প্রসংগ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি

আমার মাথায় অনেকদিন যাবৎই এই প্রশ্নটা ঘোরপাক খাচ্ছে যে, ‘স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি’ কথাটার মানে কি?
 
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে।
 
এরও প্রায় ২২/২৫ বছর আগে বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত, এবং পাকিস্তান নামের অদ্ভৎ একটি দেশের জন্ম হয়েছিল। ১৫০০ মাইল দুরে দুটি আলাদা ভূখন্ড কিভাবে একটি দেশ হতে পারে অন্তত ভারতীয় উপমহাদেশীয় মানসিকতায়- সেটাই তো আমার মাথায় আসে না।
 
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ যখন দ্বিখন্ডিত হয় তার আগে বৃটিশ গভর্ণমেন্ট চাচ্ছিলেন হিন্দুদের জন্য ভারত, মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান তৈরী হবে। এবং সেই সংগে অবিভক্ত বাংলা এবং অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশদু’টি যদি গনভোটের মাধ্যমে চায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে থাকবে অথবা সংখ্যা গরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে পাকিস্তান অথবা ভারতে যুক্ত হবে।
 
প্রস্তাবনাটি সুন্দর ছিল।
মজার বিষয়টি হলো কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ বিষয়ে একমত ছিলেন। তিনি চাননি যে অবিভক্ত বাংলা বা পাঞ্জাব অথবা বিভক্ত বাংলা বা বিভক্ত পাঞ্জাব ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পাকিস্তান বা ভারতবর্ষে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত হোক। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গণমানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
 
কিন্তু মারাত্মকভাবে বাঁধ সাধেন মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু আর প্যাটেল। মুলত এই তিনজনের গোড়ামীর কারণেই বাংলা এবং পাঞ্জাবকে বিভক্ত হয়ে বাধ্যতামূলকভাবে দু’টি রাষ্টের মধ্যে বিলীন হতে হয়েছে।
 
 ‘অদ্ভৎ ও ভৌতিক রাষ্ট’ পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান একদিন বাংলাদশে হবে এটাই ছিল বাস্তব ও যুক্তিযুক্ত বিষয়। শুধু প্রয়োজন ছিল সময়ের। ৭১ এ সেই সময়টা আসে এবং নয় মাসের গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সফলতা আসে ও বিজয় অর্জিত হয় আমাদের।
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারিগর বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষ।
আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে অাগরতলা বা কলকাতায়, শেখ মুজিব জাতিকে কোন দিক নির্দেশনা দেবার প্রয়োজনও বোধ করেন নি; তার ফ্যামিলিকে ঢাকায় পাকিস্তানীদের জিম্মায় নিরাপদে রেখে করাচীর জেলে বন্দী।
 
শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর ও পুলিশের ম্যাক্সিমাম বাঙালী অফিসার ও সেপাহীরাই সহায়ক শক্তি হিসাবে ছিল সাধারণ গেরিলা মুক্তযোদ্ধাদের। আমাদের কোন বিমান বা কামানও ছিল না শত্রুকে মোকাবেলা করার; কিন্তু আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে ছিল- আর শুধুমাত্র দেয়ালে পিঠ ঠেকে থাকার জন্যই বাঙলার দামাল ছেলেদের কাছে পরাজিত হয়েছিল পাকিস্তান আর সংগে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগীতা।
 
ফরটি সেভেনে কিছু বেকুব বাঙালী নেতারা পাকিস্তান তৈরীতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। আবার সেভেনটি ওয়ানেও কিছু বেকুব, শুধু বেকুব নয় এগুলি ‘বেকুব দা গ্রেট’ বা জাতীর কুলাঙ্কার সন্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাও করেছিল।
 
যাই হোক; আমাদের দেশটা স্বাধীনতা অর্জন করল।
 
তারপর আর প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পার হয়ে গেছে। ঐ বেকুব, কুলাঙ্গার গুলি তাদের ভূল বুঝতে পারলেও ‘ব্যক্তিগত সভ্যতার অভাবে’ মাথা নিচু করতে চায় না; কিন্তু ঠিকই আবার বিদেশে বসবাসের সুযোগ থাকা সত্বেও দেশেই প্রতিস্ঠা পেতে চায়।
 
আসল বিষয়টা হল- দেশপ্রেম।
আসলে দেশ তো মা’র মতো।
 
একজন মানুষ যতই অসভ্য হোক না কেন, তার ভেতরে তার মায়ের প্রতি ভালবাসা থাকবেই। তদ্রুপ দেশের প্রতিও ভালবাসাটি প্রাকৃতিকভাবেই আসে। মানুষ শত চেষ্টা করলেও তার নিজ জন্মভূমি বা যেখানে সে বড় হয়েছে, তার শৈশবের হাজার স্মৃতি, প্রতিবেশী, স্কুলের বন্ধু, নদী, ধানক্ষেত, কাচা রাস্তা, গ্রামের মেলা, নৌকা বাইচ- এসব কোন ভাবেই ভুলতে পারে না; ভোলা সম্ভব নয়; আর এটাই হল দেশপ্রেম। কিন্তু এই প্রকাশটা ভিন্ন; সবাই একভাবে তা প্রকাশ করতে পারে না।
 
একদল খালি পায়ে হেঁটে মনে করে এটাই দেশ প্রেম দেখানো সবচে বড় মাধ্যম, আরেকদল গলাবাজি করে দেশপ্রেম জাহির করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে দেশটাকেই কিভাবে লুটে-পুটে খাবে সেই ধান্ধায় থাকে। অন্যের দোষ ধরতেও প্রচুর আনন্দ পায় এরা, নিজেরটা ভুলে।
 
প্রকৃত দেশপ্রেমীরা এসবের ধারও ধারে না। তারা পারলে নীরবে চেষ্টা করে দেশের জন্য, দেশের অভাগা সন্তানদের জন্য কিছু করতে, না পারলে- না পারার বেদনায় আহত হয়।
 
একজন পিতার সবগুলি সন্তান একরকম হয় না, হাতের পাঁচটি আঙ্গুলও কখনও সমান হয় না। কিন্তু সকলকে মিলেই চলতে হয়। সকলকে মিলেই এগিয়ে যেতে হয়।
 
একটি দেশে জন্মগ্রহনকারী প্রতিটি মানুষই সেই দেশের সন্তান। পাকিস্তানের করাচীতে অনেক বাঙালী ওদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানী হয়ে বসবাস করছে। আবার বাংলাদেশেও অনেক পাকিস্তানী উর্দূভাষী বাংলাদেশী হিসাবে স্থায়ী হয়ে গেছে। প্রতিটি মানুষের চিন্তা একরকম নয়, হতে পারে না।
যুক্তির মধ্যে থেকে কেউ কথা বলতে না পারলেই গালাগালি করে।
 
এটাই বাস্তবতা এবং মানুষের একটি চরিত্র।
এই দেশটা সকলের।
 
৭১ এর মুক্তিযোদ্ধার যতটুকু অসভ্য রাজাকারগুলির অধিকার ঠিক ততটুকুই। দেশকে ভাল না বাসলে কেউ-ই এদেশে বসবাস করতো না। বাংলাদেশ থেকে লাখো লাখো হিন্দু ভারতে চলে গেছে, ভারত থেকে লাখো লাখো মুসলিম পাকিস্তানে চলে গেছে; আবার এর ব্যতিক্রমও আছে। যার যেখানে ভাল লাগবে, যার যেটা পছন্দ সে সেটাই করবে। বাংলাদেশকে ভাল না বাসলে কেউ বাংলাদেশে বসবাস করতো না। কামারুজ্জামান বা গোলাম আজমেরও অনেক অনেক সুযোগ ছিল বৃটেনে নাগরিকত্ব নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করার। তারা কেন ডাষ্টে-ভড়া বাংলাদেশে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিয়েছেন? কারণ ঐ একটাই- দেশের প্রতি ভালবাসা। আর এরা কুলাঙ্গার না হলে দিনের মধ্যে ৫বার করে এদেশের দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতো; কিন্তু চায়নি।
 
ভাল মন্দ নিয়েই মানুষ এবং তার পৃথিবীর প্রতিিটি দেশেই বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এরকম অসংলগ্ন দেশপ্রেমিক আমি অন্তত পৃথিবীর কোথাও দ্বিতীয়তা দেখিনি। আসল সত্যটি হল- অন্য দেশের মানুষ কাজের মধ্যে মত্ত থেকে তাদের নিজ নিজ দেশটাকে এগিয়ে নিতেই ব্যস্ত। আর, আমাদের এসব তথাকথিত দেশপ্রেমিক বা স্বাধীনতার স্বপক্ষ বলে দাবীদার ভন্ডরা অন্যকে গালিগালাজ করে দেশপ্রেম জাহির করে এবং একবার ক্ষমতা হাতে পেলে দেশটার বারোটা বাজিয়ে দেয়; ক্ষমতা থেকে আর নামতে চায় না। এটাও কি দেশপ্রেম?
 
সমগ্র জাতি স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি।
 
যে-যার অপাধের শাস্তি পাবে, ভাল কাজের ফল অর্জন করবে।
 
‘স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি’ কথাটার মানেটা আমি আজও বুঝলাম না। কোথায় স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি?
কিভাবে?
কোন স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে কার কি লাভ?
 
১৫০০মাইল দূরের পরমানু শক্তিধর পাকিস্তান কি এতটাই উম্মাদ দেশ যে তারা এখন আবার নতুন করে অন্য কিছু ভাববে? বা ভাববার সময় কি তাদের আছে?
 
হ্যা, ভাবতে পারে একমাত্র ভারত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তাদের পায়ের নীচে রাখতে তারা সব-সময়ই সচেষ্ঠ; কখনও বড় ভাই পরিচয়ে, আবার কখনও আগ্রাসী হিসাবে। আর এই ভারতের পক্ষের মানুষগুলি অবশ্যই স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষ এবং এরা কারা তা বাংলাদেশের সকলেই জানে। কিন্তু সবচে মজার বিষয় হলো- এরা-ই অপরকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি’ বলে গালি দিয়ে মজা পায়।
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৌলবাদীদের হাতে অনিরাপদ নয়; তবে ভারতের হাতে অনিরাপদ।
 
এবং এদের পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় ‘র’র লোকাল এজেন্ট এবং বাম ও আওয়ামী ঘরণার লোকেরা। এরা ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশকে রক্ত-লাল করে দিতে একপাও পিছনে হাটে না; ভারতের স্বার্থই এদের কাছে সবার আগে।
 
সবশেষে একটা কথা- ডিম আগে না মুরগী আগে যেমন একটি অপ্রয়োজনীয় তর্ক, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা বিরোধী বা স্বপক্ষ শক্তির তর্কটিও কিছু লোভী, স্বার্থপর বা মহাচতুরের গলাবাজী ছাড়া কিছু নয়- শুধুমাত্র নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য।
 
আর যদি স্বাধীনতা বিরোধী খুঁজতেই হয়- তাহলে পরিস্কারভাবেই দেখা যাচ্চে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি; এই দলটি ভারতের সেবাদাস এবং এই স্বাধীনতা বিরোধী আওয়ামী লীগকে সমূলে নির্মূল করার মধ্যে দিয়েই দেশবিরোধী ও দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের উৎপাটন করাটা ফরজ।
   Send article as PDF