অন্যায়কারী সবসময়ই দুর্বল

একজন আদর্শ পিতা তো তার বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন- এটাই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য এবং বাস্তবতা।
 
শেখ মুজিবর রহমান কোনদিনই জাতির পিতা হতে চেষ্টা করেননি- তিনি চেয়েছেন আজীবন ক্ষমতায় থাকতে। আর সেজন্য যা যা করা দরকার তিনি তার কোন কিছুই করতে বাকী রাখেননি।
 
এবং শেষটায় নিজ সংগঠন ‘আওয়ামী লীগ’ পর্যন্ত বিলুপ্ত করে গঠন করেছিলেন ‘বাকশাল’। যদিও বর্তমান কথিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শভুক্ত শেখ হাসিনা ও তার দল সেই পিতার বাকশালকেই বাতিল করে আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে চলছে! কোথায় যে কার পিতার অদর্শ- কে জানে?
 
শেখ মুজিব সেনা বাহিনীকে প্রছন্ড অপছন্দ করতেন। তিনি ‘পারলে’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেন না। আর তাইতো পারেননি বলেই সেনাবাহিনীকে সমূলে ধ্বংশ করতে যা যা করা দরকার তার সবটাই করেছিলেন।
 
এক ঢিলে দুই পাখি মারার জন্য শেখ মুজিব গঠন করেছিলেন ‘রক্ষীবাহিনী’। যেটার স্থান দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীরও উপরে। শেখ মুজিব ধারণা করতেন প্রয়োজনে ইন্দিরা গান্ধী তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে শেখ মুজিবকে সহায়তা করবেন- সুতরাং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী না থাকলেও চলবে।
 
সেই বোধ থেকেই শেখ মুজিব ২৫ হাজার সদস্য বিশিষ্ট রক্ষীবাহিনী গঠন করেন- তাদের হাতে তুলে দেন অত্যাধুনিক সব অস্রসস্ত্র এবং উন্নত প্রশিক্ষন।
 
আর সেনাবাহিনীর উপর পূর্ণ কতৃত্ব বজায় রাখতে শফিউল্লার মতো একজন নপুংসককে সেনা প্রধান হিসাবে বানিয়ে রেখেছিলেন এবং নিজে সন্তান শেখ জামালকে সেনাবাহিনীর উঁচু পদে নিয়োগ দেবার জন্য তৈরী করে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিব- শেখ জামালকে যুগোস্লোভ মিলিটারী একাডেমীতে ট্রেণিং এর জন্য পাঠিয়েছিলেন যদিও জামাল সেখানে ভাল ফল করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
 
এবং শফিউল্লাহকে ফোনে শেখ মুজিব নির্দেশ দেন যে শেখ জামালকে স্যান্ডহার্ষ্টে ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেবার ব্যবস্থা করতে। যদিও বিষয়টা অত্যন্ত জটিল ছিল কারণ স্যান্ডহার্ষ্টের ক্যাডেটদের অনেকগুলি জটিল পরীক্ষা ও পদ্বতির পর নির্বাচন করা হতো। সেখানে যোগ দেবার মতো যোগ্যতা শেখ জামালের ছিল না।
 
ফলে ধারণা করা হলো যে ব্রিটেনের প্রিমিয়ার মিলিটারী একাডেমী জামালকে যথেষ্ঠ যোগ্য বিবেচনা করবে না কিন্তু যেহেতু এটা ছিল নবগঠিত একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুরোধ সেহেতু তারা শেখ জামালকে নিতে রাজী হলো কিন্তু শর্ত দিলো অতিরিক্ত ৬০০০ পাউন্ড প্রধান করতে হবে এবং এই টাকাটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অজ্ঞাতে হুন্ডি করে বৃটেনে পাঠানো হয়েছিল এবং জামালকে সেখানে ভর্তিও করা হয়েছিল।
 
শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর প্রতি সব সময় এক ধরণের বিদ্বেষ পোষন করতেন। এন্থনী ম্যাসকারেনহাসকে একদিন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগ্রেডিয়ার মঞ্জুর বলেছিলেন, ‘এদেশের সেনাবাহিনী হচ্ছ একটি স্বেচ্ছাসেবক দলের মতো। আমাদের অফিসার এবং লোকেরা যেহেতু আর্মী হিসাবে তাদের ক্যারিয়ার তৈরী করতে চায়, সেহেতু তাদের স্বেচ্ছাসেবক হয়েই কাজ করতে হচ্ছে। বিনিময়ে কি পেয়েছে তারা? তারা প্রত্যেকেই হতভাগ্য, তাদের কোন প্রশাসন নেই, যন্ত্রপাতি নেই। তুমি অবাক হবে, তাদের জার্সি, কোট, বুট পর্যন্ত নেই। শীতের রাতে তাদের কম্বল দিয়ে গার্ড দিতে হয়। আমাদের অনেক ট্রুপ লঙ্গি পড়ে তাদের কাজ করছে। তাদের কোন ইউনিফর্ম পর্যন্ত নেই!’
 
‘সেনাবাহিনীর সদস্যদের পুলিশের সদস্যরা পর্যন্ত হয়রানি করতো। একবার আমাদের কিছু ছেলেকে মেরে ফেলা হলো। আমরা শেখ মুজিবের কাছে গেলাম, মুজিব আশ্বাস দিলেন যে তিনি ব্যাপারটি দেখবেন। পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, আমাদের ছেলেরা নাকি কোল্যাবোরেটর্স ছিল। আসলে মুজিব সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে সব রকম পন্থাই ব্যবহার করেছিলেন। তিনি কাউকে তাঁর জীবনের জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সন্দহ করলেই সেখানে ভাঙ্গন ধরিয়ে দিতেন। একমাত্র মুজিবই সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়েছেন, টুকরো টুকরো করেছেন সেনাবাহিনীকে।’
 
আর শেখ মজিব নিজে বলেছেন, ‘আমি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো আমি কোন দানব সৃষ্টি করতে চাই না’।
 
অপরদিকে ২৫ হাজার রক্ষীবাহিনী তখন অত্যন্ত সুসজ্জিত। তবে, এই রক্ষীবাহিনী অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সারাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। হত্যা-খুন নির্যাতনের বহু ঘটনা রক্ষী বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়।
 
শেখ মুজিবের মতোই তার ছেলে শেখ কামালও ছিল খুবই ‘হট-হেডেড’। বাবার মতো তারও বাংলাদেশের প্রতি ‘মালিকজনোচিত’ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তার পরিবার বা দলের সমালোচনা বা বিরুদ্ধচারণকে সে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে মনে করতো। প্রকৃত পক্ষে কামালের অনেক আচরণে শেখ মুজিবও খুব বিব্রত বোধ করতেন।
 
ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর অফিসাররা নানা রকমের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে লাগলেন। তারা বহু কষ্টে শতশত চোরাকারবারী, খুনী, ডাকাকদের আটক করার পরই ঢাকা থেকে টেলিফোন কলেই ছাড়া পেয়ে যেত। এ ছিল এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। যখনই সেনারা কোন দুষ্কৃতিকারীকে আটক করতো, তখনই দেখা যে তারা আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের আত্মীয়-স্বজন অর্থাৎ ক্ষমতাশালির লোক। ফলে ওপরওয়ালাদের ইচ্ছে অনুযায়ী এদেরকে ছেড়ে দিতে হতো। বিনিময়ে উল্টো সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঝামেলা পোহাতেন।
 
একবার মেজর নাসের তিন সন্ত্রাসীকে আটক করেন, এরা তিনটি খুনের সংগে জড়িত ছিল। নব-বিবাহিত এক দম্পত্তি তাদের গাড়িতে টংগী যাবার পথে মোজাম্মেল নামে এক দুর্ধর্ষ আওয়ামী লীগার ও তার সহকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। গাড়ীর ড্রাইভার ও আরোহীকে হত্যা করে তারা সেই মেয়েটিকে ধর্ষন করে। তিনদিন পর রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া যায়।
 
ধরা পড়া মোজাম্মেল মেজর নাসেরকে ৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্তু মেজর নাসের তাদেরকে কোর্টে চালান করে দেন। আওয়ামী লীগের লোকেরা তাৎক্ষনাত শেখ মুজিবের কাছে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায় যে মেজর নাসের আওয়ামী লীগের নেতা মোজাম্মেলকে গ্রেফতার করেছে এবং ৩ লাখ টাকা ঘুষ দাবী করেছে। শেখ মুজিব সংগে সংগে মোজাম্মেলকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন এবং কয়েকদিন পরই দেখা যায় সেই নৃশংস খুনের আসামী মোজাম্মেলকে জনসম্মুখে ঘুরে বেড়াতে।
 
ঠিক এরকম এবং এরচেও বাজে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল শেখ মুজিবের শাসনামলে।
 
এরকম একটা পরিস্থিতে মেজর ফারুকের নেতৃত্ব শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়।
 
আজ ঠিক চার যুগ পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তারচেও করুণ অবস্থানে ফেলে দেয়া হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন ব্যস্ত রাস্তা তৈরীতে, পোলট্রি ফার্মে, ব্যাংকিং ব্যবসায় আর জাতিসংগে উচ্চ বেতনে চাকুরীতে।
 
শেখ হাসিনা মুলতঃ তার বাবার শাসনামলের ‘ফাঁকগুলি’ খুব গভীর ভাবে বিশ্লেষন করে সেই গ্যাপগুলি পূরণ করে দেশের উপর ঝেকে বসেছে।
 
শেখ হাসিনা সম্ভবত একটা হিসাবে এখনও করে উঠতে পারেননি যে জেনারেল শফিউল্লাহ শেখ মুজিবকে বাঁচাতে পারেননি, ক্ষমতাও রাখতেন না। আর তার রক্ষীবাহিনীও তখন সাভারে ঘাস কাটছিল বসে বসে- মেজর ফারুকের ‘গোলাবিহনী’ কয়েকটি ট্যাংক দেখেই ভয়ে হিসু করে দিয়েছিল।
 
শেখ হাসিনা আসল শিক্ষাটাই পাননি যে, ‘অন্যায়কারী সবসময়ই দুর্বল’।
   Send article as PDF