‘ইশকুল’

রাশান কোন এক বিখ্যাত লেখকের লেখা একটি উপন্যাস পড়েছিলাম খুব ছোট বেলায়- ‘ইশকুল’। বাংলায় তরজমা করা পুরো উপন্যাসেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আমেজ ছিল। আমি যেহেতু বরাবরই বৈচিত্র প্রেমী সেহেতু ঐ ‘ইশকুল’ উপন্যাসটি আমাকে অনেক কিছু জানার সুবিধাও করে দিয়েছিল। বিশেষতঃ রাশান কিশোরদের জীবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি।
ঐ উপন্যাসের কোন অধ্যায়ে মজার একটি ট্রপিক ছিল।
সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার চলছে। অনেক অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক কিশোরও যুদ্ধে যাবার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত। তো, ওই ইশকুলের ৮ম বা ৯ম গ্রেডের এক কিশোর স্কুল ছেড়ে পালালো যুদ্ধে যাবার জন্য। ঘটনাটি পুরো স্কুলে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। স্কুল কতৃপক্ষ আরও বেশী সতর্ক হলো এবং নিজস্ব গোয়েন্দাসহ প্রহরীর সংখ্যা বাড়ালো যেন আর কেউ ঐ স্কুল থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যেতে না পারে।
যাই হোক, দিন পনের পর সেই পালোনা ছাত্রটি স্কুলে ফিরে আসলো। স্কুলে একটা সস্তি ফিরে আসলো।
ঐদিনই ভূগোল এর ক্লাস চলছে। ঐ ছাত্রটিও উপস্থিত।
ভূগোল এর টিচার ছাত্রটিকে বেঞ্চে দাঁড়াতে বললেন। ছেলেটি বেঞ্চে উপর দাঁড়ালো। মাষ্টার মশাই প্রশ্ন করলেন ‘তুমি স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেলে কিন্তু ফিরে আসলে কেন?’
ছাত্রটি মুখ কুচকিয়ে উত্তর দিল, ‘স্যার, আমি প্রায় ৭ দিন হেটেও মস্কো যাবার কোন রাস্তা না পেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
স্যার বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কোন দিন হেটেছো- মস্কো যাবার জন্য; যেতে পারলে না তোমাকে ফিরে আসতে হলো?’
ছাত্রটি বলল, ‘স্যার আমি তো পূব দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম।’
মাষ্টারমশাই এবার ক্ষেপে গেলেন, ‘এখান থেকে মস্কো কি পূব দিকে? তোমাকে আমি কি শিখেয়েছি? তুমি পূর্ব-পশ্চিম কোন দিকে সেটাও তো দেখি জানো না। মস্কো এখান থেকে সোজা উত্তর দিকে, আর তুমি রওয়ানা দিলে পূব দিকে? আশ্চর্য্য, তুমি তো পুরো স্কুলের কাছে আমার মাথা ছোট করে দিলে? আমি আমার ছাত্রদের কি শিক্ষা দিচ্ছি? তোমার জন্য আমি এতো ছোট হয়ে গেলাম! তুমি আজ পুরো ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা তোমার শাস্তি।’
গল্পটি যখন পড়ি তখন আমি সম্ভবত ক্লাস নাইনের ষ্টুডেন্ট। ভূগোলের প্রতি আমার দূর্বলতা তারো আগে থেকেই। কিন্তু ঐ কাহিনীটি পড়ার পর আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। বাড়তে বাড়তে একটা সময় এমন হলো সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই আমার মুখস্ত হয়ে গেল। আমার ছোট পড়ার টেবিলে একটা প্লাষ্টিকের ওয়ার্ল্ড ম্যাপ বিছিয়ে রাখতাম। কাউকে দিয়ে আমার নিজের চোখ বেঁধে- বিশ্বের যে-কোন দেশের একটি শহরের নাম বলতে বলতাম এবং চোখ বাঁধা অবস্থাতেই আমি যে-কোন শহর এর নাম আমার ডান হাতের শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারতাম। সারাবিশ্বের কমবেশী দুই হাজারের উপর শহর, প্রতিটি দেশ, রাজধানী এমনকি একশত’র উপরের দেশের সরকার বা রাষ্ট্র-প্রধানদের নামও আমার মূখস্ত ছিল।
সত্যিই ভীষন আনন্দ পেতাম আমি। এটা তখন আমার কাছে একটা খেলায় পরিণত হয়েছিল। এবং ঐ সময়ই আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌছি ও লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করি যে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবগুলি দেশ আমি ভ্রমণ করবো।
জানি না পারবো কি না! আর তো মাত্র ১৪ বছর বাকী রয়েছে। দেখা যাক।
যাক এতক্ষণ ভূমিকা দিলাম। এবার আসল কথায় ফিরি।
আমি প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় অনলাইনে মানবজমিন পত্রিকাটি পড়ি। মাঝে মধ্যে প্রথম আলোও পড়ি। খুব বেশী জরুরী না হলে অন্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঘাটি না। দেশের টাটকা সংবাদ কার না ভাল লাগে?
আজও অফিস থেকে বাসায় ফিরেই মানবজমিন এ ঢুকলাম। হেডলাইন নিউজ এর উপর চোখ আটকে গেল।
“ঢাকা-যশোর-সিলেটে ১০ সিন্ডিকেট
মানবপাচারে নতুন রুট জর্জিয়া”
প্রথম প্যারাটি নিম্নরূপ: “মানবপাচারের নতুন রুট বানিয়েছে শক্তিশালী দালালচক্র। নতুন রুটের জন্য তারা বেছে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ‘জর্জিয়া’কে। দালালচক্রটি বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ই-ভিসার (ইলেকট্রনিক্স ভিসা) সুবিধায় ইউরোপে যেতে আগ্রহীদের প্রথমে জর্জিয়া পাঠায়।”
আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা! বলে কি? কি নিউজ এটা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙগরাজ্য হয়ে ইওরোপে যাবে? আমি তো পুরাই ‘সাকা চৌধুরী’র মাননীয় স্পীকার’ হয়ে গেলাম!
আবার চিন্তা করলাম, আমার তো এখন বয়স বাড়ছে- হয়তো নিউজটিই ঠিক আছে আমিই ভুলে গেছি ভুগোলটা! কিন্তু না। আমি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, আমার ভূল হতেই পারে না।
– না, আমার ভূল হয়নি। এতো সামান্য একটা ভূল আমার করার কথা না।
ঐ আন্তর্জাতিক সাংবাদিক বিশ্ব মানচিত্র সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না। দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিগ্রি দিয়েছে আমি জানি না; জানার আগ্রহও নেই- কারণ বাংলাদেশটাই এখন এভাবেই চলছে। মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী’র মনে হয় সময় নেই ঐ সাংবাদিককে কষে এটা চড় মারার! কারণ এটা বাংলাদেশ! তাও আবার ডিজিটাল বাংলাদেশ। যে যেভাবে পারে কথা বলে যাবে- এটাই এখানে স্বাভাবিক এবং দেশবাসী ওসবই শিখবে এবং একদিন পন্ডিত হবে। টিভি’র টক-শো ফাটাবেন। কেউ আবার বেশী তৈল মর্দন করে টিভির মালিকও হবেন।
‘জর্জিয়া’ হলো পূর্ব ইওরোপের একটি ছোট দেশ, সম্ভবত তুরষ্কের সাথে বর্ডার রয়েছে; রাজধানী তিবিলিস বা তিবিলিসি কিছু একটা; পুরোপুরি মনে নেই- ওই যে বল্লাম বয়স হয়েছে!
অপর দিকে ইওরোপ থেকে বিশাল আটলানটিক মহাসাগর পাড়ি (বিমানেও ৮ ঘন্টা লাগে) দিয়ে আমেরিকার একটি ষ্টেট এর নামও ‘ জর্জিয়া’ যার রাজধানী আটলান্টায় রয়েছে বিশ্বের সবচ বৃহত্তম ও ব্যস্ততম এয়ারপোর্টটি। এই সামান্য তথ্যটি যে ছেলে জানে না- সে একজন আন্তর্জাতিক সংবাদ কর্মী।
এটাই প্রথম নয়, আমি বাংলাদেশের প্রায় সবগুলি টিভি বা পেপারেই প্রায়ই এরকম অসংখ্য ভূল-ভাল তথ্য দেখি।
কিছু বলি না- কি বলবো? কার কাছে বলবো? ওদেশে তো সবাই পন্ডিত! পন্ডিতদের জ্ঞান দিতে নেই!
সেই ভূল নিউটি শেয়ার করে দিলাম।
   Send article as PDF