রিকয়েল

ব্যবসা হলো এমন ‘বিষয়’ যে, আপনাকে তা থেকে প্রফিট বের করে না আনা পর্যন্ত শক্ত করে কামড় দিয়ে ধরে, লেগে থাকতে হবে। কখনওই মাথা গরম করা যাবে না। মাথা খুব ঠান্ডা রেখে খেলতে হবে।

একদিন সন্ধ্যায় আমার অফিসে আহমেদ নামের একজন (ভদ্র!)লোক আসলেন।

নিজের পরিচয় দিলেন একজন ওয়েল্ডার হিসাবে এবং সেই সংগে একজন কারখানা মালিক হিসাবেও। জানালেন যে তার একটি কেবল (তার) তৈরীর কারখানা রয়েছে। আমাকে সে ওখানে নিয়ে যেতে চায়, তার ফ্যাক্টরী দেখাতে।

আমি বুঝলাম, আমার কিছু এক্সক্লুসিভ সাহায্য তার দরকার।
রাজী হয়ে গেলাম। ওই সন্ধ্যাতেই আমি তাকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। ড্রাইভার নূর ইসলাম কে সংগে নিলাম। লোকটির বাড়ী আমাদের দোহারে বলেই সে পরিচয় দিয়েছিল এবং সেজন্যই সংগে সংগে যেতে রাজী হয়েছিলাম।

নূর ইসলাম গাড়ীতে অপেক্ষায় থাকলো আমি আহমেদ এর সংগে তার কারখানায় ঢুকলাম। ছোট একটা কারখানা। ভেতরে ৩/৪ জন কর্মচারী। তারা ম্যানুয়েলি ইলেকট্রিক তার তৈরী করছে। দেখতে খারাপ লাগছে না। সে আমাকে আপ্যায়ন করলো। তারপর রাতে বাসায় ফিরে আসলাম।

পরদিন সকালেই সে আবারও আমার অফিসে এসে উপস্থিত।
আমি অবশ্য আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম যে সে আবারও আসবে- কিন্তু এতো সকালেই চলে আসবে সেটা অনুমান করিনি। বুঝলাম, তার খুব তাড়া আছে।

তাকে আমার চেম্বারে নিয়ে বসলাম। সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘আহমেদ সাহেব, বলেন ঠিক কি প্রয়োজন আপনার, আমি শুনবো।’

তিনি বললেন, ‘আমার কিছু প্রডাক্ট দরকার। আমি আসলে একজন অত্যন্ত দক্ষ ওয়েল্ডার। আমি হরিপুর ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দের কিছু কাজ করি কন্ট্রাক্টে। ওদের সকল ওয়েল্ডিং আমি করে দিই। আমাকে ওরা হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যায় ওদের বিভিন্ন প্লান্টে।’

‘আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু আপনার কি প্রডাক্ট দরকার, সেটা বলেন।’ জানতে চাইলাম।

আহেমদ পকেট থেকে একটা লিষ্ট আমাকে বের করে দিলো। হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিছু ওয়েল্ডিং ইকুইমেন্ট, কিট আর টুলস নিবে। সে আমার কাছে ওইসব আইটেমগুলো চাচ্ছে।

আমি তার কাছে জানতে চাইলাম যে ঠিক কোন দেশের তৈরী প্রডাক্ট আপনার দরকার?

জবাবে আহমেদ জানালেন যে, ‘সিংগাপুর বা কোরিয়ান হলে ভালো হয়।’

আমি তার কাছে ৭ দিন সময় চাইলাম।
৭ দিনের মধ্যে আমি তাকে সবগুলোর প্রাইস জানাতে পারবো বলে জানালাম।

১০/১২টার মতো আইটেমস ছিল। আমি ৪/৫ দিনের মাথায়ই সবগুলো আইটেম এর সাপ্লায়ার রেডী করে ফেললাম ও প্রাইস নিলাম। তারপর আহমেদকে ডাকলাম আমার অফিসে।

আহমেদ আসলো। তাকে জানালাম যে, সিংগাপুরেই সব পাওয়া গেছে। তাকে প্রাইস দেখালাম। তখন বাংলাদশে অক্সিজেন কোম্পনী মুলত এইসব আইটেমগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। এবং আমি যেই প্রাইস দিয়েছিলাম, অক্সিজেন এর প্রাইস ছিল তারচেও প্রায় ৮/১০ গুন বেশী। আহমেদ এর মাথা প্রায় খারাপ হবার অবস্থা।

সে আমাকে তার সংগে ব্যবসায় পার্টনার হতে অনুরোধ জানালো। আমি রাজী হলাম না, আমি বললাম, ‘আমি আপনাকে মাল এনে দিবো, আপনি একটা মার্জিন আমাকে দিবেন। পার্টনার আমি হবো না।’

তখন সে আমাকে প্রস্তাব দিলো তাহলে তাকে যেন আমি সিংগাপুরে নিয়ে যাই, আগামী সপ্তাহে আমরা সিংগাপুুরে যাবো। আমি রাজী হলাম। সে প্রায় ১২ বছর সিংগাপুরে ওয়েল্ডার হিসাবে জব করেছে এবং ওখানকার ভাষাও জানে বলে জানালো।

এক ফাঁকে সে আমার কাছে সিংগাপুরের কোম্পানীগুলো কোটেশন এর কপি চাইলো। আমি প্রথমে দিবো না বলে ভেবে আবার কি কারণে যে মত বদল করে দিয়ে দিলাম। সে আমাকে তার পার্সপোট বের করে দেখালো এবং বলল যে টিকেটের টাকা নিয়ে সে কালই আসবে তখনই পাসপোর্টও দিয়ে যাবে ভিসা করানোর জন্য।

পরদিন সে আর এলো না।
ফোন করে জানালো টাকা রেডী করতে পারেনি। কয়েকদিন সময় লাগবে।

আমি একটা টেকনিক সবসময় এপ্লাই করি আমার যে-কোন ক্লায়েন্টদের সংগে। সেটা হলো, আমি কখনওই কোন ক্লায়েন্টকে ফোন করি না।
আমি বিশ্বাস করি, ক্লায়েন্ট এর যদি সত্যি সত্যিই প্রয়োজন থাকে- তাহলে সে নিজেই আমাকে ফোন করবে। আমি নিজে ফোন করলে তার কাজের চাহিাদা মোটেও বাড়বে না। সুতরাং আমি নীরব থাকলেই বরং ভালো।

তাকেও ফোন করলাম না।
১ সপ্তাহ পর সিংগাপুর থেকে একটি কোম্পানী আমাকে ইমেইল পাঠালো যে, ‘তোমার লোক আহমেদ আমাদের অফিসে আজ সকালে এসেছিলো’।

আমি যা বোঝার তা বুঝে নিলাম।
বাংলাদেশে এমনটাই হয়। সকলেই ওভারটেক করে কাজ করে, একা লাভ খেতে পছন্দ করে। আমার পূর্বেও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু তারপরও অমি এসবকে পাত্তা দিই না। আমি বিশ্বাস করি, আমার জন্য যা বরাদ্দ আছে সেটা আমি পাবোই। আর সংগে যে বিট্রে করবে- আমি যদি ধৈর্য্য ধরে থাকি তাহলে সেটার সুন্দর প্রতিশোধ এর সময় আমি পাবোই। আর তখনই আমি আসল খেলাটা খেলবো।

আমি চুপচাপ থাকলাম।
প্রায় ২ সপ্তাহ পর, আহমেদ আমাকে একদিন ফোন করলো। আমার সংগে দেখা করতে চায়। আমি আসতে বললাম। সে আসলো।

মাথা নীচু করে কথা বলছিল, তোর ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করছে আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কিছুই না বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সে এক পাতার একট্র ফটোকপি ব্রশিয়র নিয়ে এসেছে আজ।
আমার হাতে দিয়ে বলল, এটার নাম রিকয়েল। আমার এই রিকয়েলটা দরকার। কেউ এটা দিতে পারছে না। আমি অক্সিজেন এ গিয়েছিলাম। তারাও খুঁজে পাচ্ছে না।

আমি ব্রশিয়রটি নিলাম। হাতে নিয়ে কিছুই বুঝলাম না। তাকে বললাম, ‘এটা দিয়ে কি করে?’

সে জানালো, ‘এটি একটা রিকয়েল কিট। পাওয়ার প্লান্টের বয়েলার ওয়েল্ডিং করার সময় থ্রেড প্রয়োজন হয় ওয়েল্ডিং নিখুত করার জন্য।’ আমি ওর উত্তরটি মন দিয়ে শুনলাম। এবং কতগুলো লাগবে তা জানতে চাইলাম।

সে জানালো ৭৮টি রিকয়েল কিট লাগবে। প্রতিটিরই ভিন্ন ভিন্ন সিরিয়াল আছে। আমি তাকে চলে যেতে বললাম এবং আগামী ৭ দিন পর আসতে বললাম।

রিকয়েল কিট নিয়ে প্রচুর খোঁজাখুজি করলাম অনলাইনে কিন্তু কিছুই পেলাম না।

যাই হোক, পরে ওয়েল্ডিং এবং থ্রেড নিয়ে একটু স্ট্যাডী করলাম এবং ৪/৫ দিনের মাথায় কিছু খুঁজে পেলাম। এবং বুঝতে পারলাম কেন বাংলাদেশে কেউ এটা খুঁজে পাচ্ছে না।

এখানে একটা বিষয় বলে রাখি।
বাংলাদেশে এই ধরণের কীটগুলো পাওয়া যাবার কথা নয়, কারণ এসব কোন জেনারেল প্রডাক্ট নয়। যাই হোক, অন্য যে-কোন কিছুই আপনি যদি ঢাকায় খুঁজে না পান, তাহলে আপনার দ্বিতীয় বাজার হবে কোলকাতা, সেটাতে না পেলে যাবেন মুম্বই। ওখানে ফেল করলে আপনাকে যেতে হবে হংকং। আর যদি হংকং এও না পান, তাহলে শেষ ভরসা আমেরিকা- যেখানে পাবেনই।

তবে, আমি যেহেতু অনলাইনে খুঁজি সেহেতু আমাকে কোথাওই যেতে হবে না। অফিসে বসেই আমি পেয়ে যাবো। সেটা যত কঠিন বা জটিল আইটেমই হোক না কেন।

এই রিকয়েল থ্রেড কিটটিও আমি পেয়ে গেলাম ৭ দিনের মাথায়।
আমি পেলাম নিউ ইয়র্কের একটা কোম্পানীর কাছে। আমি ৪টি স্যাম্পল হিসাবে নিতে চাইলাম, সিরিয়াল নাম্বার দিলাম। নিউ ইয়র্কের কোম্পানীটি আমাকে জানালো যে, ৪টি কীটের দাম পরবে ৩৮ ডলার। আর শিপিং খরচা আমাকে দিতে হবে।

সমস্যা হয়ে গেলো ঐ ৩৮ ডলার দেয়া নিয়ে।
বিপদেই পরে গেলাম, কাউকেই পাচ্ছি না যে ৩৮টি ডলার নিউ ইয়র্কে আমাকে দিয়ে হেল্প করবে। ২০০৬ সালেও আমার প্রিমিয়াম ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড ছিল যেটা দিয়ে আমি অনলাইনে কেনা কাটা করতে পারতাম; তাছাড়া আমার কাছে চাইনিজ দু’টি ব্যাংকের কার্ডও ছিল, ছিল চাইনিজ পে-পল। কিন্তু ওই কোম্পানী কার্ড দিয়ে বা পে-পলে টাকা নিবে না। তাকে তার একাউন্টে টাকা জমা করতে হবে।

আমার ইনকামিং ফেডএক্স একাউন্ট ছিল।
আমি একাউন্ট নাম্বারটি ওদের দিলাম এবং টাকার জন্য আমি চেষ্টা করছি বলে ওদের জানালাম। কিন্তু ৩৮টি ডলার জমা করাতে পারলাম না কাউকে দিয়েই। নিউ ইয়র্কে আমার অসংখ্য অত্মীয়-স্বজন ছিলো, আমি কখনওই তাদের হেল্প নিই না; তবুও ২জনকে রিকোয়েষ্ট করেছিলাম কিন্তু তারা ব্যস্ত।

যাই হোক, টাকা পাঠাতে ব্যর্থ হলাম।
ঠিক তখনই একদিন এ কোম্পানীটি আমার কাছে জানতে চাইলো যে, তোমার মোট কতটি কিট লাগবে? আমি জানালাম ৭৮টি।

কোম্পনীটি আমাকে ফিরতি ইমেইলে জানালো যে, ঠিক আছে, তোমাকে ৩৮ ডলার পাঠানো নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি তোমার ফেডএক্স একাউন্টে ৪টি ফ্রি স্যাম্পল শিপ করে দিয়েছি। আমি তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

পরবর্তী ৪ দিনের মাথায় স্যাম্পল আমার অফিসে চলে এলো। ফেডএক্স কাষ্টমস বাবদ ৬ হাজর টাকা নিলো।

এরপর আমি আহমেদকে ফোন করলাম, জানতে চাইলাম যে, ‘এই মালামাল গুলোর দাম কেমন?

আহমেদ জানালো এগুলি তো অনেক দামী আইটেম, তাছাড়া কোথাও পাওয়াও যাচ্ছে না। কাজেই একেকটা ২ – আড়াই লাখ টাকা করে তো হবেই।

আমি আহমেদকে বললাম, ‘৯ লাখ টাকা নিয়ে আসেন। আমি ৩টি স্যাম্পল আনাবো, ৩ দিন সময় লাগবে আপনি আমাকে টাকা দেবার পর।’

আহমেদ ওদিনই ৯ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে এলো।
আমি টাকা নিয়ে ওকে রিসিপ্ট দিয়ে দিলাম এবং সংগে সংগে ৩টি স্যাম্পল ওর হাতে দিলাম। সংগে সংগে স্যাম্পল খুলে সে দেখলো মালগুলি একিউরেট। তার তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার দশা। বারবার বলতে লাগলে, ‘ভাই কিভাবে আপনি পারলেন?’

আমি শুধু বললাম যে, ‘আপনি যদি আমার সংগে বিট্রে করে সিংগাপুর চলে না যেতেন- তাহলে এই কাজটা আরও জলদি হয়ে যেত।’

আহমেদ বুঝতে পারেনি যে ওযে আমাকে ফাঁকি দিয়ে সিংগাপুর থেকে মাল নিয়ে এসেছে- সেটা আমি কিভাবে জানতে পারলাম। শুধু মাত্র নত করে বলল, ‘আমি ভুল করেছি, ক্ষমা চাই।’

আমি হেসে দিলাম। কিছুই বললাম না।
৩/৪ দিন পর আহমেদ আবারও এলো। তার ৭৫টি রিকয়েল কিট লাগবে। অর্ডার করতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম যে আহমেদ এর সংগে ব্যবসা করবো না।

আমি যে ৪টি স্যাম্পল আনিয়েছিলাম, তা থেকে আহমেদকে ৩টি দিয়ে বাকী ১টা আমি আমার ম্যানেজারকে দিয়ে হরিপুরে আগেই ফোনে যোগাযোগ করে পাঠিয়েছিলাম। এবং বলেছিলাম যে ৩টি স্যাম্পল আহমেদ নিয়ে যাবে এবং আমি আহমেদকে আর কোন মাল দিবো না। ও আমার সংগে বিট্রে করেছে। তোমরা যদি চাও আমি তোমাদের বাদবাকী ৭৫টি থেড কিট আনিয়ে দিবো। সংগে ওদেরকে আমার নিজের করা প্রাইস কোটেশনও দিয়েছিলাম।

হরিপুর আমার থেকে ৭৫টি কীট সরবরাহ করার ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দিল।

এটাই হলো ব্যবসা।
এবং ব্যবসা এভাবেই করতে হয়।

   Send article as PDF