৩১২

আমি অনেক দেরীতে ঘুম থেকে উঠি।
এটা বাহাদুরী করার মতো কোন কথা নয়, কিন্তু এই বদঅভ্যাসটা আমি বাদ দিতে পারিনি।

ঘুমটা মাত্রই চোখে লেগেছে ঠিক তখনই বাসায় কলিং বেল এর শব্দ।
আমার বাসায় আমি সকালে যে কাউকেই আসতে নিষেধ করি, কেউ অন্তত পক্ষে সকালে আসে না। কিন্তু এমন সময় কে আসতে পারে! খারাপ করা মেজাজ নিয়ে গেট খুললাম। সুন্দর করে একটা সালাম দিলো রামিনটন ভাই। যাকে আমি এর আগে মাত্র ১দিনই দেখেছি।

রামিনটন ভাই আমার নাম্বার জানেন না, বাসার ঠিকানা তো জানারই কথা না।
তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটলো যে, তাকে এই সকালে আমার বাসায় আসতে হবে? নিশ্চয়ই অতি গুরুতর কোন বিষয়। দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি কি হতে পারে। আমি আর শাহীন ভাই দিল্লী থেকে ফিরে এসেছি। সেখান থেকে আপাতত গাড়ী আনা যাচ্ছে না। তাদের কাছে ৩১২ টি গাড়ী রয়েছে কিন্তু সেটা আনতে গেলে মুম্বই ডিআরটি থেকে আনতে হবে- অনেক জটিলসব ঝামেলা। খুব সহজে কোন সমাধান নেই। ওদিকে যদ্দুর অনুমান করতে পারি যে শাহীন ভাই রামিনটনদের কাছ থেকে অগ্রীম কিছু টাকা নিয়েছিল গাড়ীর জন্য। অনুমান করলাম সবটা নিয়ে কিছু বড় ঝামেলা হয়েছে।

লিভিং রুমে রামিনটন ভাইকে বসতে বলে আমি ফ্রেস হয়ে আসলাম।
‘বলেন রামিনটন ভাই। হঠাৎ আমাকে খুঁজে বের করতে হলো কেন?’ আমি সরাসরি পশ্ন করলাম তাকে।

‘ভাই। বড় একটা বিপদে পরে আপনাকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। আপনি ছাড়া অন্য কাউকে তো চিনিও না। তাই আপনি-ই আমাদের একমাত্র ভরসা এই বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য। আপনি আমকে ২০ মিনিট সময় দেন; আমি কথাগুলো বলেই চলে যাবো। পরে আমরা কথা বলবো।’ রামিনটন ভাই একটানা কথাগুলো বলে চললেন।

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে বলেন, কি জানতে চান?’
‘ভাই, দেইয়ু মেটিজ গাড়ীগুলোর কি অবস্থা? এলসি কি দিয়েছে?’ সরাসরি জানতে চাইলেন রামিনটন ভাই।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিলাম কোন তথ্য গোপন করবো না। যা সত্যি সেটাই বলে দিবো। কারণ শাহীন ভাইয়ের বিগত দিনের কাজকর্ম আমার ভালো লাগে নি। তাই কোন কিছু গোপন না করে সরাসরি বললাম, ‘গাড়ীর আশাটা বাদ দিয়ে দেন। কোম্পানী ব্যাংক্রপ্ট করেছে, ৫ হাজার কোটি টাকা। মুম্বই ডিআরটির হাতে ফাইল। ওদিকে মুল কোরিয়ান কোম্পানীর অবস্থাও খুব খারাপ। সম্ভবত আমেরিকার জিএম (জেনারেল মোটরস) কোরিয়ান দেইয়ু’কে কিনে নিবে। সবটা মিলিয়ে জটিল অবস্থা। আমরা খুবই ছোট মানুষ; ওসব ঠিকঠাক বুঝবোও না। তবে, এতটুকু বলতে পারি বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমরা এলসি করে কোন গাড়ী আনতে পারছি না।’ বলে শেষ করলাম।

আমার কথা শুনে রামিনটন ভাই মাথায় দু’হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন।
কোন কথা বলছেন না তিনি। যেন হতবাক হয়ে গেছেন। অনেকক্ষন পর বললেন, ‘ভাই, আপনি যে সব সত্য বলছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কি জানেন যে শাহীন ভাই কোথায় আছে?’ রামিনটন জানতে চাইলেন।

‘কেন, ইন্ডিয়া থেকে ফিরে তো তার বাড়ীতেই আছে; গতরাতেও তো আমার সংগে তার কথা হয়েছে।’ বললাম।
‘না ভাই। আপনি কিছুই জানেন না। শাহীন ভাই তার সেই ছোট বাসা ছেড়ে দিয়ে গাজী টাওয়ারে বড় একটা এপার্টমেন্ট নিয়েছে। আমরা যে ৩০ লাখ টাকা এডভান্স দিয়েছিলাম সব টাকা তো সে ঐ বাসা নিয়েই শেষ করে ফেলেছে। এখন আমরা টাকা ফেরত পাবো কিভাবে?’ হতাশায় নিমজ্জিত রামিনটন ভাই যেন বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন।

‘কি বলেন? আমি তো এর কিছুই জানি না! আসলেই তাই?’ আমি অবাক হয়ে গেলাম। এটাও সম্ভব?
‘জ্বি ভাই, আমি সব খবর নিয়ে এবং অনেক কষ্ট করে আপনার ঠিকানা বের করেছি। মামাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন আপনাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে, কথা বলতে। প্রকৃত তথ্য জানতে। মামার ধারণা আপনিই শুধুমাত্র আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।’ রামিনটন বলেই যাচ্ছে।

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছি আর ভাবছি! কি বলছে এরা!
মোবাইল নিয়ে শাহীন ভাইকে ফোন করলাম। ফোন রিসিভ করলেন তিনি। জানতে চাইলাম, ‘কোথায় শাহীন ভাই? কেমন আছেন?’

শহীন ভাই বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, ‘হ্যা পিয়াস ভাই সালামালিকুম। ভালো আছি, এতো সকালে? ঘুম থেকে উঠে গেছেন?’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘বাসা পরিবর্তন করেছেন নাকি? গাজী ভবনের কত তলায়?’
শাহীন ভাই যেন একটু হোঁচট খেলেন। একটু চুপ থেকে বললেন, ‘জ্বি ভাই আপনাকে আসলে বলা হয়নি। আমি তো ১৩ তলায় একটা এপার্টমেন্ট নিয়েছি, বুঝেনই তো কোকো ভাইয়া আসতে পারে যে-কোন সময় আমার বাসায়; তাই এটা নিলাম। ওদিকের প্রজেক্টের কথা তো সব জানেনই; ইনশাল্লাহ হয়ে গেলেই রামিনটনদের টাকা ফেরত দিয়ে দিবো।’

আমি আর কিছুই বললাম না, ফোন কেটে দিলাম।
রামিনটনকে বললাম, ‘ভাই, আমাদের একটা প্রজেক্টের কাজ চলছে, সেটা হলে, আশা করছি হয়ে যাবে, তারপর তিনি আপনাদের টাকা ফেরত দিবেন। তার আগে সে টাকা ফেরত দিতে পারবে না। তাকে মেরে ফেললেও সে টাকা ফেরত দিতে পারবে না। আমি যদ্দুর জানি- আপনাকে বললাম। এর বাইরে আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব না।’

রামিনটন মাথা নীচু করে রইলেন।
চা খেয়ে বিদায় নেবার আগে বললেন, আপনি কি আমাদের অফিসে এসে একটু মামার সংগে কথা বলতে পারবেন? যদি কিছু মনে না করেন? আর যদি যেতে না চান তাহলে মামা নিজেই আপনার অফিসে বা বাসায় আসতে চান। একটু কাইন্ডলি দেখা করবেন। মামার একটা আপনার মুখ থেকে বিস্তারিত জানা দরকার।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। আমি এখন ঘুমাবো। দুপুরের পর আপনাকে কল দিয়ে জানাবো। আপনার নাম্বারটা দিয়ে যান।’

বিকেলে আমি মামার অফিসে গেলাম। তিনি ইসরাফিল আলম। সদ্য নির্বাচন করে ফেল করেছেন। আমাকে হাত দিয়ে ধরেই বুকের সংগে জড়িয়ে ধরলেন। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বললেন, ‘বাবা, আমি তো রামিনটনের কাছে সবই শুনেছি তুমি যা যা বলেছো। এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন রাস্তা কি তুমি আমাকে দেখাতে পারো।?’

আমি সোজাসাপটা তাকে বলে দিলাম, ‘ওখান থেকে গাড়ী আনা যাবে না। তবে, যদি আপনার টাকার সংস্থান বা ব্যাংকের এরেজমেন্ট থাকে তাহলে ওখানে রেডী ৩১২টি গাড়ী রয়েছে। শাহীন যেহেতু অন্যায় করেছে, আমি আপনাকে ঐ ৩১২টি গাড়ী এনে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। আমার নিজের কোন টাকা নেই- আমি কোন টাকাও আপনার থেকে নিবো না, আপনাকে পুরো টাকা ডিআরটিকে পরিশোধ করতে হবে।’

মামা আমার থেকে বিস্তারিত শুনলেন।
তারপর বললেন, ‘কত টাকা লাগতে পারে?’
আমি জানালাম যে, ‘আনুমানিক ৫-ছয় কোটি রুপি’।
তিনি বললেন, ‘তাহলে টাকা জোগাড় করতে পারবো, তুমি ব্যবস্থা করো।’
আমি বললাম, ‘এখান থেকে ব্যবস্থা করা যাবে না। মুম্বই যেতে হবে। আপনি যেতে পারবেন?’
তিনি বললেন, ‘তুমি গেলেই হবে। তোামর উপর আমাদের ভরসা জন্মেছে। তুমি যা বলবে, আমরা তাই-ই করবো। অমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।’

মামা এরপর থেকে প্রতিদিনই আমার সংগে কথা বলেন ফোনে, তার অফিসে যাবার অনুরোধ করেন। রামিনটন আরও বেশী যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। শাহীন ভাইকে জানালাম বিস্তারিত এবং বললাম যে, ‘আমি কথা দিয়েছি ঐ ৩১২ পিস গাড়ী আমি তাদের আনিয়ে দিবো।’ শাহীন ভাইও আমাকে একই অনুরোধ করলেন যেন তাদের সাহায্য করি।

মুম্বই ডিআরটিকে ‘লেটার অব ইন্টারেস্ট’ হেডলাইনে একটা ইমেইল পাঠালাম ঐ গাড়ীর তথ্যসূত্র দিয়ে।

২ সপ্তাহ পর একদিন দেখি মুম্বই ডিআরটি থেকে আমার নামে একটি চিঠি। সেখানে আগামী মাসের ১৫ তারিখ আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ঐ ৩১২ টি গাড়ী এবং স্পেয়ার পার্টস এর অকশন হবে। ফাইন্যান্সসার ৫টি ব্যাংকের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকবেন। তাদের উপস্থিতিতে অকশন হবে। আমাকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

রামিনটনকে বললাম সবকিছু।
সে তো মহাখুশী। আমি তাকে বললাম, আমি একা যেতে চাচ্ছি না। আপনিও চলেন। কিন্তু রামিনটন ভাই বললো, ‘আপনি আর মামা যান। আমি গিয়ে কি করবো? মামা আর আপনি গেলেই সব ঠিক।’

অবশেষে তাই ঠিক হলো। ২ দিনের মধ্যেই ভিসা হয়ে গেল।
১২ তারিখে রাত ১০টায় আমরা মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার সোহাগ গাড়ীতে বেনাপোল এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। পরদিন সকাল ১১টায় এয়ারপোর্টের কাছে একটি হোটেলে মামাকে রেখে আমি চলে গেলাম নিউ মার্কেট। তখন ভারতে এয়ার ফ্লাইটে ভারতীয়দের জন্য ছিল অল্প ভাড়া আর বিদেশীদের জন্য ছিল প্রায় ডাবল ভাড়া। আমি নিউ মার্কেটের কাছে একটি পরিচিত ট্রাভেল অফিস থেকে দু’টো ভারতীয়দের জন্য কলিকাতা মুম্বই বিমানে টিকেট কিনলাম। তারপর হোটলে ফিরে গেলাম। দুপুরে লাঞ্চ শেষ করার পর আমরা একটু রেষ্ট নিবো। সন্ধ্যায় আমাদের ফ্লাইট।

ইসরাফিল মামা তার পকেটে কিছু ২০০ ডলার ছিল, আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমি এখানে ডান-বাম কিছুই চিনি না বুঝিও না। তোামার কাছে টাকা রাখো। আমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে। আমাকে ফেলে কোথাও যেন না; আমি কিন্তু হারিয়ে যাবো।’ বাচ্চাদের মতো অসহায়ভাবে কথাগুলি বললেন ইসরাফিল আলম।

ওনার কথায় আমি কোন শঠতা দেখিনি।
যাই হোক, রাত ৯টার দিকে আমরা মুম্বই ল্যান্ড করলাম। নিউ বেঙ্গলী হোটেলে ডাবল বেডের ডিলাক্স রুম পেলাম। রাতে ডিনার করলাম নীচেই একটা রেষ্টুরেন্টে। তারপর ঘুম।

মুম্বাই এর লোকজন সম্ভবত তিন বেলাই ‘ব্রেড’ খায়। ব্রেড মানে যেটাকে আমরা পাউরুটি বা বনরুটি বলি। অন্ততপক্ষে প্রথম মুম্বই সফরে আমার তাই-ই মনে হচ্ছিল। রাস্তায় প্রচুর ফল ও ফলের জুস বিক্রি হচ্ছে। আমরা সেসব খেলাম। তারপর দুপুরে খুঁজে একটা রেষ্টুরেন্টে ভাত মাছ খেলাম।

মামাকে বললাম, ‘আমি গেইট অব ইন্ডায়া দেখতে যাবো। চলেন ঘুরে আসি।’
মামা বললেন, ‘আমি যাবো না বাবা, তুমি যাও। ঘুরে আসো। বেশী দেরী কইরো না।’

যাই হোক, এক ফাকে মুম্বই ডিআরটি (ডেবট রিকভাী ট্রাইবুনাল) তে একটা ফোন করলাম। সরাসরি নাম্বার দেয়া ছিল। নিজের পরিচয় দেয়াতে ট্রাইবুনালের প্রধান নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন আমরা আসাতে তিনি খুশী হয়েছেন, কাল যেন ঠিক সকাল ৯টায় আমি পৌছে যাই।

মামাকে হোটেল রুমে রেখে আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ‘গেইট অব ইন্ডিয়া’ দেখতে। আগে থেকেই ম্যাপ দেখে রাস্তার নাম লিখে রেখেছিলাম। বিকেলের সময়টা ‘গেইট অব ইন্ডয়া’ দেখার জন্য চমৎকার সময়। আরব সাগরের তীরে মাথা উচুঁ করে দাড়িয়ে আছে যেন ‘গেইট অব ইন্ডিয়া’। (ঠিক অপজিটের নামকরা হোটেলটিতেই পরবর্তীতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল।) অনেকক্ষন হাঁটলাম একা একা; ঘুড়ে দেখলাম মুম্বই এর আসল সৌন্দর্য্য।

ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফেরা দরকার।
আমি আবারও হাঁটা ধরলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এবার রাস্তা ভুল করে ফেললাম। তারপরও ট্যাক্সি না নিয়ে নিজে নিজেই খুঁজতে লাগলাম কিন্তু কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে যাবো। টায়ার্ড রীতিমত।

হঠাৎ দেখি আমার বাঁদিকে একটি থানা।
সোজা থানায় ঢুকে গেলাম। হোটেলের বিজনেস কার্ড দেখিয়ে কর্তব্যরত ডিউটি অফিসারকে বললাম, ‘আমি হোটেল খুঁজে পাচিছ না। আমাকে একটু গাড়ীতে করে পৌছে দিতে পারবে?’

ডিউটি অফিসার আমার পরিচয় জানতে চাইলো।
বললাম, সেই সংগে এটাও জানালাম যে কাল ডিআরটি’তে আমার জরুরী মিটিং আছে। ইত্যাদি। ভদ্রলোক বেশ উৎসাহ পেলেন। চা অফার করলেন, আমি খেলাম না। একটু পর আমাকে পুলিশের গাড়ীতে করে হোটেলে পৌছে দিলেন।

ওদিকে, হোটেল রুমে ঢুকছি পরেই দেখি মামা রীতিমত ঘামছেন।
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কি সমস্যা?

মামা বললেন, ‘জানো বাবা তুমি যাবার পরপরই ১ জন পুলিশ এসোছিল। আমাকে কি সব উল্টা পাল্টা প্র্রশ্ন করেছে আমি কিছুই বুঝি না। পরে রিসিপ্টশনের বাঙালী লোকটাকে বলেছি পুলিশকে বলে দিতে যে আমার ভাগিনা ফিরবে রাতে; তখন যেন তারা আসে।’

আমি হেসে দিলাম। বললাম, ‘মামা, ইন্ডিয়াতে দিল্লী বা কলিকাতার বাইরে অন্য কোন শহরের কোন হোটেলে যদি বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে কেউ বোর্ডার হয়ে উঠে তাহলে পুলিশ একটা রুটিন চেকআপ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এটা ওদের রুটিন ওয়ার্ক, টেনশনের কিছুই নেই।’ মামা শান্ত হলেন।

যাই হোক, রাতে আবারও চেকআপ এর জন্য পুলিশ এলো এবং আমার সংগে কথা বলে চলে গেলো।

পরদিন কাটায় কাটয় সকাল ৯টায় ডিআরটিতে মিটিং শুরু হলো।
বাংলাদেশ থেকে আমি আর ইসরাফিল মামা, দিল্লী থেকে আরেকটি বায়ার এবং ৬টি ভারতীয় ব্যাংকের প্রতিনিধ (২ জন ছিলে এমডি, একজন প্রেসিডেন্ট আর ৩ জন ছিলেন জিএম। ব্যাংকগুলো ছিল ষ্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, আইসিআইসিআই, এক্সিম ব্যাংক, ইন্ডিয়ান ওভারসীস ব্যাংক, কানারা ব্যাংক ও আইডিবিআই ব্যাংক।)

ডিআরটি পরিচয় পর্ব শেষ করে সরাসরি অকশনে চলে গেল।
৩ কোটি রুপি থেকে দর হাকা শরু হলো এবং আমি ৫ কোটি রুপিতে সর্বোচ্চ দরদাতা হলাম। সব কিছু ঠিক ঠাক। কাগজপত্র লেখালেখি চলছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসরাফিল আলম মামা অত্যন্ত বোকার মতো একটি ভুল চাল চেলে দিলেন।

এতোক্ষন চুপ ছিলেন তিনি, কিন্তু হঠাৎ করে বলে ফেললেন যে, ‘আমরা তো বাংলাদেশ থেকে এতো টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতো পারবো না, তাহলে কি আমরা টাকার ব্যবস্থা কিভাবে করবো সেটা ঠিক করে আবার আসলে হয়?’

সব শেষ করে দিলেন ইসরাফি আলম মামা। আমি মামাকে ইশারায় বললাম আপনি চুপ থাকেন- আমি কথা বলি কিন্তু মামা খেয়াল করলেন না তিনি কথা বলতেই থাকলেন।
কিছু আলোচনা করে ডিআরটি আজকের অকশন বাতিল করে দিলেন। নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন, আগামী মাসের ২০ তারিখ আবারও অকশন হবে এবং তার আগে আমাদের টাকা কিভাবে জমা করবো সেটা লিখিত জানাবো।

মামাকে বললাম, ‘আপনি কেন এই কথাটা এখানে বলতে গেলেন? আমরা তো হাইয়েষ্ট বিডার হয়েইছি। বল আমার হাতে। আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খেলবো। আপনি টাকা জোগাড় না করতে পারলে আমি থার্ড পার্টির কাছে সেল করে দিবো। আমার ব্যবসা দরকার। এই গাড়ী ও পার্টস আমি ৭ কোটি টাকায় সেল করে দিতে পারবো। কিন্তু আপনি কেন ঝামেলা করতে গেলেন? এখন তো আর সহজে তা সম্ভব হবে না!’

মামা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, ‘বাবা আমি তো তা বুঝিনি। আমি ভেবেছি এই ৫ কোটি রুপি কিভাবে আনবো? আমি তো অতটা হিসাব করিনি, বুঝিওনি।’

মামার সরলতার জন্য কিছু বিরক্ত হলাম।
মামাকে নিয়ে মুম্বই তে তখনই আফ্র-এশিয়ান মোটরস এর অফিসে নিয়ে গেলাম। আগেই আমার সংগে অনলাইন এপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। তাকে বললাম, ৩১২ পিস গাড়ী ও স্পেয়ার পার্টস এর অকশন এর কথা এবং ৫ কোটি টাকায় আমি যে হাইয়েষ্ট বিডার হয়েছি সেটাও জানালাম। সে তাৎক্ষনাত আমাকে জানালো, ‘আমি পত্রিকায় বিস্তারিত পড়েছি। আমি তোমাকে ৬ কোটি টাকা দিবো- আমাকে দিয়ে দাও।’

মামা দেখি মাথা নীচু করে ফেললেন।
আমরা দেশে ফিরে আসলাম।

দেশে ফিরে দু’দিন বাদে আমি ভোলা যাবো, লঞ্চে উঠলাম। রাত সাড়ে ৮টার দিকে একটা ভারতীয় নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসিভি করলাম। একটি মেয়ের কন্ঠ। ‘তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস বলছেন? আমি দিল্লী থেকে অপর্ণা ব্যানার্জী বলছি। আপনার সংগে একটু পরিচিত হতে চাচ্ছিলাম। আপনি তো ঢাকার মোটরস ব্যবসায়ী। আমি ভারতীয় হলেও মুলত আমার বাবা বিক্রমপুরের মানুষ। আমি এখন দিল্লীতে একটা জব করছি। আপনার কার্ড দেখলাম, সেখান থেকে নাম্বারটি নিয়ে পরিচিত হবার জন্য ফোন করলাম।’

আমি বুঝে ফেললাম, খেলা শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু বল এখন আর আমার হাতে নেই। ডিআরটি যদি তখনই আমার হাতে হাইয়েস্ট বিডার এর ডকিউমেন্টটি তুলে দিতেন- তাহলে আমি মিনিমাম ২ কোটি টাকা প্রফিট করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়।

মেয়েটি এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কল দেয়া শুরু করলো।
অপর্ণা ব্যানার্জী প্রতিদিনই ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের ও আমার ব্যক্তিগত গল্প চালিয়ে যাচ্ছে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলছে। কখনও সে বাংলায় কথা বলছে কখনও ইংলিশে। আর আমি ওকে তালে তাল দিয়ে যাচ্ছি।

মাস খানেক এভাবে গল্প করার পর একদিন সে আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা, আগামী কুড়ি তারিখে তো তোমাদের অকশন হবে মুম্বইতে। তুমি আসছো তো?’
আমি বুঝলাম, এবার সে আসল জায়গায় এসেছে। বললাম, ‘হ্যা, অবশ্যই আসবো। ভিসাও করিয়ে ফেলেছি। প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

পরদিন অপর্ণা ব্যানার্জী আবারও ফোন করলো, ‘শোন পিয়াস, তোমাকে আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আমি তোমাকে ২৫ লাখ রুপি পাইয়ে দিবো। তুমি অকশনে আসবে না।’
আমিও সরাসরি বললাম, ‘আমি আসবোই। আমার ঐ ৩১২টি গাড়ী লাগবেই। কোন ভাবেই আমি গাড়ীগুলো হাতছাড়া করবো না।’

এরপর মেয়েটি আর সপ্তাহ খানেক আমাকে কোন ফোন করেনি।
এক সপ্তাহ পর, আমার ইনবক্সে একটি ইমেইল পেলাম। সেটাতে একটি খবরে কাটিং দেয়া, টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিউজ। সেখানে লেখা দেইয়ূ মোটরসের সমানে মারামারিতে ১ জন নিহত।

পরের দিন মেয়েটি আবারও আমাকে ফোন করলো। বলল, ‘তুমি কি করবে? তোমাকে কেন আসতেই হবে? আমি তো বলেছিই যে তোমাকে ২৫ লাখ রুপি পাইয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু শুধু কেন আসতে চাও। মুম্বইতে তোমার নিরাপত্তা কে দিবে?’

আমি বুঝলাম, থ্রেট দিচ্ছে।
মামাকে আর রামিনটনকে নিয়ে বসলাম। তারা ভয় পেয়েছে। শাহীন ভাইয়ের সংগে আলোচনা করলাম। শাহীন ভাই বললেন, ‘ভাই, কি দরকার এতো ঝামেলা মাথায় নেবার। বাদ দেন। যে ভুল মামা করে ফেলেছে- সেটা আর ফিরে আসবে না। এখন শুধু শুধু সময় নস্ট করে কি লাভ?’

সত্যি বলতে আমিও শাহীন ভাইয়ের বলা কথাগুলোই ভাবছিলাম।
এতো ঝামেলার কি দরকার। তারচে ভালো এসব বাদ দিই।

৩১২টি দেইয়ু ম্যাটিজ এর চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেললাম।

   Send article as PDF