নোয়াখাইল্যা

নোয়াখাইল্যাদের নিয়ে সোসাল মিডিয়াতে প্রচুর ট্রল হতে দেখি।আমি আমার লাইফে প্রথম একজন নোয়াখাইল্যা দেখি যখন আমি প্রাইমেরী স্কুলে পড়ি।
আমাদের গ্রামে একজন মধ্যবয়স্ক লোক মাঝে মধ্যেই দেখা যেত। তার মুখের ভাষা বা কথা বলার ঢং আমাদের মতো না। একটু কেমন যেন! ঠিক ঠাক বুঝতে পারি না আমরা। তিনি ঠিক কি করেন সেটাও অজানা।
কিন্তু লোকটাকে নিয়ে আমাদের বেজায় কৌতুহল ছিল।তারপর দীর্ঘদিন তাকে দেখেছি আমাদের এলাকায়। কোথায় থাকতেন, কি করতেন- তার কিছুই জানা হয়নি কোনদিন। তবে এতটুকু বুঝতাম যে তিনি আমাদের গ্রামেরই আশেপাশের কোন গ্রামে হয়তো থাকতেন। এবং তিনি নোয়াখাইল্যা।
এবং তিনিই ছিলেন- আমার কৈশরে প্রথম দেখা কোন মানুষ যিনি ‘অচেনা’।
তারপর দিন তো অনেক গেল।নোয়াখাইল্যা শব্দটি কেমন যেন একটু বাঁকা শোনায়।মানুষ নোয়াখাইল্যা বলতে একটু ‘দৃষ্টিকটু’ হিসাবেই দেখে- যেটা আমার চোখে পরেছে।
ঢাকায় যখন ব্যবসা শুরু হলো; আমার বয়সও তখন অনেক কম। আমার ১৪-গোষ্ঠীতে কোন ব্যবসায়ী নেই বললেই চলে। আমার বাবাও আমার ব্যবসায় সম্মতি দেননি। অনেকটা অবাধ্য হয়েই আমি ব্যবসায় নামি।
যাই হোক, ঢাকায় যখন ব্যবসা শুরু করি- সেটা ছিল টেলিকম ও ইন্টারনেট নির্ভর ব্যবসা সেই ২০০০ সালের দিকে। তখনও হাতে হাতে মোবাইল বা ইন্টারনেট আসেনি। গণফোন এর ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ভিওআইপি প্রযুক্তি তখন সবে যাত্রা শুরু করেছে এবং আমি তখন এই ব্যবসার মোটামুটি ‘বস’। তাছাড়া টেলিকম ব্যবসাটা আমাকে বেশ টানতোও।
ব্যবসা শুরু করার পর প্রথম দিকে পরিচিতিদের সংগে ব্যবসা করতে গিয়ে দেখলাম, তারা আমাকে ব্যবসায়ী হিসাবে কোন পাত্তাই দিচ্ছে না- ভাবছে বিপদে পরা একজন মানুষ বুঝি!
আমি যা বোঝার বুঝে ফেললাম।তারপর আমার নিজের মতো করে পথ চলা শুরু করি।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর থেকে দেখতে পেলাম নোয়াখাইল্যাদের লাইন পরে গেছে আমার অফিসে। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিন-ই আমার অফিসে নোয়াখাইল্যারা আসতে শুরু করে দিলো। একটা অদ্ভুৎ কারণে তাদেরকে আমার ভালোও লেগে গেলো।
ব্যবসা শুরু হলো, আমি আবিস্কার করলাম নোয়াখাইল্যারা সাহসী। তারা ঝুঁকি নিতে জানে। তারা বুদ্ধিমান। মাথা এবং শরীর- দুটোই তারা খাটাতে জানে। তারা যথেষ্ঠ চতুর।
এবং তারা ডেসপারেটও। যেটা আমি একজন ব্যবসায়ীর সবচে বড় গুন হিসাবে বিবেচনা করি।
ব্যবসায়ের কারণে আমি বেশ কয়েকবার বৃহত্তর নোয়াখালীতে গিয়েছিও, থেকেছি নোয়াখাইল্যাদের বাড়ীতে, খেয়েছি। আপ্যায়িত হয়েছি। তারা অতিথিদের সম্মান করতে জানে।
এলাকাটাও বেশ সুন্দর। বিশেষ করে লক্ষীপুর এলাকাটা আমার বেশ পছন্দ। সড়ক পথে ভোলা যাবার উদ্দেশ্যেও আমি বেশ কয়েকবার মজু চৌধুরীর ঘাট দিয়ে ফেরী পারাপার হয়েছি- এলাকাটা আমার বেশ ছিমছাম মনে হয়েছে।
যাই হোক, ব্যবসার একটা পর্যায়ে চায়না যাওয়া শুরু করলাম। ওহ, এর মধ্যে আমার সংগে বেশ কিছু নোয়াখাইল্যার সংগে আন্তরিক সম্পর্কও হয়ে গেলো। তার মধ্যে একজন চায়না থেকে রেডীমেড গার্মেন্টস ইমপোর্ট করবে। আমি তাকে চাইনিজ ভিসার জন্য ইনভাইটেশন লেটার করিয়ে দিলাম। সে আমার খরচের চেয়েও খুশীতে ১০ হাজার টাকা বাড়তি নিয়ে এসে হাজির।
যাই হোক, আমি সাধারণত স্যাংহাই ও বেইজিং যেতাম ব্যবসার জন্য। একবার আমার গোয়াংজু যাবার প্রয়োজন হলো। লক্ষীপুরের সুমন ভাই (এখন ফিলিপিন্সে ব্যবসা করে) আমাকে সানেআলীর একটি এড্রেস ও লোকেশন দিয়ে দিলো- সেখানে বাংলাদেশী পরিবেশে থাকা-খাওয়ার সুবিধে। চায়নাতে আমাকে ম্যাকডোনাল্ড বা কেএফসি আর লোকল চাইনিজ হাবিজাবি খেয়ে দিন কাটাতে হতো।
সানেআলীতে সেই গেষ্ট হাউজটির খোঁজ পেয়ে যেন স্বর্গ পেলাম হাতে।এবং, সেই গেষ্ট হাউজটির মালিক-কর্মচারী সবই দেখলাম নোয়াখাইল্যা। তারা খুবই আন্তরিকতা দেখালো থাকা-খাওয়ায়। আমি তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ।
আস্তে আস্তে আমাকে সেনজেনও যেতে হতো। সেখানেও নোয়াখাইল্যাদের গেষ্ট হাউজ পেয়ে গেলাম। এরাও বেশ আন্তরিক। অনেক নোয়াখাইল্যার সংগে পরিচয় হলো যারা চায়নার সংগে ব্যবসা করে, এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সংগে আমার কিছু ব্যবসাও হলো।
আমি দ্বার্থহীনভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশে ব্যবসায়ী হিসাবে সিটাগং এর লোকদের পরই নোয়াখাইল্যাদের অবস্থান। এরা সাহসী।
আর ব্যবসায়ী হিসাবে আমি সবসময়ই সিটাগং এর লোকদের খুবই সমীহ করে চলি। এরা এক কথার মানুষ, কলিজাটাও বেশ বড় সাইজের। এদের সংগে ব্যবসা করে যে আনন্দ পাওয়া যায়- তার বাংলাদেশের অন্য কোন জেলার মানুষের সংগে পাওয়া যায় না।
যাই হোক, কুনমিং এও নোয়াখাইল্যাদের দেখেছি ব্যবসা করছে। সুমন ভাইয়ের কথা বলছিলাম, একবার চাইনিজদের গাফিলতি তে সে ৪০ ফিট এক কনটেইনার মালে বিরাট ধরা খেয়ে পথে বসে যায়। যাই হোক, বেশ কয়েক বছর কস্ট করার পর (তাকে একটি মুহুর্তের জন্যও হাল ছেড়ে দিতে দেখিনি) সে ফিলিপিন্সে লেডিস আনডারগার্মেন্ট ও টিশার্ট সাপ্লাই শুরু করে। বর্তমানে তার বিশাল অবস্থা।
এরকম আর অনেক নোয়াখাইল্যাকে আমি আমার চোখের সামনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি শুধুমাত্র পরিশ্রম করে। অসীম ধৈর্য্য ও সাহসের সংগে কস্টকে মোকাবেলা করে সামনে এগুতে দেখেছি।
ঢাকায়, আমার ধারণা সবচে বেশী সংখ্যক লোক দেখা যাবে যারা নোয়াখাইল্যা।
শুনেছি (দেখেছিও) ছোট ছোট কিশোররাও নোয়াখালী থেকে ঢাকায় চলে আসে শুধুমাত্র জীবনটাকে পুজি করে। তারপর কোন একটা দোকান বা কারখানায় লেগে যায়। কাজ শিখে একদিন নিজেই মস্ত বড় কারিগর হয়ে উঠে। আমি এদের সম্মান করি।
অথচ, এই নোয়খাইল্যাদের নিয়ে ‘ট্রল’ এর কোন অন্ত নেই।তাদের ভাষাটা আমাদের কাছে অসুন্দর। হয়তো আমাদের ভাষাটাও তাদের কাছে অসুন্দর। এটা তো কোন ‘কারণ’ হতে পারে না।
আর একবার বেইজিং এ (চেংগুরি রেষ্টুরেন্টে- এটা বিখ্যাত বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট যার মালিক একজন আমেরিকান বাংলাদেশী) পরিচয় হলো এক নোয়াখাইল্যার সংগে। আমার পরিচয় পেয়ে সে জানালো যে সে একজন ছাত্র। পড়াশোনা করে শ্যানডং এর জেনান ইউনিভ্যার্সিটিতে। আমাকে খুব করে অনুরোধ করলো তার ভার্সিটিতে অতিথি হতে, যদি আমি শ্যাংডন যাই। একবার তারও অতিথি হয়েছিলাম। বুঝেছি এদেরও কলিজার সাইজটা বেশ বড়ই।
নোয়াখাইল্যাদের বড় একটা অংশ ওসেন-গোয়িং শীপে চাকুরী করে, সেখান থেকে পালিয়ে আমেরিকায় ঢুকে পরে। নোয়াখাইল্যাদের বড় একটা সংখ্যা বিভিন্নভাবে জাহাজে বা দুর্গম ব্রাজিল, মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় চলে আসে। অসংখ্য নোয়াখাইল্যা নিউ ইয়র্কে ব্রুকলিনে দেখা যায়।
আরও একটা বিষয়, নোয়াখাইল্লারা একে-অপরকে যতটা সাহায্য-সহযোগীতা করে, অন্য কোনো জেলার (বৃহত্তর সিলেট ব্যতীত) অথবা এলাকার লোকদের মধ্যে এই গুন খুব একটা দেখা যায় না।
কিছু খারাপ তো আছেই, ওটা সব জায়গাতেই আছে। ঢালাওভাবে কখনওই সবাই খারাপ না, ঢালাওভাবে কখনওই সবাই ভালোও না। কিন্তু ম্যাক্সিমাম বা মিনিমাম বলে তো একটা কথা আছে- না কি?
বাংলাদেশের সবচে সাহসী, সবচে চতুর, সবচে কর্মঠ, এবং সবচে ধৈর্য্যশীল ও মেধাবী লোকেরা জন্ম নেয় নোয়াখালীতে। এরা অত্যন্ত পরিশ্রমী।
আর আমি পরিশ্রমীদের ভালোবাসি। স্যালুট নোয়াখাইল্যাদের।

   Send article as PDF