এপিঠ-ওপিঠ

হুমায়ূন সাহেবের জোছনা ও জননীর গল্প পড়ছিলাম।
 
আয়েশা বেগমের বড় ছেলের নিজের মুখের কিছু কথা পড়লাম,
“মা ক্রমাগত কাঁদছেন। কারণ খবর পাওয়া গেছে, পাক মিলিটারি আমার বাবাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই জাফর ইকবালকে। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দু’জনই রাইফেল নিয়ে প্রচুর ছোটাছুটি করেছি। ভেবেছি, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলে মিলিটারিদের আটকে দেয়া যাবে। বাস্তবে তা হয় নি। তাদের একটা দল মার্চ করে ঢুকেছে পিরোজপুর শহরে। শুরু হয়েছে ধ্বংস এবং হত্যার উৎসব।
 
আমরা তখন পলাতক। প্রথমে যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিপদজনক মানু হিসেবে আমাদের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আশ্রয়দিলেন গোয়ারেখার জনৈক মাওলানা। তিনি সর্ষিনার পীর সাহেবের ভক্ত খাদেম। মনে প্রাণে পাকিস্তানি। পাকিস্তান যাতে টিকে যায়, সেই দোয়া তিনি প্রতি নামাজেই করেছেন। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মা’কে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন, জোর গলায় বলছন- কোন ভয় নাই। মিলিটারি আপনার ছেলেদের ধরতে পারবে না। উপরে আছেন আল্লাহপাক, নিচে আমি। আমাকে গুলি না করে তারা আপনার ছেলেদের গুলি করতে পারবে না।”
 
যাই হোক, মাওলানা সাহেব কিছুদিন দুই-ভাইকে রাখার পরে এবং মিলিটারি আক্রমন বেড়ে যাবার পর- ভয়ে ‘এই দুইভাইকে’ আরও বেশী নিরাপত্তা দেবার জন্য সর্ষিনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায় নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে কোনভাবেই এই দুই-ভাইয়ের কোন ক্ষতি না হয়- তারা লুকিয়ে থাকতে পারে।
 
“মা বললেন, আপনার হাতে আমি ছেলে দু’টোকে তুলে দিলাম। আপনি যা ভালো মনে করেন …।
 
আমরা দু’ভাই লুঙি-পাঞ্জাবি পরলাম। মাথায় দিলাম গোল বেতের টুপি। রওয়া হলাম সর্ষিনা। …”
 
কিন্তু সর্ষিনার পীর সাহেব তাদের দুই-ভাইকে তার মাদ্রাসায় রাখতে রাজী হলেন না।
 
হুমায়ূন আহমেদ সাহেব প্রচন্ড কস্ট পেয়েছিলেন। প্রচন্ড কস্ট। সেই কষ্টের ঝাল তিনি মিটিয়েছেন তার মুখবন্ধের শেষ প্যারায়।
 
“১৯৮০ সনে, মুক্তিযুদ্ধের ন’বছর পর, মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম- স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে সর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
 
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?”
 
আচ্ছা- সেদিন যদি সর্ষিনার পীর সাহেব হুমায়ূন ভাতৃদ্বয়কে তার মাদ্রাসায় স্থান দিতেন- তাহলে কি হুমায়ূন সাহেব এই ‘দুঃখ’টুকু প্রকাশ করতেন আজ?
 
দু’জন দামড়া ভাই যারা ২০/২২ বছরের দুর্দান্ত যুবক, দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হাতে কয়েকটা গুলিভরা রাইফেল ও পিস্তল- তারা মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, একজন আবার যাত্রাবাড়ীতে গর্ত করে লুকিয়েও থাকে- তাদের মুখে সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে একটুও আনন্দ নেই!
 
শেইম হুমায়ূন আহমেদ, শেইম হুমায়ূন সাহেব!
বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ- যিনি আমারও অসম্ভব প্রিয় একজন লেখক; কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে এরা আমার প্রিয় হতে পারলো কৈ?
 
আসলে যে মানুষটা যে কাজটা সবচে ভালো করতে পারে- তার সেটাই করা উচিৎ।
নিজের শৈল্পিক ক্ষমতার বাইরে যাওয়াটা অন্যায়- এতে তার প্রকৃত চরিত্র উম্মোচিত হয়ে পরে এবং যেটা দেখতে কখনওই সুন্দর হয় না।
 
ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব যদি শিক্ষকতাই করতেন- তাকে সুন্দর লাগতো; তার ভেতরের নোংড়া চরিত্র ও মানসিকতটুকু আমাদের দেখার সুযোগই হতো না। শ্রদ্ধা অম্লান থাকতো।
 
তসলিমা নাসরিন খুব ভালো কবিতা লিখেন- তিনি গল্পকথা লিখতে দিয়ে নিজের ভেতরের নোংড়ামীগুলো শুধু শুধুই উম্মুক্ত করে দিয়েছেন।
 
নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুছ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসাটা অত্যন্ত ভাল বুঝেন; রাজনীতিতে নাম লিখতে গিয়ে তিনি নিজেকে খামাকোই নীচে নামিয়ে নিয়ে এসেছেন।
 
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধটা বেশ ভাল করতে পারেন- রাজনীতিতে নামার পর তার অসুন্দর ও নীচু প্রবৃত্তির মানসিকতায় আমরা লজ্জা পাই; উনি নিজে লজ্জা পান না।
 
শেখ মুজিবর রহমান নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বড় মাপের একজন রাজনৈতিক সংগঠন, বিশাল হৃদয়ের নেতা- মানুষকে ভালবাসতে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু ক্ষমতাসীন শেখ মুজিবর রহমান শুধুই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার-হত্যাকারী, লোভী-একনায়ক, ক্ষমতালিপ্সু এবং একজন অত্যন্ত বাজে প্রশাসক।
 
সেভেনটিওয়ান এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পায়; কিন্তু যখনই তারা সার্টিফিকেট, সরকারী কোটা আর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবী নিয়ে সামনে আসে- তখন আর সেই শ্রদ্ধাগুলো ঠিক-ঠাক কাজ করে না।
 
নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও নন্দিত কবি, লেখক। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় তার বিকৃত মানসিকতাপূর্ণ আচরণ তার প্রকৃত চরিত্র সামনে নিয়ে আসে।
 
আসল সত্যটি হলো- আমরা ঠিক যতটুকু, তার একচুল বাইরে যাওয়াও ঠিক না।
   Send article as PDF