ভোটের বাংলাদেশ

৭১রের মহান মুক্তিযুদ্ধের মুল ‘চেতনা ও বিশ্বাস’ ছিল একটা ‘স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার যেখানে দেশের প্রতিটি এলাকার প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ নিয়ে, সমান অধিকার নিয়ে ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন’ভাবে এই দেশটিতে বসবাস করবে।
 
কিন্তু সেই ‘আসল ও প্রকৃত’ চেতনাটি-ই আজ বদলে ফেলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র’কে হত্যা করা হয়েছে দেশ স্বাধীন হবার প্রথম বছরে-ই!
 
স্বাধীনতা-প্রাপ্তীর দ্বিতীয় বছরেই এই দেশে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রথম নির্বাচনটি ছিল একটা একতরফা নির্বাচন- যা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ ছিল এবং প্রথম সেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন টি বাংলাদেশে ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয় লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে এগারোটি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে মোট ভোটারের ৫৪.৯% ভোট দান করে।
 
সদ্য পাওয়া একটি স্বাধীন দেশের সংগে ঐ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই হটকারী রাজনীতি শুরু হয় এবং মানুষের ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা’ প্রাপ্তির আকাংখাকে লাথি মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়।
 
যাই হোক, বিশ্বের সবচে জটিল ও কুটিল চরিত্রের অধিকারী বাংলাদেশী জাতি কোন কালেও একটা সঠিক, ত্রুটিমুক্ত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা পায়নি।
 
তবে, মোটামুটি শতভাগ নিরপেক্ষ ও বহুদলীয় নির্বাচন হিসাবে বাংলাদেশে মাত্র দু’টি নির্বাচনকে সামনে আনা সম্ভব। এর একটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান এর অধীনে- তারা তখন তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
 
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ সাহেব (এ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট) এর অধীনে নির্বাচনটি সুষ্ঠ ও ত্রুটিমুক্ত হলেও সেই নির্বাচনে সদ্যপদত্যাগী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির সংগে নিরপেক্ষ আচরণ করা হয়নি বিধায় আমি সেটাকে ‘গণতান্ত্রিক ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন’ বলতে পারছি না।
 
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন ছিল দেশের ইতিহাসের সবচে ঘৃর্নিত ও কলংকিত দু’টি নির্বাচন- যা কোন পাল্লাতেই মাপা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই ২০১৮ তে এসে ৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচনটি হয়ে গেলে বাংলাদেশ নামের এই দেশটিতে- এরপর আর এই দেশে কোনভাবেই, কোন অবস্থাতেই, কোন সভ্য, সুন্দর নির্বাচন আশা করাই মানুষ ছেড়ে দিবে বলে মনে করা যেতেই পারে।
 
শেখ হাসিনা যেভাবে তার রাষ্ট্রিয় পেশীশক্তি দেশবাসীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে- আর্মি, পুলিশ আর নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসন ও দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীকে একত্রিত করে যে উদাহরণটি সৃষ্টি করলেন এই বাংলাদেশে- পরবর্তীতে তা শুধুমাত্র অনুকরণ করেই যে-কোন অশুভ শক্তি চির জীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবে।
 
বুদ্ধির অভাবেই একটা সম্পূর্ণ জাতি জটিল ও কুটিল হয়ে উঠে আর পেশীশক্তি-ই হয়ে উঠে তার একমাত্র অবলম্বন। যাদের পেশীশক্তি নেই, যারা দুর্বল তারা তখন শুধুই দর্শক!
 
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল শুধুমাত্র এই কমবুদ্ধির জাতির বুদ্ধিহীনতায় দুই অযোগ্য মহিলার হাতে অযাচিতভাবে সমস্ত ক্ষমতা অর্পনের মধ্য দিয়েই তিলে তিলে মেরে ফেলা হয়েছে সেই কাংখিত গণতন্ত্রকে, অপাওয়া স্বাধীনতাকে!
 
বাংলাদেশের চরিত্রটাই হয়ে গেছে এখন ‘যেন তেন ভাবে ক্ষমতায় যাওটাই নাকি গণতন্ত্র’, যেন তেন ভাবে ‘কৌশল’ ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়াই নাকি গণতন্ত্র! আর দেশের এই অসুস্থ লোকজনও ঐসব কথিত নোংরামীপূর্ণ ‘কৌশল’কেই ‘গণতন্ত্র’ ভেবে বসে রয়েছে!
 
এই জাতি আর কবে সভ্য হবে, সুন্দর হবে?
 
যাই হোক, আগামীতে যে দল বা ব্যক্তিই ক্ষমতায় আসবে সেই দল বা ব্যক্তিই ঠিক করবে ‘গণতন্ত্র’ আর তার ব্যক্তিগত ‘কৌশল’কে এবং দেশবাসীও তাদের কাছে শিখবে ‘কৌশলী গণতন্ত্র’- এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।
 
চলতে পারে না।
একটা স্থায়ী সমাধান দরকার।
 
প্রথমে ‘গণতন্ত্র’কে স্থায়ী বন্দোবস্ত’র আওতায় আনতে পারলে- এর পরের ধাপে মানুষের স্বাধীনতাও স্থায়ীকরণ করা সম্ভবপর হবে।
 
বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যেহেতু আর বিশ্বাস করার কোন জো নেই- এই দেশের বিচারপতি থেকে শুরু করে একজন সাধারণ সিকিউরিটি গার্ডকেও যেহেতু আর বিশ্বাস করা সম্ভব নয় সেহেতু এমন একটা নির্বাচন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যা হবে অন্য যে-কোন দেশের জন্যই হবে আদর্শনীয় ও সম্পূর্ণ সুষ্ঠ তথা শতভাগ নিরপেক্ষ।
 
প্রথমত একটা শতভাগ নির্ভূল ভোটার তালিকা তৈরী করা বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ডাল-ভাতের মতোই সহজ একটা বিষয়। দেশের প্রতিটি সিটি ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাধ্যমে স্থায়ী কার্যালয়ে প্রতিটি মানুষের (অবশ্যই ইংরেজীতে) নাম, জন্ম তারিখ, পিতা-মাতা’র নাম, ঠিকানা এবং বায়োমেট্রিক ফিংগার স্কানিং ও ডিজিটাল ছবি নিয়ে বাধ্যতামূলক রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যূসহ প্রতিটি মানুষ মারা যাবার পর এই একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার ডেথ সার্টিফিকেটও ইস্যূ করা হবে। এবং এই স্থায়ী ডাটাবেজ চলমান থাকবে প্রতিটি শিশুর জন্ম হওয়ার পর এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রতি ১০ বছরে একবার বাধ্যতামূলকভাবে বায়োমেট্রিক ফিংগার স্কানিং ও ডিজিটল ছবি আপডেট করা হবে।
 
দেশের প্রতিটি থানা ও আদালত এই ডাটাবেজ ব্যবহার করবে তার আসামীর ইনফরমেশন পেতে এবং সঠিক ইনভেষ্টিগেশন করতে এবং সঠিক ব্যক্তির পরিচয় নির্ণয় করতে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই ডাটাবেজ ব্যবহার করেই টিআইএন নাম্বার ইস্যু ও ট্যাক্স রিটার্ণ এর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ব্যাংকগুলিও অনলাইনে ভেরিফিকেশন করবে তাদের গ্রাহকের আইডেনটিটি। মোটর ড্রাইভিং অথরিটি ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং নন-ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে এই একই আইডেনটিটি অনুসরণ করবে- দেশে জাতীয় পরিচয় পত্র বলে কোন কিছু প্রয়োজন থাকবে না। প্রতিটি স্কুল কলেজ ভার্সিটি মেডিকেল তথা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এই একই ডাটাবেজ ব্যবহার করবে।
 
এই একই ডাটাবেজ ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি মানুষের ‘ক্রেডিট রেটিং’ও তৈরী করা হবে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। এবং এই ক্রেডিট রেটিং ধরেই প্রতিটি মানুষের ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনা করা যাবে সহজেই, ব্যাংকগুলি তাদের ভালো গ্রাহক খুঁজে পাবে।
 
এবং প্রতিটি মানুষের এক্সেস থাকবে তার নিজস্ব ডাটাবেজ দেখার। একজন মানুষ যেদিন ১৮তে পা দিবে- তার পরদিন থেকে যে-কোন সময় সে একটি সহজ অনলাইন রেজিষ্ট্রেশন এর মাধ্যমে দেশের যে-কোন এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে ঐ ভোটার তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করতে পারবে- একজন্য সরকারী কাউন্সিলের স্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিও যে-কাউকে সহযোগীতা করবে।
 
ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার অন্তর্ভূক্ত চিরজীবনের মতো অসম্ভব হয়ে পরবে। শুধুমাত্র ১৮+ নাগরিকরাই ভোটার হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হবে এবং যে-কেউ যে-কোন সময় অনলাইন সাইটে গিয়ে ভোটার সংখ্যা দেখতে পাবে।
 
এবার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করার কোন সুযোগ দেখা যায় না।
 
সুতরাং জাতিসংঘের নেতৃত্বে অথবা আমেরিকান কোন প্রতিষ্ঠিত বা শতভাগ বিশ্বস্ত সফটওয়্যার নির্মাতা ও পরিচলনার দক্ষতাপূর্ণ বিশ্বব্যাপী পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে একটি পোর্টল ও এ্যাপস তৈরীর দায়িত্ব দিয়ে ভোটিং সিষ্টেম ডেভেলপ করতে হবে। গুগল, ইয়াহু, আইসিএএনএন এমনকি পে-পল, আমাজন, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানকেও নির্দিধায় বিশ্বাস করা যায় একটা দেশের নির্বাচন পরিচালনায় ও নির্বাচনী পোর্টাল তৈরীতে।
 
‘আইসিএএনএন’ এর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে কিছু কথা বলছি- এটা আমেরিকান কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়; সিম্পল একটি প্রাইভেট অর্গানাইজেশন। এই যে আজ সারা পৃথিবীর কোটি কোটি ইন্টারনেটের ‘ডোমেইন নেইম’ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে- সেটার নিয়ন্ত্রক এই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটি। পুরো ইন্টারনেট বিশ্ব এই প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দিধায় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে চলছে এবং এরাও সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশের রাষ্ট্রিয় ডোমেইন নেইম (.gov) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রাইভেট অর্গানাইজেশনটি।
 
ফেসবুকে আমরা অহরহ ভোটিং ব্যবস্থা দেখি, অনলাইন পত্রিকগুলিও জনমত যাচাই করে- ঠিক এভাবেই একটা অনলাইন ভোটিং সিষ্টেম ডেভেলপ করা সম্ভব অতি সহজেই এবং এটার কোন নিয়ন্ত্রণই বাংলাদেশের কোন অথরিটিকে দেয়া হবে না। তারা শুধুমাত্র ভোটিং ক্যান্ডিডেট ও মার্কা আপেলোড করতে পারবে। নির্ধারিত সময়ে ভোটিং সিষ্টেম অন হবে এবং সময় শেষে অফ হবে। এই সময়ে যে-কোন ভোটার তার ভোটার নাম্বার ও বায়োমেট্রিক ফিংগার স্কানিং করে নির্ধারিত ভোটটি দিতে পারবে। এবং সংগে সংগে সে তখন পর্যন্ত ভোটিং রেজাল্ট দেখতেও পারবে। কত পার্সেন্ট ভোট কাষ্ট হলো, কে কত ভোট পেয়েছে ইত্যাদি ডিটেইল। ৩০০ আসনের সব ফলাফলও দেখা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ অথরিটি কিছুই নিয়ন্ত্রন করতে পাবে না। ফলাফলও ঘোষনা হবে অনলাইনেই এবং ইন্সট্যান্ট।
 
আর দেশের যে-কোন ব্যক্তি একটি ‘ইউএসবি ফিংগার স্কানিং মেশিন’ তার স্মার্ট ফোন বা কমপিউটারের সংগে যুক্ত করেও যে-কোন স্থানে থেকেই তার ভোট প্রয়োগ করতে পারবে। ভোটার কেন্দ্রগুলিতে কোন পোলিং এজেন্ট থাকবে না। নিজস্ব ফিংগার স্কানিং মেশিন নেই এমন ভোটাররা অটোমেটিক গেটে স্থাপিত ফিংগার স্কানিং মেশিনে নিজ পরিচয় ও ফিংগার স্কানিং প্রয়োগ করলেই ভোট কেন্দ্রের এন্ট্রিগেট অটোমেটিক্যালী খুলে যাবে এবং কমপিউটারে প্রার্থী ও মার্কা দেখে সে শুধুমাত্র ভোটটি দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কেউ তাকে বাইরে বা ভেতরে প্রেশার করতে পারবে না। মধ্য রাতে জাল ভোট প্রদানেরও কোন সুযোগ থাকবে না।
 
আর এই সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে প্রযুক্তিযুক্ত নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ। তবে, নির্বাচন কমিশনকে আরও একটা বিষয় নিয়ন্ত্রন করতে হবে- সেটা হলো, দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন পাবে শুধুমাত্র তৃণমুল কর্মীদের নিজস্ব ভোটিং এ, লন্ডন বা ভার্জিনিয়া থেকে তারেক সাহেব বা জয় বাবু কাউকে মনোনয়ন প্রদান করতে পারবেন না।
 
এছাড়া বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন উপায় কার্যকর হবে না, কোন ভাবেই না।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের একটা চেতনা গণতন্ত্র বাস্তবায়ন সম্ভব, এরপর হাত দেয়া যাবে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায়।
   Send article as PDF