হায় মুজিব হায় মুজিব

শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের একটি ‘শক্তিশালি সেনাবাহিনী’ গঠনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো আমি কোন দানব সৃষ্টি করতে চাই না’।
 
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরাইলী যুদ্ধে আরব সমর্থনে শেখ মুজিব মিশরে বিমান-ভর্তি চা উপহার পাঠালেন। অর্থ ও অস্ত্রের অভাব থাকায় মুজিব শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে চা’কেই বেছে নিয়েছিলেন কিন্তু ঐ ‘চা’ ই ছিল তার জীবনের কাল।
 
শেখ মুজিব জানতেন না যে ঐ ‘চা’ ই তার জীবনের ট্রাজেডি ডেকে আনবে।
 
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশের উপহার প্রা্প্তির পর সিদ্ধান্ত নিলেন যে ‘চা’র পরিবর্তে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটা ভালো উপহার দিবেন।
 
করলেনও তাই।
তিনি জানতেন বাংলাদেশ অস্ত্রের দিক থেকে খুবই দুর্বল, তাই তিনি কায়রোর মরুভূমিতে সাজানো প্রচৃর ট্যাংক থেকে ৩০টি টি-৫৪ ট্যাংক বাংলাদেশে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দিলেন।
 
চায়াত্তরের প্রথম দিকে শেখ মুজিব এই উপহারের কথা জানতে পেরে প্রচন্ড বিরক্ত হন। কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না- ফরেন অফিস ও তার মন্ত্রীবর্গ তাঁকে বোঝালেন যে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের এই শুভেচ্ছা উপহার ফিরিয়ে দেয়া তাঁর উচিত হবে না।
 
অবশেষে জুলাই মাসে ৩০টি টি-৫৪ ট্যাংক এবং প্রায় ৪০০ রাউন্ড ট্যাংকের গোলা বাংলাদেশে এসে পৌছায়। ফাষ্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের পক্ষে এই ট্যাংকগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন করেন মেজর ফারুক রহমান। যদিও তিনি ছিলেন রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড কিন্তু অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যাপারে তার ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় এ সব তারই নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে।
 
চা’য়ের বদলে ট্যাংক।
 
এবং এর মাত্র এক বছর পর মেজর ফারুক রহমান এই ট্যাংকগুলি শেখ মুজিব হত্যায় ব্যবহার করেন।
 
শেখ মুজিব যদিও একটু চালাকী করেছিলেন, ট্যাংকগুলি সেনাবাহিনীতে মেজর ফারুককে দিলেও, তার গোলাগুলি সরিয়ে রেখেছিলেন জয়দেবপুরে আলাদা তত্বাবধানে।
 
মজার বিষয়টি হলো মেজর ফারুক কিন্তু গোলাবিহীন ২৮টি ট্যাংক দিয়েই (২টি ট্যাংক নষ্ট ছিল) শেখ মুজিব ও তার রক্ষীবাহিনীকে কুপোকাত করেন। কেউ বুঝতেই পারেনি যে মেজর ফারুকের ট্যাংকে গোলাই ছিল না।
 
পরবর্তীতে ফারুক রহমান এক সাক্ষাৎকারে এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তখন কেউ নিশ্চয়ই আমাকে এতটা পাগল ভাবতো না যে- আমি সম্পূর্ণ ফাঁকা গোলাবিহীন ট্যাংকবহর দিয়েই রক্ষীবাহিনীর মোকাবেলা করতে চাই’।
 
মেজর ফারুক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পছন্দ করতেন এবং চাচ্ছিলেন শেখ মুজিবকে উৎখাত করার পর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব যেন জিয়াউর রহমান গ্রহন করেন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের তাতে সম্মতি ছিল না- জিয়াউর রহমান নিজেকে এসবের বাইরে রাখতে চাইলেন এবং এসব বিষয় নিয়ে তার সংগে কোন আলোচনা না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
 
এতে, মেজর ফারুক এক পর্যায়ে জেনারেল জিয়াকে মুজিব হত্যার প্রতিবন্ধকও ভেবেছিলেন এবং একপর্যায়ে মুজিবসহ আরো কয়েকটি নামও উৎখাতের জন্য যোগ করেন। এরা তার জন্য পরে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে সে কারণে তিনি নতুন নামগুলি অন্তুর্ভূক্ত করেন। এদের মধ্যে ছিলেন, ফারুকের চাচা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মনসুর আলী, অন্যদিকে চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহামন এবং বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
 
অবশ্য অনেক অনুসন্ধান করে তাদের ওপর লক্ষ্য রাখার পর মেজর ফারুক এই লিষ্ট সংক্ষিপ্ত করেন। দেশের আসল শত্রু হিসাবে তিনি তিনজনের নাম লিপিবদ্ধ করেন।
 
শেখ মুজিব, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি এবং ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরানিয়াবত।
‘এই তিনজনকে মরতেই হবে’ ফারুক শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই স্থির হলেন।
 
৭০ থেকে ১৫০ জনের তিনটি ভিন্ন দলকে প্রধান তিন টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরানিয়াবত, শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যার দায়িত্ব দিলেন মেজর ফারুক। মুজিবের বাড়ীতে হামলার দায়িত্ব দেয়া হল ডালিমকে। কিন্তু তিনি এতে রাজী হলেন না- সম্ভবত প্রেসিডেন্ট মুজিবের পরিবারের সংগে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে তিনি এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। এর পরিবর্তে তিনি সেরানিয়াবতের দায়িত্ব নিলেন।
 
প্রাক্তন মেজর নূর ও মেজর মহিউদ্দিন এক কোম্পানী ল্যান্সারসহ শেখ মজিবকে উৎখাতের দায়িত্ব নিলেন। ফারুকের আস্থাভাজন নন-কমিশনড্ অফিসার রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন ওরফে মুসলিমকে দেয়া হলো শেখ মনিকে হত্যার দায়িত্ব।
 
তাদের প্রতি ফারুকের নির্দেশ ছিলো- শেখ মুজিব, সেরানিয়াবত ও শেখ মনিকে হত্যা করতে হবে। আর মুজিবপুত্র কামাল ও জামালকে বন্দি করে আনতে হবে। আর কাউকে কিছু করা যাবে না। তবে, তাদের এটুকু ক্ষমতা দেয়া হলো যে- প্রয়োজন বোধে পরিকল্পনায় বাঁধা সৃষ্টিকারীদেরকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। এই বাড়তি নির্দেশনাই সমগ্র হত্যাযজ্ঞের পথ খুলে দিলো।
 
মেজর মহিউদ্দিন, নূর ও হুদা শেখ মুজিবের খোঁজে এক রুম থেকে অন্য রুমে ছুটোছুটি করছিলেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে মেজর মহিউদ্দিন সামনে পেয়েও গেলেন- তার মাত্র ২০ ফুট সামনে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ মুজিব, পরনে ছিলো চেক লু্ঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি, হাতে ছিল পাইপ।
 
যদিও তার উপর নির্দেশ ছিল মুজিবকে দেখামাত্র হত্যা করার কিন্তু সামনাসামনি মুজিবকে দেখে মেজর মহিউদ্দিন তার মনোবল হারিয়ে ফেলেন, তিনি আমতা আমরা করে বললেন, ‘স্যার আপনি আসুন’।
 
মুজিব গর্জে উঠলেন, ‘কী চাও তোমরা? তোমরা কি আমাকে খুন করতে এসেছো? ভুলে যাও। পাকিস্তানী আর্মিরা এটা পারেনি, তোমরা কি মনে করো যে- তোমরা পারবে?’
 
নূর এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারছিলেন যে, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন, মহিউদ্দিনকে এক পাশে সরিয়ে নূর তার ষ্টেনগান দিয়ে গুলি করলেন মুজিবকে। মুজিব তাকে কিছু বলার সুযোগই পেলেন না।
 
বুলেট তাঁর বুকের ডান পাশে গিয়ে লাগলো। বুলেটের ধাক্কায় কিছুটা পিছিয়ে গেলো তাঁর দেহ। সিঁড়িতে পড়ে গেলেন তিনি। তাঁর দেহ সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নীচে। তখনো তাঁর হাতে পাইপটি শক্ত করে ধরা ছিলো।
 
(ফরিদ কবির এর রুপান্তরিত এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এর লেখা ‘বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত দলিল’ অবলম্বনে আর্টিকেলটি তৈরী করলাম।)
   Send article as PDF