ইসলাম, কোরাণ ও গণতন্ত্র

‘প্রতিষ্ঠিত হোক কোরাণের আলোকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা- যোগ্যতার মাপকাঠিতে চলুক সরকার।’
 
দিন কয়েক আগে সৌদী আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-শাসিত দেশগুলির রাজতন্ত্র ধ্বংশের কামনা করে একটা ছোট স্ট্যাটাসের শেষ লাইনের কামনা প্রকাশ করেছিলাম বাক্যটি দিয়ে।
 
আমি পজেটিভ ফিডব্যাক বেশী পাই এটা সত্যি কিন্তু সামান্য কয়েকজন পাঠক বিষয়টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।
 
একজন কমেন্ট করেছেন, ‘হা হা হা, কোরআন নিজেই রাজতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দাউদ (আ), সলেমান (আ), রানী বিলকিস, ইত্যাদি কি রাজতন্ত্র ছিল না? আল্লাহ কি কখনও রাজতন্ত্রকে অস্বীকার, খারাপ, নিকৃষ্ট বা নেগেটিভ হিসাবে কোরআনে উল্লেখ করেছে? এমন একটা আয়াত দেখাতে পাড়বেন? ইমাম মেহেদি কি গণতন্ত্র নিয়ে আসবে?’
 
আরেকজন বললেন, ‘আমি যতটুকু জানি, ইসলাম কখনও গনতন্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সম্মতি দেয় না।’
 
আরেকজনের কমেন্ট ছিল, ‘কোরানের আলোকে গনতান্ত্রিক সরকার ডা আবার কি জিনিস?’
 
ভিন্ন একটা কমেন্ট, ‘কোরআণের আলোকে গণতান্ত্রিক সরকার? জয় বাংলা শ্লোগান চলুক বিশ্বময়।
 
আরও একজন ভদ্রলোক পবিত্র কোরানের বেশ কয়েকটা আয়াতের তরজমার জেপিজি কপি পেষ্ট করে তাতে লিখেছেন, ‘আমরা যে গনতন্ত্র দিয়ে দেশ পরিচালনা করি ইসলামে তা হারাম ভাইয়া।’
সেই জেপিজেতে থাকা আয়াতগুলো ছিল,
– আপনি যদি অধিকাংশ লোকের কথা মানেন তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করে দেবে। আনআম (১১৬)
– অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্বেও মুশরিক। সুরা ইউসুফ (১০৬)
– বরং অধিকাংশ লোক জ্ঞানহীন। আনআম (৬১)
– কিন্তু অধিকাংশ লোক ইমানদার হবে না। সুরা হুদ (১৭)
– আর তাদের অধিকাংশই শুধু আন্দাজ অনুমানের উপর চলে। সুরা ইউনুস (৩৬)
 
আমার কিন্তু কোরাণ সম্পর্কে স্ট্যাডী যথেষ্ঠ না।
আমি এতো এতো রেফারেন্স কোরাণ থেকে দিতে পারবো না।
 
আমি শুধু তখনই কোরাণ পড়ি যখন আমি কোন সমস্যায় আটকে যাই এবং অনেকগুলো সোর্স থেকে জানার চেষ্টা করি প্রকৃত তথ্যটি কি হওয়া উচিত। তখনই সর্বপ্রথম আমি কোরাণ ঘাটি এবং এরপর অন্যান্য সম্ভাব্য উৎসে খোঁজ করি।
 
যেহেতু মনের কথাগুলিকে স্ট্যাটাস আকারে দেবার সময় আমি কোরাণের আয়াতগুলি নিয়ে ভাবনার চিন্তা করিনি এবং আমি আমার স্ট্যাডী, চিন্তা ও যুক্তির উপর ভরসা রাখি সেহেতু এরকম কমেন্টগুলি যে আসতে পারে সেটাও ভেবে রেখেছিলাম।
 
আমি ‘কোরাণের আলোকে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা’ চেয়েছি বলেই কমেন্টকারীরা তাদের আপত্তি জানিয়েছেন। অর্থাৎ তাদের ভাবনা ‘কোরাণ’ ও ‘গণতন্ত্র’ একসংগে যায় না।
 
আমার সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড তাই রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে তেমন একটা পড়াশোনা নেই। যতটুকু পড়ি নিজের কৌতুহল থেকে।
 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে কেউ কিছু বললেই তাকে বলতে শুনি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই বিষুদবার বিকেলের (১৯শে নভেম্বর ১৮৬৩) আমেরিকান সিভিল ওয়ার চলাকালের বিখ্যাত পেনসালভ্যানিয়ার গ্রীটিসবার্গ এড্রেসটি ‘Government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the Earth.’
 
একটা বিষয় একটু সতর্কতার সংগে লক্ষ্য করুন।
আমাদের দেশীয় পন্ডিতদের মুখে‘গণতন্ত্র’র সংজ্ঞা জানতে চাইলে এটুকুর বাইরে তেমন কিছু শোনা যায় না। আব্রাহাম লিংকনের মধ্যেই ‘গণতন্ত্র’কে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়।
 
বাস্তবতা হলো, এটা ছিল গৃহযুদ্ধত্তোর আমেরিকায় আব্রাহাম লিংকনের একটা দূরদর্শী ভাবনা। এবং এই ভাবনাটি আমেরিকায় আজ প্রতিষ্ঠিত, সত্য।
 
আমেরিকার প্রতিটি স্থানীয় সংস্থাই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন- তবে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
 
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও একজন- ‘কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত আইনের কাছে হাত-পা বাঁধা মহাশক্তিশালী লিডার’! এতটাই শক্তিশালী যে তার ‘এক্সিকিউটিভ অর্ডার’ গুলিও টেকসই হয় না- আঁটকে যায়।
 
এবং এটাই গণতন্ত্রেও সৌন্দর্য্য।
 
অর্থাৎ একজন ব্যক্তি, একজন মহাশক্তিশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিও আইনের ভেতরে আবদ্ধ। আইনের বাইরে যাবার কোন ক্ষমতাই তাকে দেয়া হয়নি।
 
তাহলে মানেটা দাড়াচ্ছে ‘সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রেসিডেন্টও আইনের হাতে আবদ্ধ। তিনি চাইলেই যা খুশী তাই করতে পারেন না। তাকেও আইনের মধ্যে থেকেই ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হবে, করতে হয়।
 
তাহলে সেই আইনটা কি?
কেনই বা সেই আইন? যা গণতন্ত্রকেও আটকিয়ে দেয়?
গেল আড়াইশত বছরের ইতিহাসে সেই সংবিধান একটি বারের জন্যও বিঘ্নিত হয়নি।
 
গেল বছর ফিলাডেলফিয়া’তে গিয়েছিলাম। আবার গেল সপ্তাহেও গেলাম। অতি পুরাতন ও চমৎকার একটা শহর। আমেরিকার বাস্তবিক অর্থে প্রথম রাজধানী ফিলাডেলফিয়া।
 
আমেরিকার ১০০ ডলার বিলে (কারেন্সী নোট) যে ভবনটি দেখা যায় সেটা ফিলাডেলফিয়াতে অবস্থিত, নাম ইন্ডিপেন্ডেন্স হল। আর ঠিক এই ইন্ডিপেন্ডেন্স হলের অপজিটেই রেয়েছে আরেকটি ভবন, নাম ন্যাশনাল কন্সিটিউশন সেন্টার।
 
এখানে বসেই আমেরিকার কন্সটিউশন নিয়ে আলোচনা, ডায়ালগ, মতামত ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরী হয়েছিল আমেরিকার সংবিধান।
 
হ্যাঁ। সংবিধান। আমেরিকারও একটা সংবিধান রয়েছে- সেই সংবিধানের অধিনে চলে আমেরিকা। আমেরিকার সংবিধান তার নিজ দেশে ‘গণতন্ত্র’কে করেছে শক্তিশালী, সমৃদ্ধ, মানবিক এবং সম-অধিকারের।
 
একটা শক্তিশালী সুন্দর ও পবিত্র সংবিধানই পারে একটা পরিচ্ছন্ন, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও স্বাধীন দেশের নিশ্চয়তা দিতে।
 
আসল বিষয়টা হলো- ‘গণতন্ত্র’ একটি সরকার বেছে নেবার পদ্বতি বই কিছুই নয়।
 
আর ‘সংবিধান’ হলো অবশ্য পালনীয় আইনসমূহ।
 
গণতন্ত্র যোগ্যকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়। সেই সরকার সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চালায়।
 
গণতন্ত্র ও সংবিধান দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
 
পবিত্র কোরাণ তেমনটি একটা জীবন-দর্শন বা সংবিধান। এই সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে।
 
এবং সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার নেতৃত্ব বাছাই করার অনেকগুলি উপায় বা পদ্বতি রয়েছে। যেমন: পারিবারিক উত্তরাধিকার। ডিক্টেটরশীপ বা সামরিক জবর-দখল করা সরকার, একনায়কতন্ত্র, একপরিবারতন্ত্র ইত্যাদি।
 
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ক্ষমতাসীন পরিবারগুলো রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রতে ক্ষমতার পালাবদল হয়। সেখানে গণতন্ত্র নেই।
 
আমি কমেন্টদাতাদের কাছে জানতে চাচ্ছি- পবিত্র কোরানের ঠিক কোথায় বলা হলো গণতান্ত্রিক সরকার চলবে না?
পবিত্র কোরানে ঠিক কোথায় রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে?
 
একজন, রাজা দাউদ (আ) বা রাজা সুলায়মান (আ) এর প্রসংগ টেনেছেন। আপনি কি জানেন যে মুহাম্মদ (সা) এর আগমনের সাথে সাথে পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবকে বাতিল করে কোরাণকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে- যদিও সেসব আসমানী কিতাবেও কোথাও ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা নেই।
 
এবার আসুন গণতন্ত্র নিয়ে আমার শেষ কথায়।
মুহাম্মদ (সা) কিন্তু স্রেফ একজন নবী বা রাসুল ছিলেন না। তিনি শুধুই একটা ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন বা নন শুধুমাত্র একজন আধ্যাত্মিক গুরু।
 
মুহাম্মদ (সা) ছিলেন পবিত্র কোরাণকে সংবিধান করে গঠিত আরব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসডেন্ট। এবং মুহাম্মদ (সা) এর রাষ্ট্রটিও নির্বাচিত হতো সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে।
 
আর তাইতো আমরা দেখি মারা যাবার পূর্বে মুহাম্মদ (সা) কাউকেই তার উত্তরাধিকারী ঘোষনা দিয়ে যান নি। না- তার তার স্ত্রীদের বা মেয়েকেও ক্ষমতার মসনদের অধিকারী করা থেকে তিনি বিরত থেকেছেন।
 
তিনি জনমতকে শ্রদ্ধা করতেন।
আর জনমতকে শ্রদ্ধা করার অর্থই গণতন্ত্র।
 
আবারও বলছি ‘গণতন্ত্র’ হলো কিভাবে- জনসাধারণের সার্বিক ও নির্বিঘ্ন অংশগ্রহনে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত হবে সেই ধারণা এবং সংবিধান হলো রাষ্ট্র কিভাবে চলবে সেই শাসনতন্ত্র। মুহাম্মদ (সা) ছিলেন জীবন্ত কোরাণ। তার জীবনীতে কোথাও-ও আমি অগণতন্ত্র খুঁজে পাইনি। এবং প্রেসিডেন্ট ওসমান (রা) পর্যন্ত আমি গণতন্ত্র থেকে ইসলামকে এক চুলও বিচ্যুত হতে দেখিনি।
 
হ্যা, ইসলামী শাসনতন্ত্রে (সংবিধানে) স্বার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ সুবহানো ওতায়ালা- গণতন্ত্রে নন। গণতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রকে এক করে ফেলবেন না।
 
মুহাম্মদ (সা) এই পৃথিবীতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
আরব রাষ্ট্রে মুহাম্মদ (সা) যে আমলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সেই আমলে ইওরোপে, বা চায়না, এই ভারতীয় উপমহাদেশে, জাপানেও রাজাদের শাসন চলতো। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাও ছিল না। জমিদারী বা রাজতান্ত্রিক শাসন উচ্ছেদ করে মুহাম্মদ (সা)ই প্রথম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে যান।
 
মুহাম্মদ (সা) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে- তিনি মারা যাবার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট আবু বকর (রা) যিনি খলীফা হিসাবেই পরিচিত, তিনি কিভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন? কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওমর (রা) বা প্রেসিডেন্ট ওসমান (রা)?
 
গণতন্ত্রের উপস্থিতি ছিল বলেই- আলী (রা) এবং মুয়াবিয়া (রা)র সংগে ক্ষমতা দখলের বিরোধ সৃষ্টি হতে পেরেছিল।
 
ওটাই ছিল গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য।
এবং সেই গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হতো পবিত্র কোরানের আলোকে।
 
এবার কে কে বলবেন ইসলাম গণতন্ত্রকে সমর্থন করে না?
এবার কে কে বলবেন কোরাণের আলোকে গণতান্ত্রিক সরকার হয় না?
 
পশ্চিমা সভ্য রাষ্ট্রগুলিই ইসলাম থেকে আরোও অনেক বিষয়ের মতোই গণতন্ত্রকেও গ্রহণ করে নিজেরা আরও সুসভ্য হয়েছে- যেটা হতে পারেনি ইসলামী রাষ্ট্রগুলি। আর তাইতো আজ দেখা যায় যত হানাহানি সব মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতেই; যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিডিলইষ্টার্ণ কান্ট্রিজ।
 
আমেরিকা-ইউরোপ বা অষ্ট্রেলিয়ানরাও গণতন্ত্র গ্রহন করেছে ইসলাম থেকেই। ইসলাম কারো থেকে গণতন্ত্র শিখেনি। তবে আজকের কথিত মুসলিমরা এতটা নির্লজ্জ বোকামীতে ডুবে রয়েছে যে- তারা নিজেদের সমৃদ্ধ ইসলান থেকে শিক্ষা গ্রহন না করে বরং ‘গণতন্ত্র’কেও পর্যন্ত পশ্চিমা আবিস্কার হিসাবে প্রচার করে তার নিন্দে করছে! ধিক এসব সস্তা মুসলিমদের।
 
শেষটায় একটা কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ‘অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্বেও মুশরিক। সুরা ইউসুফ (১০৬); বরং অধিকাংশ লোক জ্ঞানহীন। আনআম (৬১)।
 
শেষটায় আরেকটা কথা বলে যাচ্ছি আর তাহলো মুহাম্মদ (সা) শুধুমাত্র ‘গণতন্ত্র’র প্রতিষ্ঠাতাই নন; তিনিই প্রথম ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত করে এবং সেটাও সেই ৬০০ শতাব্দীর কথা।
 
কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি সুসভ্য ইউরোপিয়ানরা এই সেই দিন ১৬০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত ক্রীতদাস প্রথাকে মারাত্মকভাবেই জিইয়ে রেখেছে; আমেরিকায় আমদানী ও ব্যবসা করা হয়েছে ক্রীতদাসদের নিয়ে।
   Send article as PDF