গ্রীনহাউজের বাংলাদেশ

সেই ১৯৮৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেবার পর থেকে পরবর্তী প্রায় ৬/৭ বছরে এমন কোন মাস ছিল না- যে মাসে আমি কম করে হলেও ২ থেকে ৩ বার ঢাকার মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে না যেতাম।
 
পরে অবশ্য ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে আর যাবার সুযোগ হতো না।
 
অনেক বন্ধুদের নিয়ে যেতাম, একাও গেছি বহুবার। অন্যরকম এক আনন্দ পেতাম তখন।
 
ঘুরে বেড়াতাম।
মিরপুরের ঐ বোটানিক্যাল গার্ডেনটির পুরোটাই আমার মুখস্থ ছিল।
 
কত কত যে স্মৃতি রয়েছে- শুধু মাত্র ওসব স্মৃতি নিয়েই একটা বই নির্ঘাৎ লিখে ফেলা সম্ভব।
 
ওহ, একটাতো লিখেছিও!
আমার লেখা প্রথম প্রকাশিত বই ‘থ্যাংক য়্যূ’ এর কথাতো ভুলেই গিয়েছিলাম!
 
সে যাক গে!
ঐ গার্ডেনটির ভেতরে একটা ছোট্ট ‘গ্রীনহাউজ’ রয়েছে।
তখনই, মানে ঐ বয়সেই ‘গ্রীনহাউজ’ সম্পর্কে সামান্য বাস্তব ধারণাও পাই।
 
এতটুকু বুঝতে পারি যে, চাইলে গ্রীনহাউজ এর মাধ্যমে আবহাওয়াকে ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে যে-কোন দেশীয় বা ঋতুর গাছ-পালা বেড়ে উঠতে পারে।
 
আপনি শীতের সময়ের সবজি গরমে কিংম্বা গরমের গাছ-পালা শীতেও করে নিতে পারবেন, খেতে পারবেন সেসব ফলও।
 
এটাই কি কম কথা?
 
অনেক হাইব্রীড গাছ-পালা-সবজীও চাষ হয়ে এই গ্রীনহাউজ প্রযুক্তিটিতে।
 
২০০৫ সালের দিকে চাইনিজ গভর্ণমেন্ট এর আমন্ত্রণে ১০ দিনের একটা সরকারী সফরে গেলাম চায়নাতে, আমরা মোট বিশ জন বাংলাদেশী ইয়ূথ অর্গানাইজার। সেটা ছিল চায়না-বাংলাদেশ এর কুটনৈতিক সম্পর্কের ৩০তম বর্ষের উদযাপন উপলক্ষে।
 
আমাদের সফরটা শুরু হয়েছিল কুনমিং থেকে।
কুনমিং হলো ইউনান প্রভিন্সের রাজধানী শহর। অসাধারণ সব ফুলে ফুলে সাজানো একটা শহর এই কুনমিং। ঢাকা থেকে মাত্র দুই ঘন্টার উড়ানেই চলে যাওয়া যায় কুনমিং।
 
কুনমিং সফরের শেষ দিনে এবং চায়না সফরের তৃতীয় দিনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটা গ্রীনহাউজ প্রজেক্ট দেখাতে।
 
কুনমিং থেকে একটু দূরে নাম ভুলে যাওয়া ঐ শহরটিতে পৌছা মাত্রই কয়েকটি পুলিশের গাড়ী আমাদের গাড়ীটাকে এসকর্ট করে সম্মান জানিয়ে নিয়ে গেল একটা স্কুল কম্পাউন্ডে। সেখানে ৩ থেকে ৪ বছর বয়সী ছোট ছোট চাইনিজ শিশুরা আমাদের প্রত্যেকের গলায় পরিয়ে দিয়েছিল বিভিন্ন পাতা ও ফুল দিয়ে তৈরী অসাধারণ সুন্দর মালা।
 
লাল জামা পরা সেই চাইনিজ শিশুগুলি এখনও আমার স্মৃতিকে সুরসুরি দেয় নিয়মিত।
 
এরপর আমাদের সেই বিখ্যাত গ্রীনহাউজ প্রজেক্টে নেয়া হয়, ঘুরে দেখানো হলো পুরো প্রজেক্টটি। বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সেই প্রজেক্টে সারাবছর জুরে শুধুই কিছু ফুল গাছ চাষ করা হতো এবং সেই ফুলগুলি নিজ দেশ চায়না সহ বিশ্বের অনেক দেশে তারা রপ্তানী করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে সম্মৃদ্ধ করে চলছে চায়নার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভান্ডার।
 
আমার দেখা ওটাই ছিল সবচে বড় গ্রীনহাউজ প্রজেক্ট।
গ্রীনহাউজ নিয়ে জানার আগ্রহ তারপরই আমার এক প্রকার শেষ হয়ে যায়।
 
আমার দেখা এবং জানার গ্রীনহাউজ মানেই ছিল হাইব্রীড প্রযুক্তিতে বেশী পরিমাণে ও কম সময়ে চাষাবাদ করা। বেশী মুনাফা আয় করা।
 
ওসব পুরোনো কথা।
এবার নতুন কথা বলি।
 
চৌদ্দ’র শেষ দিকে আমেরিকায় আসার পর নিউ ইয়র্ক শহরটি আমার ভালো লাগলো না। বিশ্বের সেরা দেশটি নিয়ে আমার চিন্তায় বোনা নিউ ইয়র্ক শহরটি প্রথম দেখেই একটা বড় হোচট খেয়েছিলাম।
 
বিশ্বের বেশ কিছু ঝকঝকে চকচকে শহর দেখে অভ্যস্ত আমার দু’টো চোখ- বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত কিন্তু চাকচিক্যহীন শহরটির দুরাবস্থা মেনে নিতে পারেনি।
 
সে সব গল্পতো আগেও বলেছি।
 
তার উপর বিগত চল্লিশ বছর ধরে দেখা আমার কোন পরিচিত গাছই এই নিউ ইয়র্কে দেখা যায় না। এখানকার কমন বৃক্ষ সেঞ্চুরী এবং আরও অতি অল্প হাতে গোনা কিছু গাছের বাইরে কোন বৈচিত্র খুঁজে পাওয়াও অসম্ভব।
 
লম্বা শীতের আগে এখানকার সবগাছেরই সকল পাতা ঝরে পরে গাছগুলি সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে যায়। অতপর যখন স্নো শুরু হয়- ঠিক যেন সাদা চাদরে ঢেকে থাকে সকল গাছ-পালা। সেটা অবশ্য আরেক পবিত্র সৌন্দর্য্য।
 
লম্বা শীতের শেষে স্প্রীং শুরু হয়ে মার্চে।
 
চার ঋতুর দেশ নিউ ইয়র্কে সম্প্রতি শুরু হওয়া স্প্রীং সিজনটি অসাধারণ রমনীয় সৌন্দের্য্যে ভরা।
 
চেরী ব্লাজম নিউ ইয়র্কসহ উত্তর গোলার্ধকে এক ভিন্ন চেহারা প্রদান করে। এ যেন ফুলেরই শহর।
 
কিন্তু, এই নয়ানাভিরাম ফুলে ফুলে সাজানো স্প্রীং নিউ ইয়র্ক- অথচ কোন ফুলেই কোন গন্ধ নেই এখানে।
 
গন্ধহীন সব ফুলে ভরা নিউ ইয়র্ক।
 
আমি ঘুরে ঘুরে নিউ ইয়র্কের সে-রূপ দেখি, মুদ্ধ হই। ছবি তুলি। চোখও জুড়ায়।
 
কিন্তু মন যে আমার ভরে না এসব দেখে।
 
আমার দেশের গন্ধরাজ, জবা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলি, হাসনাহেনা, কামিনি- কোনটার কথা বলবো? নিউ ইয়র্ক সেসব কোথায় পাব?
 
আমার দেশের আম, আমের মুকুল, কাঠাল, কাঠালের মুচি, বন্যার সময়ের শাপলা ফুল, আমার অতি প্রিয় দুটি ফুল কৃষ্ণচুড়া আর কদম! সে সব কি বিলিয়ন ডলার খরচ করেও পাওয়া সম্ভব?
সম্ভব একটি বার ছুয়ে দেখা?
স্পর্শ করার আনন্দটুকু অনুভব করা?
 
আমার দেশের গাছ পাকা পেপে, পেয়ারা, আমড়া, আখ, কাগজী লেবু, সেই শবরী কলা, হিমসাগড় আমের ভুবন মাতানো গন্ধ- যে আমের জন্য আমি ছুটে যেতাম সেই রাজশাহীতেও; সেসব আমি কোথায় পাই?
 
দিনাজপুরের সেই লিচুর জন্য কতবার যে দিনাজপুরে গিয়েছি সেই হিসাবও তো এখন শুধুই স্মৃতি।
 
গত কয়েকদিন যাবৎ ভাবছিলাম চেরী ফুলের আরও কিছু মুগ্ধতা দেখতে ব্রুকলীনের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি যাবো।
 
আমার তো আবার যা-ভাবা, তাই-ই কাজ।
চলে গেলাম। গেটে দিয়ে দেখি টিকেটের মুল্য ১৫ ডলার। মেজাটাই বিগড়ে গেল। সামান্য একটা গার্ডেন দেখবো ১৫ ডলার দিয়ে? আমার অফিসের সংগে ম্যানহাটনের বিখ্যাত ও বিশাল সেন্ট্রাল পার্কে ঢুকতে একটা পেনীও তো লাগে না!
 
তবুও গেলাম।
ফিরে আসাটাতো আর সুন্দর দেখায় না!
 
ভেতরে যেন চেরী ফুলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। অসাধারণ রূপ নিয়েছে গার্ডেনটি। পাছেই একটা ছোট কৃত্রিম লেক। সেখানে দেখলাম এই পৃথিবীর সবচে ক্ষদ্রুতম কয়েকটি ঝর্ণাও!
 
বেশকিছু জাপানীজ বৃক্ষরাজীও দেখলাম।
 
যাই হোক- যতকিছুই দেখি না কেন, ১৫ ডলার তো আর উসুল হচ্ছেই না।
 
একটু পরই চোখ পড়লো ‘কনজারভেটরীজ’ এর দিকে। কাছে গেলাম।
 
আমার চোখ আটকে গেল ‘ট্রপিক্যাল প্যাভেলিয়ান’ এর সাইনবোর্ডে!
চোখের সংগে মাথাটাও দ্রুত তার চিন্তা শুরু করে দিল। মনে হলো আমি বোধ হয় কিছু একটা পেয়ে গেছি!
 
যেটা দেখলে শুধুমাত্র ১৫ ডলারই নয়, হয়তো ১৫০০ ডলারও উসুল হওয়া সম্ভব!
 
এন্টারেন্স খুঁজে নিয়ে দ্রুতই ট্রপিক্যাল প্যাভেলিয়ন এর ভেতরে ঢুকলাম।
 
এবং হ্যাঁ। আমি পেয়ে গেছি।
আমি যা দেখলাম- তা দেখার জন্য গত প্রায় আড়াইটি বছর স্মৃতি হাতড়ে পার করে চলছি।
 
উত্তর গোলার্ধের এই প্রিয় হয়ে উঠা শহরটিতেও যে আমার প্রাণের বাংলাদেশ দেখতে পাওয়া সম্ভব- সেটা ভেবে উঠতে পারিনি আগে।
 
এটা আমারই চিন্তার দৈনতা ছাড়া কিছু না।
আমি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে এটা আমেরিকা। আর আমেরিকা তো সবই পারে।
 
জি। আজ দুপুরে আমি বাংলাদেশ ঘুড়ে আসলাম।
 
কি নেই সেই প্যাভেলিয়ানে?
সদ্য মোচা উঠা কাঠাল গাছ। ভাদ্রের ভেপসা অসহ্য গরমের মধ্যে পানিতে ফোটা শাপলা ফুল। গাছে সবুজ পেপে, কলা গাছ, আম্র মুকুলে সাজানো আম গাছ। আরও কত বন্য দেশী গাছের সমারোহ এই ট্রপিক্যাল প্যাভেলিয়ানে!
 
ওহ। সে এক অসহ্য আনন্দ।
 
আমার অতি প্রিয় সেই সাদা গন্ধরাজ ফুল ধরে কতক্ষন সময় নিয়ে যে তার গন্ধ শুকেছি আজ- সারা জীবনে সব মিলিয়েও হয়তো দেশের মাটিতে এতটা সময় ব্যয় করিনি গন্ধরাজের পেছনে।
 
শীতল নর্থ আমেরিকার ওয়েদারে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া এই আমি আজ যেন বাংলাদেশের সেই ভ্যাপসা, অসহ্য গরমকে পরম ভালবাসায় আলিংগন করেছি দীর্ঘসময় ধরে- কিছুটা ঘেমেছিও কিন্তু ভালবাসারা বোধ হয় এরকমই; ওই বদ্ধ ঘর থেকে বের হতে মন চায়নি একটুকুও।
 
অনেক দিন পর দেখা সেই কলাগাছই যেন আজ ছিল আমার অতি আপনজন কোনো!
 
আমার দেশের সেই কাগজী লেবুর গাছ, সেই দেশী লতা-পাতা, কচু গাছ, পাতা-বাহারী ফুলের গাছ যে গাছে ফুল হয়না কোনদিনও- তার সবই ছিল এই আজকের ‘গ্রীনহাউজ’এ।
 
আজ আমেরিকায় আমি গ্রীনহাউজ সম্পর্কে আরও কিছু জানলাম, শিখলাম আর ভালবাসলাম গ্রীনহাউজকেও।
 
   Send article as PDF