গল্প কথা

দক্ষিন আফ্রিকান ইলন মাস্ক আমেরিকান কোম্পানী টুইটার কিনেই ভারতীয় সিইও পরাগ আগারওয়ালকে ’তাকে বিভ্রান্তকর তথ্য দেয়ার অপরাধে’ চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেছেন।

কেমন হলো হেডলাইন টা?

অথবা যদি এভাবে বলি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জার্মান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আইরিশ-ফরাসী জো বাইডেন?

ভারতীয় ঋষি সুনাক যদি বৃটিশ প্রাইম মিনিস্টার হয়ে থাকেন তাহলে আমার উপরের বক্তব্যগুলিও একশত পার্সেন্ট সত্য।

বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধী দেয়া হেনরী কিসিঞ্জার বা টার্মিনেটর খ্যাত হলিউড নায়ক আর্নল্ড শোয়ার্জনিগার্ভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করার ‘অযোগ্য’ হয়েছিলেন – কারণ তাদের জন্ম আমেরিকার মাটিতে হয়নি যদিও তারা আমেরিকান সিটিজেন ছিলেন। তারা ছিলেন যথাক্রমে জার্মান ও অস্ট্রিয়ান।

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পররাস্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ম্যাডলিন অলব্রাইট। মিসেস ব্রাইট পররাস্ট্রমন্ত্রী পদ ছাড়ার পরপরই চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেসময় কোনও একটি চেক পলেটিক্যাল পার্টি ম্যাডলিন অলব্রাইডকে তাদের দলীয় নমিনেশন নিয়ে চোকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার প্রস্তাব বেশ আলোচিত হয়েছিলো। অলব্রাইট ফিরে যাননি।

ইওরোপিয়ানরা যদি ভারতীয় হতো তাহলে তারা অনেক বছর আগেই দাবী করে বসতো – ‘আমেরিকা আমাদের; আমরাই তো ওটার মালিক’।

শুনুন, আমেরিকা-ক্যানাডা অথবা অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে ওখানকার ভূমিপূত্র বা আদিবাসীদের কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বৃটিশ ও ইওরোপিয়ানরা ওসব ভূখন্ডগুলো আবিস্কার করার পর স্থানীয় ভূমিপুত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করে তাদেরকে সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতিতে পরিণত করে। তারপর ক্যানাডা ও আমেরিকার বড় অংশ চলে যায় বৃটিশদের দখলে – নাম হয়ে যায় ‘নিউ ইংল্যান্ড’। আর কিছু অংশ চলে যায় স্প্যানিশদের দখলে। আর ’বলতে গেলে’ নিউজ্যিাল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া এখনও বৃটিশদের দখলদারিত্বেই রয়েছে।

তো বৃটিশদের দখলিকৃত এই বিশাল বিশাল ভূখন্ডগুলো থেকে শুধুমাত্র আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন (যার বাপ-দাদারাও ছিলো ইংল্যান্ড বা বৃটেন থেকেই আগত) এর নেতৃত্বে আমেরিকা মানে ‘নিউ ইংল্যান্ড’ থেকে বৃটিশদের তাড়িয়ে একটি স্বাধীন ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা নামের দেশের প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেয়া হয়।

১৭৭৬ সালের জুলাই মাসে এই ঘোষনার পরপরই সেপ্টেম্বর মাসে বৃটেন থেকে শতশত কাঠের তৈরী যুদ্ধজাহাজ নিয়ে ৩২ হাজার সৈন্য নিউ ইয়র্ক সিটিকে আক্রমন করে বসে। জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয় নিউ ইয়র্ক সিটি। পরবর্তী প্রায় ৬ বছর বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকে নিউ ইয়র্ক সিটি সহ নিউ ইংল্যান্ড (মেইন, ভারমন্ট, নিউ হ্যাম্পশেয়ার, ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট ও রোধ আইল্যান্ড) এর বিশাল এলাকা।

নিউ ইয়র্ক সিটিতে ঐ সেই আক্রমণটিকে গণ্য করা হয় সবচে বড় আক্রমণ হিসাবে। আর দ্বিতীয় ভয়াবহ আক্রমণ হিসাবে ধরা হয় নাইন-ইলেভেন এর টুইনটাওয়ার্সের সন্ত্রাসী বিমান হামলাকে।

যাই হোক, অবশেষ জর্জ ওয়াশিংটন এর সুদক্ষ নেতৃত্বে, তাদের দুর্ধষ গেরিলা আক্রমনে, নতুন নতুন অস্ত্র তৈরী করে তা দিয়ে এবং ফ্রান্স সরকারের সমর্থনে সমন্বিত আক্রমনে বড় সংখ্যার বৃটিশ অফিসার নিহত হয় এবং এক পর্যায়ে বৃটিশরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় বা আত্মসমর্পন করে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’র কাছে। আমেরিকার সেই যাত্রা শুরু হয়। সারা পৃথিবী থেকে সাহসী মানুষগুলো বিশাল আটলানটিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তেনে আমেরিকায় চলে আসতে থাকে। আমেরিকায় ‘আমেরিকান’ বলে কোনও জাতি-গোষ্ঠী নেই। এখানে বিশ্বের ২০০ টি দেশের মানুষ নিয়েই আমেরিকান।

জর্জ ওয়াশিংটন নিজেই ছিলে বৃটিশ বংশোদ্ভুত।

বৃটিশরা কি এখন দাবী করবে যে, আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা একজন বৃটিশ!

বিষয়টা কেমন হাস্যকর শোনাবে বলুন তো?

আসলে আমেরিকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে মুলত বৃটেন ও ইওরোপ থেকে আসা মিলিয়ন মিলিয়ন সাদা চামড়ার মানুষরা। তাই বলে কি আমেরিকাকে কেউ কোনও কালে ইওরোপ হিসাবে ভেবেছে?

চাইনিজ বা ভারতীয়রা অথবা অন্যরা তো আমেরিকান হয়েছে এই সেদিন থেকে। আমি নিজেই এসেছি মাত্র ৮ বছর।

মুল বিষয়টি হচ্ছে, যে মানুষটা নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্য কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চলে যায় – তাকে সেই জন্মভূমির বা সাবেক দেশের ‘নাগরিক’ বা বংশোদ্ভুত বলে দাবী করাটা স্রেফ বোকামী এবং হীনমন্যতার পরিচায়কও বটে।

দেখুন, আমেরিকা-ক্যানাডা-অস্ট্রেলিয়া বা ইওরোপে যারা যায় তাদেরকে ‘প্রবাসী’ বলাটা সম্পূর্ণ বোকামী অথবা না জানা থেকে বলা একটি বড় ভুল। প্রবাসী তো তারা যারা কিনা নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য বিদেশে যায় টাকা রোজগারের আশায়। আমেরিকা-ইওরোপে যারা যায় – তারা তো একেবারেই চলে যায়। ফিরে আসার জন্য যায় না। তারা সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহন করে। এবং তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের ‘ডুয়েল সিটিজিনশীপ’ রক্ষা করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশী ডুয়েল সিটিজেনশীপও আর নেয় না। তারা চিরতরে এবং জন্মগতভাবেই সম্পূর্ণ বিদেশ হয়ে ওঠে।

তো, এই বিদেশী হয়ে উঠা বা বিদেশী হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াদের (যারা কি না সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যায়) ‘বংশোদ্ভুত’ বলাটা ব্যাকরনীকভাবে সঠিক হলেও তাদেরকে ’নিজেদের মানুষ’ বলে দাবী করাটা আমার কাছে নিছক হ্যাসকর-ই মনে হয়।

বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করা বৃটিশ কুটনৈতিক আনোয়ার চৌধুরীকে একবার ঢাকার ‘চেতনাজীবি’ কিছু সাংবাদিকরা মিলে জাপটে ধরে নিজেকে তার মুখ দিয়ে ‘বাংলাদেশী’ বলানোর জোর চেস্টা করেও সফল হতে পারেনি। তিনি বরাবরই বলে গেছেন তিনি বৃটিশ, তিনি রানী এলিজাভেথ এর প্রতিনিধিত্ব করতে ঢাকায় এসেছেন। পরিস্কার।

শেখ মুজিবের নাতনী, শেখ রেহানার কন্যা বৃটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকী তো সরাসরি ক্যামেরার সামনে বলেই দিলেন – ‘আই এম নট বাংলাদেশী’।

আমি আমেরিকায় এসেছি ‘আমেরিকান’ হয়ে উঠার জন্য। বাংলাদেশী থাকার নিমিত্তে আমি আমেরিকায় চলে আসিনি। বাংলাদেশ আমাকে আমার মেধা যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে – তাই আমি বাংলদেশ ত্যাগ করেছি।

অপরদিকে আমেরিকা হচ্ছে ‘ল্যান্ড অব লিবার্টি; ল্যান্ড অব অপুর্চুনিটিজ। এসব শুধুই কথায় নয় – শতভাগ কাজেই প্রমাণিত। এই দেশ আমাকে পূর্ণ মানবিক স্বাধীনতা দিয়েছে; এই দেশ আমাকে চিনতে সহায়তা করেছে যে – ’আমি একজন মানুষ’; এবং এই দেশ আমাকে একজন মানুষ হিসাবে অবারিত সুযোগ মেলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠিত হবার। আমি সেই সুযোগ ভোগ করছি। এই দেশের কাছ থেকে আমি না চাইতেই অনেক কিছু পেয়েছি।

অথচ, বাংলাদেশ কে আমি বছরে পর বছর শুধু দিয়েই গেছি – কিছুই পাইনি। প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ট্যাক্স দিয়েছি, ভ্যাট দিয়েছি, ২৫-৩০ জন কর্মচারী আমার প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলাদেশ আমাকে কি দিয়েছে? আপনি কি পাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে? আপনি অনাহারে থাকলে বাংলাদেশ আপনাকে একবেলা খাবার দিবে? অসুস্থ হয়ে থাকলে চিকিৎসা দিবে আপনার বাংলাদেশ? নাহ, দিবে না; তবে আপনার টাকায় ওখানকার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও তাদের পরিবার ভিভিআইপি সুবিধাদি নিবে, বিদেশে চিকিৎসা নিবে। আপনি ওখানকার চতুর্থ শ্রেনীর নাগরিক। আপনি না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও বাংলাদেশের কিছুই যায় আসে না।

আর আমি নাগরিক না হয়েও আমেরিকায় প্রথম শ্রেনীর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি। বিনামূল্যে এদশে আমার চিকিৎসা দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। কোভিড পেন্ডামিকের সময় ঘরে বসে বসে আমি টানা ২ বছর প্রতি সপ্তাহে আমার একাউন্টে হাজার ডলার জমা হতে দেখেছি।

বাদ দিন এসব।

যে জন্য এসব বলা।

ইলন মাস্ক সাউথ আফ্রিকা থেকে, বারাক ওবামার পিতা কেনিয়া থেকে, নামকরা স্থপতি ফজলুর রহমান খান বাংলাদেশ থেকে, আর সুন্দর পিচাই বা পরাগ আগারওয়ালরা যদি ভারত থেকে অন্যদের মতোই আমেরিকায় ’হিজরত’ না করতো – তাহলে তারা আজ কেউ ই ইলন মাস্ক, বারাক ওবামা, এফআর খান, সুন্দর পিচাই বা পরাগ আগারওয়াল হয়ে উঠতে পারতো না।

তদ্রুপ ঋষি সুনাকও বৃটিশ প্রাইম মিনিস্টার হতে পারতেন না।

যে যেখানে পৌছে গেছে – তাকে সেখানেই থাকতে দিন। ঋষি সুনাক কোন কালেও পাকিস্তান বা ভারতের স্বার্থ দেখবেন না; তিনি শ্রেফ বৃটিশদের স্বার্থই দেখতেন। কারণ বৃটেনই তাকে ‘ঋষি সুনাক’ হতে দিয়েছে।

ভারতে থাকলে তিনি ‘ঋষি সুনাক’ হতে পারতেন কি?

কালো বারাক ওবামা সাদাদের প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন কি যদি তিনি প্রথমে আমেরিকান না হতে পারতেন?

বারাক ওবামা কেনিয়া গিয়ে তাদের (কেনিয়ানদের) মাথা হাত বুলিয়ে এসেছেন – উপচে পরা ভালোবাসার কিছুটা ফেরত দিতে। ঋষি সুনাকও হয়তো ভারত বা পাকিস্তানে গিয়ে ’তাদের’ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আসবেন একজন বৃটিশ হিসাবেই।

বাংলাদেশে যেমন কোন আত্মীয় বা বন্ধু ‘বড়’ কেউকেউটা হয়ে গেলে সকলেই তাকে আমার বন্ধু বা আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দেয় – ’ওসব’ বংশোদ্ভুত বলার গল্পটাও একই রকম।

এরচে বেশী কিছু নয়।

বাস্তবতা যে যত দ্রুত মেনে নিতে পারে তার উত্থান তত দ্রুতই হয়।

নইলে হাজার বছর পিছিয়ে থাকতে হয়।

   Send article as PDF