জ্যোতিষী

সেটা ১৯৯১ সালের কথা যদ্দুর মনে পড়ে। তখন সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট এর ছাত্র। আমাদের দোহার থানার নুরুল্লাহপুর (সুন্দরীপাড়া) ফকির বাড়ীতে বার্ষিক মেলা বসে সপ্তাহব্যাপী- অনেক দূর-দুরান্ত থেকে ফকির-ভক্তরা সমবেত হয় ওখানে- কি সব হাবি-জাবি করে।
 
আমি এক আধ দিন যাই সেখানে দেখতে। অনেক রকম মানুষ, কিছু বিষয়তো রয়েছেই দেখার মতো। সেবছর আমি আমার দু’ভাগ্নে ব্লাক এন্ড হোয়াইট কে নিয়ে গেলাম মেলায়। 
হাটতেছি- হঠাৎ চোখে পড়লো সার্কাসের প্যান্ডের বাইরে একজন অতি বয়স্ক লোক মানুষের হাত দেখতেছে ৫ টাকার বিনিময়ে।
আমি কোনদিন হাত দেখাইনি। এসব পছন্দও করি না। কিন্তু সেদিন হঠাৎ মনে হলো দেখাই-ই না! কেমন লাগে?
কাছে গেলাম, বললাম, ‘আমার হাত সময় নিয়ে দেখতে হবে এবং যদি সঠিক বলতে পারেন তবে ৫ টাকা নয় ১০ টাকা পাবেন।’
লোকটা আমার মুখের দিকে তাকালো। আমার হাত না দেখেই বলল, ‘আপনার হাত আমি দেখবো। তবে তার আগেই আমি আপনাকে কয়েকটা কথা বলে দিচ্ছি। প্রথমত আপনার মাথার অতি ঘন এবং কোকড়ানো চুল বলে দিচ্ছে যে, আপনার মাথায় গিজগিজে বুদ্ধিতে ভড়া।’
অামি বুঝলাম সে আমাকে বায়েষ্ট করার চেষ্টা করছে।
এবার সে আমার হাত দেখলো। আরো কীসব বলে শেষটায় বলল- ‘আপনি ৮৩ বছর হায়াৎ পাবেন। এবং আটলান্টিক মহাসাগরের ওপাড়ে আপনার একটা বিশাল বাড়ী হবে।’
 
আমি খুশী হবো না বিরক্ত হবে- না বুঝেই তাকে ১০টাকা দিয়ে বিদায় নিলাম।
 
অগ্রণী ব্যাংক, সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার তৎকালিন ম্যানেজার পরবর্তীতে ডিজিএম আলাউদ্দিন ভাই আমার খুব ঘনিষ্ঠ বনধু। একদিন দুপুরে গেলাম আড্ডা দিতে- সেটা ২০০৩ সালের দিকের ঘটনা। সেদিনই লক্ষ্য করলাম তার হাতে বেশ কয়েকটি আংটি। এবং তার সামনে বধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক বসা। অালাউদ্দিন তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি একজন পামিষ্ট। আলাউদ্দিন ভাই তাকে বললেন আমার কষ্টি করিয়ে দিতে। ভদ্রলোক ১ সপ্তাহ সময় নিলেন এবং বললেন আগামী সপ্তাহে আমার কষ্টি করে লিখে জানিয়ে দেবেন।
ভদ্রলোক তখনই আমার হাত দেখলেন। বললেন, আপনাকে বিস্তারিত ৭/৮ দিন জানিয়ে দেব। তবে একটা কথা আপনাকে এখনি বলছি, ‘আপনি সবসময় খুব সতর্কভাবে হাঁটবেন।’
আমি প্রশ্ন করলাম কেন?
তিনি জানালেন, আপনার বা’পা ছোট বেলায় একবার ভেংগে গিয়েছিল। এবং আপনার পা’য়ের উপর এখনও রাহুর ভর রয়েছে। বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কাজেই খুব সাবধান থাকবেন।
 
আমি বিস্মিত হলাম।
আমি ছোট বেলায় খুব ভালো এ্যাথলেট ছিলাম, খুব দ্রুত দৌড়াতাম, হাই জাম্প, লং জাম্পও খুবই ভাল খেলতাম। এতটাই ভালো খেলাম যে ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া একজন হয়ে আমি ক্লাস টেন এর ছাত্রদের সাথে পাল্লা দিতে চাইতাম।
তো, সেই পাল্লাই আমার জীবনের খেলাধূলাটা থামিয়ে দিল।
একদিন হাই জাম্প দিলাম। ঠিক তখনই অনিয়ন্ত্রিতভাবে দশম শ্রেনীর রমজান ভাই আমার পায়ের উপর লাফিয়ে পড়লো। গেল আমার বাঁ’ টা-টা ভেংগে। দেড় মাসের পলেস্তারা, চিকিৎসা বিশ্রাম। তারপর সব ঠিক। আমি নিজেও সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু স্পোর্টস থেকে সড়ে গিয়েছিলাম। বাট, আমার এসব কোন চিহ্ন নেই পায়ে বা হাটা চলায় বিন্দুমাত্রও।
 
এই ভদ্রলোক বললেন কিভাবে?
 
২০০৫ সাল।
প্রথম প্রাইভেট কার কিনলাম।
 
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকুরী করে আমার পরিচিত একটা ছেলে। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স সহ মাষ্টার্স করা তুখোড় মেধাবী একজন ছেলে। খুবই চটপটে এবং বুদ্ধিদীপ্ত একটা ছেলে। ছেলেটাকে আমি খুব লাইক করতাম। ওর নাম শামীম সারোয়ার্দী। (নামটা পলাশ ভাই মনে করিয়ে দিলেন, থ্যাংক ইও পলাশ ভাই)
 
হঠাৎ একদিন বিকেলে আমার অফিসে এসে উপস্থিত।
‘ভাই একটা আবদার নিয়ে এসেছি। আপনার গাড়ীটা আমাকে একদিনের জন্য দিতে হবে। আমি বগুড়া যাবো। খুব ভোরে যাবো এবং রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো। প্লিজ প্রশ্ন করবেন না কেন- আমি বলতে পারবো না। ফিরে এসো হয়তো বলবো।’
 
আমি আবার না করতে পারি না।
সে রাতে ফিরে আসলো, আমার গ্যারেজে গাড়ী পার্ক করে একটা এসএমএস দিয়ে জানিয়ে দিল, ড্রাইভার বাসায় এসে গাড়ীর চাবি রেখে গেল।
পরদিন বিকেলে আমার অফিসে আসলো সেই হাস্যজ্বল ছেলেছি।
 
সে আমাকে যা শুনালো অমি তো অবাক।
 
সে বগুড়া গিয়েছিল কার্তিক দা নামের এক জোতিষের কাছে। সে নাকি সব কিছু বলে দিতে পারে। সে তার কাহিনী বলল এবং আগে আমাকে বলেনি কারণ আমি তাকে বোকা ভাববো এজন্য। কার্তিক দা নাকি ফোনে কথা বলে বার্থ ডেট নিয়েও অনেক কিছু বলে দিতে পারে।
আমার খুব আগ্রহ জন্মালো।
 
পলাশ ভাইকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম- অপারেশন বগুড়া। কার্তিক দা’কে বোকা বানানোর জন্য মোটামুটি আয়োজন করে গেলাম।
কার্তিক দা আমাদের বসতে বললেন। প্রথমে আমার হাত দেখবেন।
 
আমার জন্ম তারিখ, জন্ম স্থান নিলেন, কি সব আঁকা-আকি করলেন। হাত না দেখেই আমাকে বললেন, ‘তুমি পুলিশে যোগ দিলে না কেন? তুমি ডিকেটটিভ ব্রাঞ্চে গেলে অনেক ভালো করতে পারতে?’
আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আপনাকে কে বলল যে আমি পুলিশে চাকুরী করছি না? আমি পুলিশেই কাজ করছি ঢাকার একটা থানায় আছি’।
কার্তিকদা আমাকে হতবাক করে দিয়ে বললেন, ‘তুমি ব্যবসায়ী। তোমার মাথা মাঝে মাধ্যে অনেক গরম হয়ে যায়, তখন কাউকে কেয়ার করো না। ডিপ্লমেসী না জানলে তো ভাল করতে পারবে না। তুমি নিশ্চিত দেড় দুই কোটি টাকা আয়ের সুযোগটা ২০০৩ সালে লাথি দিয়ে ফেলে দিলে?’
তিনি আমার হাতের স্কিন ধরে এসব কথা বললেন। হাত দেখলেন আরও পরে।
 
আমি বোকা হয়ে গেলাম। পলাশ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পলাশ ভাইও রীতিমত বোকা!
 
আমি দমবার পাত্র নই। পকেট থেকে দুটো ছবি বের করলাম। দু’টো মেয়ের ছবি- ব্যাক সাইডে নাম এবং জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে। ছবি দুটো কার্তিক দা কে দিয়ে বললাম।
 
‘কার্তিক দা, বিয়ে করবো। দেখেনতো কোন মেয়েটা আমার জন্য উপযুক্ত হবে?’
কার্তিক দা ছবি দু’টো হাতে নিলেন। কিসব আকা-আকি করলেন। তারপর একটি ছবি আমাদের সামনে টেবিলের উপর রেখে বলিষ্ট কন্ঠে বললেন, ‘এই মেয়েটার সাথে তোমার ২০০২ সালের জানুয়ারী মাসে বিয়ে হয়েছে। আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাও?’
এরপর কার্তিক দা আর যা যা বলেছিলেন তার মধ্যে কয়েকটি সুন্দরভাবেই মিলে গিয়েছে পরবর্তীতে এবং আরও দু’টো বিষয় নিয়ে সত্যি আমি অপেক্ষায় রয়েছি- দেখা যাক মিলে কি না। সম্ভবনা রয়েছে মিলে যাবার।
যা ই হোক, আমি উল্টো বিভ্রান্ত হয়ে ঢাকায় ফিরলাম সেদিন রাতেই।
 
জোতিষ চর্চার বিষয়গুলিতে খুব মজা পেয়ে গেলাম।
এরপর আগরতলায়, গৌহাটিতে, কোলকাতায় আরও বেশ কয়েকজন জোতিষের কথা থেকে অনেক অভিজ্ঞতা নিলাম। ওরা তেমন একটা সুবিধার ছিল না- বলতে হবে।
 
এরপর দিল্লী। ২০১১ সালের কথা।
কোন কাজ নেই। ট্রেন ষ্টেশনের বিপরীত দিকের একটা গলি দিয়ে হাঁটছি। একটা সাইনবোর্ডে জোতিষ স্যাম্বল দেখে ভেতরে গেলাম। একটা বড় লাইব্রেরীর মতো, ভেতরে একজন জোতিষ বসে আছেন।
 
ওনি আমার হাত, পা সব দেখলেন। তারপর কিসব লেখা-লেখী করে অবশেষে বললেন, তোমাকে স্থান চেঞ্জ করতে হবে। তুমি সাগরের পারের কোন শহরে গিয়ে ব্যবসা করো- অনেক ভালো করতে পারবে। ওনার আরও কিছু কথাও অনেকটাই ভালো লেগিছিল।
এতক্ষণ আমরা ইংলিশেই কথা বলছিলাম। শেষ টায় তিনি শুদ্ধ বাংলায় বললেন, ‘আমার বাড়ী গৌহাটি, আমি বাংলা, হিন্দি এবং অসমীয়- তিন ভাষাতেই সাবলীল। ভদ্রলোকের সাথে এখনও মাঝে মধ্যে কথা হয়। তিনিও কার্তিকদার মতো করেই বেশ কয়েকটা ভবিষ্যত বানী দিয়ে রেখেছেন। দেখা যাক সময় কি বলে?
এই দিল্লীর বিখ্যাত জোতিষের নাম প্রফেসার কাপুর। ওনি কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এবার আরেকজন শখের জোতিষের কথা বলবো।
 
তিনি একাধারে একজন কোরানে হাফেজ, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং ভাল একজন ওয়াজেন ও শেষ টায় তিনি ঢাকার দোহার থানার কুসুমহাটি ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করেছেন। ওনি ওহাব হুজুর।
১৯৯৫ বা ১৯৯৬ সালের দিকে, গ্রামে কোন এক বিয়ে বাড়ীতে তিনি খাবার শেষে বসে আছেন। আমাকে ওনি বিশেষ স্নেহ করতেন (আমি ওই সময়টাতে নিয়মিত নামাজ পড়তাম এজন্য মনে হয়!), অবশ্য এখনও করেন।
 
হঠাৎ তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমার হাত দেখতে চাইলেন। আমি জানতাম না যে ওনি হাতও দেখতে জানেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম।
ওনার সেই দিনের সেই বক্তব্য আমার আজও হুবহু মনে আছে, ‘দেখ, তুমি বুহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। তুমি যে-কোন বিষয়, বিশেষ করে জটিল বিষয়গুলি খুব দ্রুত ধরে ফেলতে পারো। এছাড়া তুমি প্রায় বিষয়েই ভালো জ্ঞান রাখো এবং আরও জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করো। তোমার ভেতরের এই বিষয়টা তোমার জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়ে যাবে ভবিষ্যত জীবনে।’
 
আমি প্রশ্ন করলাম, প্রব্লেমটা কোথায়? জানলে ক্ষতি আছে কি?
ওনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘দেখ, যে সব কিছু জানে- সে মূলতঃ কোন কিছুই জানে না। তোমাকে বুজতে হবে জীবনে তুমি সব কিছু হতে পারবে না। তোমাকে যে-কোন একটি দিকে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। সব বিষয় জানতে চাইলে তো এক দিকে যেতে পারবে না। তোমাকে একমুখী হতে হবে। যে-কোন একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়কে এইম হিসাবে বেছে নিবে। এবং ঠিক ঐ এইম’কে টার্গেট করে এগিয়ে যাবে। তখন আর তোমাকে কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না।’
হ্যাঁ, আমি সেই সেদিনই আমার এইম ঠিক করেছিলাম এবং ওভাবেই চলার চেস্টা করি। টার্গেট ছাড়া কোন বিক্ষিপ্ত কাজ আমি করি না।
শেষটায় এবার আমার নিজস্ব জোতিষ পান্ডিত্ব নিয়ে কিছু বলি!
 
কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য।
একটু দেখুন তো আপনার ডান হাতের তালুতে কোথাও কোন তিল রয়েছে কিনা?
যদি না থেকে থাকে তাহলে আপনি কিছুটা দুর্ভগা।
 
আর যদি থাকে? তাহলে কাইন্ডলি এখনই একটু বাথরুমে যান। মিলিয়ে দেখবেন আপনার পুরুষাঙ্গে ও এক বা একাধিক তিল রয়েছে। আপনি সৌভাগ্যময় পুরুষ। আপনার পেছনে মেয়েরা মৌমাছির মতো দৌড়-ঝাপ করে। ঠিক বলছি তো?
 
নোট:
আমাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের ডান হাতের তালুতে কয়েকটা তিল রয়েছে। ওনি যখন জেলে আটক- একদিন বাইরে আদালতে হাজিরার জন্য যাচ্ছেন। লোক সমাগম দেখে তিনি তার ডান হাত বাড়িয়ে সবার দিকে হাত নাড়াচ্ছিলেন।
কোন এক বেরসিক সাংবাদিক তার সেই হাতের একটা ছবি তুলে ফেলেছিল।
ছবিটা প্রিন্ট করার পর ইত্তেফাকের নিয়মিত জোতিষ কলাম লেখক ভদ্রলোকের দৃস্টিতে বিষয়টা পড়ে যায়। তিনি তখন তিলের বিষয়টি ফাস করে দেন।
 
আর আমাদের এরশাদ কাকু তো ৮৬ বছর বয়সে- এখনও যথেষ্ঠ ইয়াং। মৌমাছির দল কিন্তু তাকে এখনও ফলো করে বেড়ায়।
   Send article as PDF