয়া যায় না- চাটুকারীতা হয়তো পাওয়া যায় মোসাহেবদের কাছ থেকে।
 
জিপিএ পাইপ প্রজন্ম সৃষ্টি করে অাপনি দেশের মানুষকে গরু-ছাগল বানাতে পারবেন- কিন্তু আখেরে আপনার অর্জন হবে শূণ্য, যেটা ইতিমধ্যেই হয়েছেও।
 
উন্নয়ন কি, কিভাবে উন্নয়ন করতে হয়- সেটা আগে ক্লাস করে শিক্ষা নিন।
 
সারা দেশের জন্য একটা সুপরিকল্পিত দূরদর্শি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক না করে বিক্ষিপ্ত কিছু ব্রীজ-কালভার্ট আর কয়েকটা হাইওয়ে চারলেন করলেই উন্নয়ন হয় না- এতে বরং দেশের মানুষের কষ্টের টাকাগুলি ধ্বংশ করা হয়।
 
বিরোধী মতের স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দিতে- বন্দুকের জোরে খুন, গুম, নির্যাতন করে কি উন্নয়নের গল্প শোনান আপনি?
 
আজ দেশের ১৮ কোটি মানুষের মাথায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা!
 
আর যা-ইচ্ছে-তাই ভাবে দেশের ব্যাংকগুলি লুট করে শূণ্য করে দিয়ে সেই টাকা পাচার করেছেন আমেরিকা, কানাডা আর ইউনাইটেড কিংডমে। আপনার পরিবারের আপনি ছাড়া একজন মানুষও নেই- যার কি না রয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব।
 
দেশের সব মানুষ কিন্তু আম্লীগ বা গরু-ছাগল হয়ে যায়নি এখনও!
 
কঠিন সময় অপেক্ষা করছে আপনাকে কঠিন শিক্ষা দিতে।
 
সেই শিক্ষা থেকে রেহাই পায়নি আপনার পিতা শেখ মুজিব, তার বন্ধু পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন বা লিবিয়ার মোয়াম্মের গাদ্দাফিও।
 
নিরীহ জনসাধারণের বুকে বন্দুক ধরে কয়েকদিন আনন্দ-ফূর্তি করা গেলেও- শেষটা করুণই হয়।
 
এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
   Send article as PDF