পুরান গল্প ০১

চ্যাংগঅনকে আমি নগর-ই বলতে পারি, এই প্রথম আমার কোন নগর দেখা।
প্রথম যেদিন এই নগরীতে আমি পা ফেলি, সেটাও আজ থেকে বছর তিনেক আগের কথা। হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম চতুর্দিকে। পাথর বিছিয়ে তৈরী করা সড়ক, প্রসস্থও অনেকটাই। এক সংগে ১০টি ঘোড়া তো স্বাচ্ছন্দে যেতেই পারবে।

কত মানুষ চারদিকে। ব্যস্ততা। প্রতিদিন দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসে, ক্রেতারা তাদের মুদ্রা বিনিময় করে কেনাকাটা করছে। এতো বড় বাজার হতে পারে ভাবিনি কখনও। গ্রামীন কৃষকরা প্রতিদিন টাটকা সবজী নিয়ে আসছে, কেউ নিয়ে আসছে তাজা মাছ। মুরগী-হাস। আরও কত কি?

যেদিকে তাকাই সেদিকের মুগ্ধতাই আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। চ্যাংগঅন পর্যন্ত না আসতে পারলে আমার এই জীবনটার কোন মানেই যেন আমি খুঁজে পেতাম না। প্রথম দিকে আমার ম্যান্ডারিন বুঝতে খুব ঝামেলা হতো। উপায়ওতো ছিল না কোন। আসলে বিকল্প কোন উপায় না থাকতে একজন মানুষ সবই করতে পারে, যেমনটা আমি এখন অনর্গল ম্যান্ডারিনে কথা বলতে পারছি। একটা বাংলা শব্দও আর বলার কোন সুযোগ নেই আমার।


এদের সংগে যেন পুরোপুরিই মানিয়ে নিয়েছিলাম কিন্তু শুধুমাত্র শারীরিক গঠন ও চেহারার ভিন্নতাই আমাকে যেন মনে করিয়ে দেয়, ‘তুমি কিন্তু এই দুনিয়ার কেউ নও’। আর তখনই নিজেকে সামলে চলি। অথচ, এখন আর মনেই হয় না আমি যে এক বঙ্গ-সন্তান।
তাছাড়া মনে হবেই বা কিভাবে।টাং সম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট লি শিমিন আমাকে অসম্ভব পছন্দ করেন। তার রাজদরবারে আমাকে এতটা সম্মানের সংগে বসতে দেন- আমি মাঝে মধ্যেই বিব্রত বোধ করি। সম্রাট শিমিন সেটা বোঝেন। কয়েকবার আমার পিঠ চাপড়ে আস্বস্তও করেছেন। যদিও তিনি সম্রাট টাইজং নামেই পরিচিত কিন্তু আমরা খুব কাছের মানুষরাই শুধুমাত্র তার প্রকৃত নাম লি শিমিন হিসাবেই জানি। লি শিমিন ক্ষমতাসীন হয়েছে এই তো মাত্র বছর খানেক হতে চলল। সম্রাট লি ইউয়ান মারা যাবার পরপরই সম্প্রাট লি শিমিন ক্ষমতায় বসলেন। তার অভিষেক আয়োজনে আমিও থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম; চীনাদের সাংস্কৃতি আমাকে আরও বেশী মুগ্ধ করেছে তখন।


নবগঠিত টাং সাম্রাজ্য বিশাল ভৌগলিক এলাকা নিয়ে সমৃদ্ধ। পশ্চিমের সামারখান্দ আর পুবের কোরিয়া, উত্তরের মঙ্গোলিয়া পেরিয়ে সাইবেরিয়া পর্যন্ত আর দক্ষিনের সাইগনও টাং সাম্রাজ্যের পদতলে। এ এক বিশাল সাম্রাজ্য। সম্রাট লি শিমিন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন আরও পশ্চিমে রাজ্য বিস্তারের জন্য।


আমি একজন পর্যটক হিসাবে ঘোড়ায় চেপে অনেক দেশ, অনেক রাজ্য ঘুড়ে প্রথম যখন ইউনান চলে আসি তখনও বুঝতেই পারিনি এ কি এক বিশাল সাম্রাজ্য। ইউনানেও বেশ ভালোই লাগছিল কিন্তু আমি তো পর্যটক; এক জায়গায় আমার মন পরে থাকবে কেন?
তাই তো উত্তরে অগ্রসর হওয়া শুরু করলাম।চেংদু হয়ে চলে আসলাম চ্যাংগঅন নগরে। আগেই জানতে পেরেছিলাম নগর দেখতে হলে আমাকে চ্যাংগঅন যেতে হবে। বংগ-সন্তান আমি, গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে আমার বসবাস। সেখানে নগর বলতে তেমন কিছু তৈরী হয়ে উঠেনি কয়েকটা বিক্ষিপ্ত আঞ্চলিক রাজবাড়ী ব্যতিত। নালান্দা আমার দেখা সবচে বড় নগর কিন্তু সেটাও চ্যাংগঅন নগরের কাছে অজোপাড়াগা যেন। নালান্দার সংগে আমার অনেক অনেক বছরের স্মৃতি বিজড়িত। পন্ডিত জহোবাড়োর কাছে আমি অংক, ভুগোল শিখেছি; জোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পন্ডিতঝির অগাধ জ্ঞান। তার সাহচর্যে ছিলাম বছর দশেক। কত স্মৃতি আমার নালান্দায়।


চ্যাংগঅন আসি তখন সম্রাট লি ইউয়ান ক্ষমতাসীন। ম্যান্ডারিন ভাষাটা তখন মোটামুটি বলতে পারি। সম্রাট তার পরিষদের সদস্যদের কাছেই জানতে পেরেছিলেন যে এক ভিনদেশী পর্যটক বেশ কয়েক মাস টাং সাম্রাজ্যের প্রধান শহর চ্যাংগঅন এ বসবাস করছেন, ভালো ম্যান্ডারিনও জানেন। তা শুনেই তিনি আমাকে তার সভায় ডেকে পাঠান।
আমার সংগে কথা বলে তিনি আমাকে কুনফুসিয়াস প্রতিষ্ঠিত একটি পাঠশালায় ভুগোল বিষয়ে পাঠদানের জন্য নিয়োগ দেন আর আমিও এই নগরীতেই পরম আনন্দে আমার উপর দায়িত্ব পালন করতে থাকি।


সম্রাট লি শিমিন গত মাসে ওয়ানলি-চ্যাঞ্জচেং (লম্বা প্রাচীর) এর কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। সেই প্রতিনিধি দলে আমার আমন্ত্রন ছিল, আমি গেলাম রাজকীয় দলটির একজন হয়ে। ওয়ানলি-চ্যাঞ্জচেং এর নির্মাণ কাজ কয়েকশ বছর যাবৎ আর কোন সম্প্রসারণ করা হয়নি। কিন্তু সম্রাট লি শিমিন এই লম্বা প্রাচীরটির আরও উত্তর ও উত্তর পূবে সম্প্রসারণ কাজ নির্মান করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করেন।
টাং সাম্রাজ্যের উত্তরে দস্যূদের দমাতে এতো বড় বিশাল এক দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল আরও ৮০০ বছর আগে। তখন সবে মাত্র কিন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছে। প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং (জেং) ক্ষমতা গ্রহন করলেন। সম্রাট জেং খুবই তেজস্যী পুরুষ ছিলেন। মংগোলিয়ান দস্যুরা তখন হিংস্র আর ধুর্তসহ ঘোড়ায় করে হোয়াং হো নদীর পারে এসে আক্রমণ করে লুট-পাট চালাতো দেদারছে। অনেক মানুষ হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করতো না।


জনদরদী সম্রাট জেং সিদ্ধান্ত নিলেন ‘ওয়ানলি-চ্যাঞ্জচেং’ নির্মাণের। দশ হাজার মাইল (এদেশে ক্রোশকে মাইল বলে) দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণ কাজ শুরু করলেন তিনি। এ-এক সুদূরপ্রসারী, ব্যবহুল এবং দূরদর্শী নির্মান। মানব সভ্যতা এই নির্মাণকে হাজার হাজার বছর স্মরণ রাখবে বলেই আমার মনে হয়েছিল। নিজের চোখে এমন এক নির্মাণ কাজ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছিলাম।


মনে হচ্ছিল একজন সামান্য পর্যটক হিসাবে এই সুদূর চীনদেশে আসাটা আমার যেন সার্থক হলো, নিজের যাপিত জীবনটা নিয়ে ভীষন গর্ব অনুভব করলাম যেন।
আমার বসবাসের জন্য সম্রাটের দেয়া বাড়ীটাও বেশ সুন্দর। একা থাকি। হোয়াং হো নদীর তীর ঘেষে আমার বাড়ীটি। জানালা খুললেই নদীর স্রোত চোখে লাগে। আমার বাড়ীটা একটু পাহাড়ী এলাকায়। নির্জন পরিবেশ। নিজেই রান্না করি, ঘর পরিস্কার করি। তেমন একটা কাজ তো নেই, সারাদিন নগরময় ঘুড়ে বেড়াই।


আমার থাকার বাড়ীর কাছেই আরও একটা বাড়ী। এই বাড়ীটি আমার বাড়ীটার চেয়েও সন্দর। টাং সম্রাজ্যের নদী রক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী শি জিয়নহাও স্বপরিবারে ওই বাড়ীতে থাকেন। আমার সংগে তার পরিবারটি দারুন সখ্যতা। তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই আমাকে আমন্ত্রণ করে। জিয়নহাও এর ছোট মেয়েটির বয়স ১৬ কি সতের হবে। খুবই ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি, নাম কেলি-সুংওয়ান। আমি ওকে সুওয়ান বলে ডাকি, অন্য কেউই তাকে এই নামে ডাকে না। কেলি সুওয়ান আমার এই ডাকে খুব খুশী হয়। সম্রাট আমাকে একটি পিরজীওয়ালিসকি (মংগোলিয়ান) ঘোড়া উপহার দিয়েছেন। আমার ঘোড়াটির নাম শিফুয়ান। আমি শিফুয়ান বলে ডাকলেই ও দৌড়ে আমার কাছে চলে আসতে চায়।
কেলি-সুংওয়ান প্রায়ই বিকেলে বায়না ধরে আমার সংগে হোয়াং হো নদীর তীর ধরে বেড়াতে যাবার। আমার অর্ধেক বয়সী একটা মেয়ে সুংওয়ান। আমি মাঝে মধ্যেই মেয়েটিকে বুঝতে পারি না। আমি ওকে আমার সংগে একই ঘোড়ায় চড়িয়ে নদীর তীর ধরে বেড়াতে নিয়ে যাই। ভালো পরিবেশ দেখে আমরা গল্প করি।


কেলি-সুংওয়ান আমার কাছে প্রায়ই আমার দেশের গল্প শুনতে চায়। আজ প্রশ্ন করলো, ‘তোমার দেশটা দেখতে কেমন? সেখানকার সব মানুষই কি দেখতে তোমার মতো? তাদের সকলেরই কি তোমার মতো উঁচু নাক? সুন্দর চোখ?’আমি হাসি ওর প্রশ্নে। বলি, ‘হ্যা, আমার দেশের বেশীরভাগ মানুষদেরই নাক, মুখ, চোখ আমার মতোই’। সুংওয়ান অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘তাহলে তোমার একজন অন্যজনকে চিনো কিভাবে?’আমি হেসে ফেলি। বলি, ‘তোমাদের দেশেরও তো সব মানুষেরই নাক দাবানো, ছোখ ছোট ছোট, সকলেই ফর্সা খুব। তোমাদের আলাদা করে সকলকে চিনতে কি তোমার বা আমার কোন কষ্ট হয়?’সুংওয়ান ওর বুল বুঝতে পেরে হেসে দিলো, ওর হাসিটাও বেশ সুন্দর, ডানপাশের গালে টোল পরে। আমি ওর টোল দেখে মুগ্ধ হই। খুনসুটি করে ও আমার সংগে।
মেয়েটার প্রশ্ন যেন থামতেই চায় না। গেল বছর হোয়াং হো নদীতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল, সংগে প্রচন্ড স্রোত। সম্রাটের বাড়ীটাও পাহাড়ের উপর। কিন্তু নগরীর অনেক বাড়ী পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।


সুংওয়ান হঠাৎই জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা তোমাদের দেশেও কি এমন বন্যা হয়? তখন তোমরা কি করো?’


আমি বললাম, ‘হ্যা, হয়তো। আমাদের ওখানে একটা বড় নদী আছে ওটার নাম গঙ্গা। সেই নদী আমাদের বাড়ী-ঘড় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের সকলেরই তখন অনেক কষ্ট হয়। আমাদের বাড়ীতে জল উঠে যায়। আমরা টোপ ফেলে মাছ শিকার করি। আমাদের দেশের মাছগুলো খেতে অনেক মজা। আমরা সবজী দিয়ে মাছ রান্না করে খাই। এমনিতেও আমরা প্রায় সারা বছরই প্রচুর মাছ খাই। তোমরা তো মাছের চেয়ে বন থেকে জন্তু-জানোয়ার ধরে এনেই বেশী খাও। কিন্তু আমরা মাংস তেমন একটা খাই না। শুধুমাত্র ছাগলের মাংস খাই, মুরগী খাই খুব। হাসও খাই।’


‘তোমাদের দেশেও হাস-মুরগী পাওয়া যায়?”হ্যা। আমরাও তোমাদের মতোই বাড়ীতে হাস-মুরগী চাষাবাদ করি; যাবে আমাদের দেশে বেড়াতে?’


সুংওয়ান হঠাৎ চমকে উঠে। ‘নিয়ে যাবে আমাকে? কিন্তু আমি যে তোমাদের ভাষা জানি না। তুমি তো বলেছো তোমাদের দেশে কেউ ম্যান্ডারিনে কথা বলতে পারে না, বুঝে না; তাহলে আমি কথা বলবো কিভাবে? আমি কি তাড়াতাড়ি তোমাদের ভাষা শিখে নিতে পারবো?”হ্যা, পারবে; আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো’।


(চলবে)

   Send article as PDF