‘ইনহিউম্যান টর্চার’

বলছিলাম ‘ইনহিউম্যান টর্চার’ নিয়ে।
 
আদতে জেনোসাইড আর ইনহিউম্যান টর্চার সাম্পর্কিক হলেও অভিন্ন বিষয় নয়।
 
‘মানুষ’ তো অনেকভাবেই হত্যা করা যায়- গুলি করে, পয়জন ইনজেকশন দিয়ে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। এছাড়া গাড়ী চাপা দিয়ে, ইটভাটায় পুড়িয়ে, শরীরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, চাকু দিয়ে চামড়া কেটে ভেতরে লবন দিয়েও হত্যা করা যায়।
 
আমরা আজ ‘মানুষ’ মারার আরও কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
 
তার আগে চলুন আমরা ইতিহাস থেকে আরও কিছু হত্যাকান্ড সম্পর্কে জেনে আসি। দেখিই না কে কত বেশী সংখ্যক মানুষ হত্যা করতে পেরেছে।
 
এই পৃথিবীতে সবচে বেশী মানুষ হত্যাকারীর ‘সম্মান’টি দেয়া হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চায়নার চেয়ারম্যান মাও সে তুং কে। তিনি নাকি মাত্র ৩৪ মিলিয়ন (কারো কারো মতে ৭৮ মিলিয়ন) মানুষ হত্যার সাফল্য দেখিয়েছিলেন।
 
জোসেফ স্ট্যালিন এর হাতে পটল তুলেছিল মাত্র ২৩ মিলিয়ন (ম্যাক্সিমাম ৬০ মিলিয়ন) মানুষ।
 
জার্মানীর এডলফ হিটলার মেরেছিলেন মাত্র ৬ মিলিয়ন ইহুদীকে।
 
জাপানের হিদাকী টোজোও কম যাননি- ৫ মিলিয়ন! আর পল পট তো মেরেছেন মাত্র আড়াই মিলিয়ন মানুষ। এই পঞ্চপান্ডবই সেরা।
 
এতোক্ষনে বুঝতেই পারছেন যে আসলে ‘মানুষ’ মারা কোন বিষয়ই না। এই যে আমাদের দেশের শেখ হাসিনা, যিনি আবার নোবেল পুরুস্কারেরও দাবীদার- তিনিও তো শতশত মানুষকে গত ৮ বছরে বিভিন্ন স্ট্যাইলে হত্যা করিয়েছেন। যেমন সিনহা বাবুর আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্রিয় হত্যাকান্ড চালিয়ে, শহীদুল-মনিরুল-বেনজির’দের দেয় ক্রস ফায়ারে দিয়ে; তারপর ডিজিএফআই দিয়ে ‘গুম’ করিয়ে- ইত্যাদি নানা উপায়ে।
 
শুধু কি তাই? কতকত হাজার হাজার শিবিরকর্মীকে চিরতরে পুংগ করে দেয়া হয়েছে- তার তো কোন হিসাবই নেই। বাংলাদেশের পুলিশ চাইলেই যে কাউকে কোপাতে পারে, চোখ তুলে নিতে পারে, যা খুশী তাই করে ফেলতে পারে- এসব তো আপনার-আমার চোখের সামনেই হচ্ছে প্রতিদিন।
 
‘মানুষ’ মারা, ‘মানুষ’ মেরে ফেলা নিতান্তই ডাল-ভাত।
 
তাছাড়া দেখলেন না, দেশের সোনার ছেলেরা ‘বিশ্বজিৎ’কে কি সুন্দরভাবে, শৈল্পিকভাবে, দক্ষতার সংগে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলল- কিছু হইছে এতে?
 
তারপর ধর্ষন করেও মেরে ফেলা যায়। মেয়েদের হত্যা করার জন্য এটা বেশ আইডিয়া- এক ঢিলে দুই পাখি।
 
তারপর ধরুন বাংলাদেশের ‘অকৃত্রিম’ বন্ধুরাষ্ট্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচে কাছের সহায়তাকারী, যারা না থাকলে বাংলাদেশই হতো না (দুর ছাই শেখ মুজিব না জন্মালেও তো বাংলাদেশ হতো না! – কি যন্ত্রণা কোনটাকে ফাষ্ট প্রেইরটি দিবো?) সেই মহান রাষ্ট্র ভারত বর্ষ তাদের বাংলাদেশ সীমান্তে নিরস্ত্র ‘বাংলাদেশী’দের কি নিদারুন নিশানায় পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলে! দেখতেও তো কত্তো ভাল লাগে- কি বলেন?
 
যাই হোক, মানুষ মারারও যে একটা ‘আর্ট’ আছে- সেটাও কিন্তু অনেকেই চর্চা চালিয়েছেন।
 
আমি নিজে একবার গিয়েছিলাম নাটোরের রানীভবন এ। সেই রাজবাড়ীর ভেতরেও (যদ্দুর মনে পড়ে পেছনদিকটায় পরিত্যাক্ত ভবনে) আমি মানুষ মারার একটা আয়োজনও দেখেছিলাম।
 
যাই হোক মানুষ মারতে কেউ পিছিয়ে নেই।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে আপনি দৈনিক অনেক মানুষ ‘তৈরী’ করতে পারেন সো- সেখান থেকে কিছু মানুষ মেরে ফেললে কিছুই যায় আসে না।
 
একজন ‘মানুষ’ কি শুধুই একজন ‘মানুষ’?
 
নিউটনকে যদি মেরে ফেলা হতো?
আইনস্টাইনকে যদি মেরে ফেলা হতো?
বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ- এদের যদি মেরে ফেলা হতো??
হযরত ওমর (রা), আবু বকর (রা), ওসমানদের (রা) মতো মানুষকে যদি মেরে ফেলা হতো?
 
কে জানে এসব হত্যাকান্ডে যে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে- সেখানেও হয়তো বো লুকায়িত ছিল কতো আইনস্টাইন, নিউটন, বিল গেটস, জাকারবার্গ।
 
যদিই থাকতো কেউ- আজকের এই পৃথিবী আরও কত বিশাল, সমৃদ্ধ, সুন্দর হতে পারতো?
 
কিভাবে সম্ভব হয় প্রতিপক্ষকে হত্যার মাধ্যমে নিজের বিজয় অর্জন?
 
তারপরও আমরা ‘মানুষ’ হত্যা করি।
রাজনীতির ইতিহাস মানেই মানুষ হত্যা।
 
আমরা কেন বুঝি না যে একজন ‘মানুষ’ মানে শুধুই একজন মানুষ নয়। একজন মানুষ মানে একটা পরিবার, একজন বাবা, একজন সন্তান, একজন স্বামী, একজন সমাজপতি, একজন শিক্ষক, একজন বিজ্ঞানী, একজন দেশনায়কও।
 
তারপরও রাজনীতি থাকবে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকবে এই বিশ্বে। এবং মানুষ হত্যাকান্ড হবে নির্বিচারে। আর আমাদের চোখ বন্ধ করে তা সহ্য করে যেতে হবে, দেখতে হবে অসহায়ভাবে।
 
হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে সোচ্চার হতে হবে- সেটা যে-কোন হত্যাকান্ড। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে- এটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। অন্তত হত্যার আগে সে আর মানুষ থাকে না- স্রেফ পশু হয়ে যায়।
 
যাই হোক, আমি মুলত আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম ইনহিউম্যান টর্চার নিয়ে।
 
আমি সাহসী মানুষ। অনেকগুলি যুদ্ধবাজ মুভি দেখেছি, ইনহিউম্যান টর্চারের মাধ্যমে অমানবিক হত্যাকান্ডদৃশ্যও দেখেছি- খুবই কষ্টকর সেসব দৃশ্য।
 
সবার পক্ষে তা হজম করা সম্ভবপর নয়।
 
এই ‘ইনহিউম্যান টর্চার’ এ মধ্যযুগে, বিশেষ করে ইওরোপের অনেক এলাকাতেই নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে নারকীয় উল্লাসে মানুষ হত্যা করা হতো।
 
এক কথায় নারকীয় সেসব হত্যাকান্ডগুলো ঘটানো হতো বিশাল ও রাজসিক আয়োজনে। নিরস্ত্র পরাজিতদের উপর সেসব অমানবীয় হত্যাকান্ড চালানো হতো।
 
ইসলাম ধর্মে যুদ্ধবন্দিদের উপর কোনরকম নির্যাতন হারাম এমনকি অমানবিকভাবে কাউকে হত্যা করাও ইসলাম সমর্থন করে না।
 
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ী কাদেরিয়া বাহিনী’র প্রধান টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী ‘বীর উত্তম’ তার ‘ইনহিউম্যান টর্চার’ এর ‘বীরত্ব’ দেখিয়েছিলেন- ঠিক যেভাবে ধর্ষকরা ভিকটিম মেয়েদের কাছে তাদের পৌরষ্য দেখায়!
 
তিনি বেশ কয়েকজন যুদ্ধবন্দিদের ঢাকা ষ্টেডিয়ামে শতশত মানুষের সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেছিলেন- বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সম্ভবত ‘ইনহিউম্যান টর্চার’ এ ঘটা একমাত্র হত্যাকান্ড।
 
মধ্যযুগে হরেক রকমের যন্ত্রপাতি তৈরী করা হতো নির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে হত্যা করার।
 
একজন মানুষের দু’টি পা দু’টি মজবুত রশি দিয়ে বেঁধে দু’দিকে টেনে মাঝখান থেকে ছিড়ে ফেলা হতো। করাত দিয়ে একজন মানুষকে মাঝ বরাবর কেটে দু’টুকরো করে হত্যা করা হতো। শুলে চড়িয়ে হত্যা করা পুরাতন স্টাইল।
 
খুলনার এরশাদ শিকদার নানাভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে হত্যাকান্ড চালাতো। জীবিত মানুষের বুকের উপর সে নিজে লাফিয়ে লাফিয়ে তার বুকের খাঁচার হাড় ভেংগে ফেলতে তারপর নাকি আধমার মানুষটাকে বস্তায় ভরে নদীর পানিতে ফেলে দিতো।
 
যাই হোক, আমি যত রকমের নারকীয় হত্যাকান্ডের বর্ণনা শুনেছি অথবা মুভিতে দেখেছি- তার সবকিছুই হার মেনেছে গত কয়েক দিনে দেখা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর চালানো হত্যাযজ্ঞ এর কাছে।
 
আমি কোন মৃতদৃশ্যে বা হত্যাকান্ডের ভিডিওতে লাইক-কমেন্ট করি না কখনও; আমার ভালো লাগে না। অনেকেই আমাকে ইনবক্সে বেশ কয়েকটি হত্যাদৃশ্য’র ভিডিও পাঠিয়েছেন। আমি সবগুলিই দেখেছি।
 
দেখেছি কিভাবে একজন নিরস্ত্র উলংগ হাত-পা বাঁধা পুরুষকে মাটিতে ফেলে তার দু’টি পা ধারালো কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়, কিভাবে সেই অর্ধমৃত মানুষটিরে রান দু’টিও কুপিয়ে আলাদা করা হয়। কিভাবে ঠান্ডা মাথায় একজন হত্যাকারী সেই মানুষটির গলা ধারালো চাকু দিয়ে কেটে তারপর কুড়াল দিয়ে মাথাটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
 
আজকের এই আধুনিক যুগে কিভাবে একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে হত্যা করা সম্ভব?
 
একজন মানুষকে নয়। এভাবে শতশত রোহিঙ্গাকেই দিনের আলোতে ভিডিও ক্যামেরার সামনে হত্যা করা হচ্ছে।
 
আমেরিকা ইরাকের আবু গারিব কারাগারে বা কিউবায় তাদের গুয়ানতানামো বে’র কারাগারে কিছু মুসলিম বন্দীদের সংগে অমানবিক আচরণ করেছে- সারা বিশ্বব্যাপী আমার তার নিন্দা দেখেছি। তাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে পর্যন্ত সেসব ঘটনার নিন্দা জানাতে দেখেছি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসেই ঐসব নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছেন।
 
সেখানে কিন্তু কাউকে হত্যা করা হয়নি। কিন্তু রাখাইনে কি হচ্ছে? মিয়ানমারের রাখাইন বৌদ্ধরা কিসের তৈরী মানুষ? এই কি গৌতম বুদ্ধের অনুসারী?
 
আমার জানা সর্বকালের সবচে নিশৃংস হত্যাকান্ড, সবচে নারকীয় নির্যাতন চলছে মিয়ানমারেরর রোহিঙ্গাদের উপর।
 
কয়েকজন মানুষকে শত শত মানুষের চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে- বৌদ্ধদের মধ্যে ‘একজন মানুষ’ও কি ছিল না? একটা জাতি সম্পূর্ণভাবে কিভাবে নষ্ট জাতিতে পরিণত হতে পারে- কিভাবে তা সম্ভব?
 
আমি আজ গৌতম বুদ্ধের ‘প্রকৃত শিক্ষা’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। একজন ভালো মানুষের অনুসারীদের পক্ষে এতোটা নৃশংস হওয়া অসম্ভব।
 
সামান্য ‘মানবতাবোধ’ও থাকবে না- একজন মানুষের অন্তরে?
একজন ‘বৌদ্ধ’ও কি ‘মানুষ’ নয় মিয়ানমারে?
 
একজন মানুষও কি নেই মিয়ানমারে যার ভেতরে রয়েছে ‘মনুষত্ব’?
মিয়ানমারের সবই কি পশু?
 
অং সান সুকি মিয়ানমারের ‘অঘোষিত’ সরকার প্রধান- সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার নেতৃত্বেই চলছে এসব ‘অমানবিক নৃশংস হত্যাকান্ড’।
 
এই আধুনিক যুগে এসেও, বৃটেনে দীর্ঘ সময় বসবাস করেও অং সান সুকী সভ্য হতে পারলো না- এটাই মেনে নেয়া কষ্টকর।
 
মাও সেতুং, হিটলাররা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে- কিন্তু তারা এতোটা নীচে নামতে পারেননি যতটা নেমেছে আজ অং সাং সুকী নামের এই মহিলা!
 
   Send article as PDF