বিশাল জগৎ

নিউ ইয়র্কের মাটির নীচে একটি বিশাল জগৎ রয়েছে।
জগৎটি সত্যি আমাদের কল্পনার চেয়েও বিশাল।
 
সবাই এটাকে বলে সাবওয়ে। মাটির নীচ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে- এমনটা বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশের বড় শহড়গুলিতেই রয়েছে; ঢাকাতেও নাকি কাজ চলছে বা চলবে। আমি নিজে বিশ্বের প্রায় ১৫ বা ১৬টি সাবওয়েতে ভ্রমণ করেছি যার মধ্যে অন্যতম কলকাতা, হংকং, সেনজেন, স্যাংহাই, বেইজিং, কুয়ালা লামপুর, দিল্লী ইত্যাদি।
 
কিন্তু সত্যি বলতে কি, নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে’র বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।
 
ভারতের পশ্চিম বংগের রাজধানী কোলকাতা শহরে ৩টি বড় ট্রেন ষ্টেশন রয়েছে। তারমধ্যে সবচে বড় হাওড়া। শিয়ালদহ এবং চিৎপুর বা কোলকাতা ষ্ট্রেশনও এক্কেবারে ছোট নয়; অন্তত ঢাকার কমলাপুরের চেয়েও অনেক বড়। হাওড়া, দিল্লী, মুম্বাই, লক্ষৌ, গৌহাটি, পুনে ট্রেন ষ্টেশন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বহুবার। হংজু থেকে স্যাংহাই পর্যন্ত ৫০৩ কিলোমিটার স্পীডে বুলেট ট্রেনেও চড়েছি।
 
কিন্তু নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে সিষ্টেম! ওহ মাই গড, এ যে সত্যিই কি বিশাল এক জগৎ তা ভাবতেও কষ্ঠ হয়।
 
স্যাংহাই থেকে ওয়েজূ শহরে আমি বাসে করে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেছি। ৮/৯ ঘন্টা সময় লাগে। তার মধ্যে বেশ কিছুটা রাস্তা একটা খড়স্রোত নদীর দু’পার দিয়ে লম্বা-লম্বীভাবে (এপাড় ওপাড় নয়) চলে গেছে। পুরোটাই ব্রীজ, কখনোবা পাহাড়ের নীচ দিয়ে বিশাল বিশাল টানেল। আমার মনে হয় দৈঘ্য দেড় দুইশ কিলোমিটারের কম হবে না। চমকে উঠেছিলাম চাইনিজদের কান্ড কারখানা দেখে। বেইজিং থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত বিশ্বের সবচে উচ্চতম রেললাইন- সেটাও এক ভয়াবহ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। উচ্চতা মোবাবেলায় সেখানে যাত্রীদের জন্য অক্সিজেন মাক্সও রেডী থাকে।
 
অবশ্য আফসোস, এখনও বেইজিং থেকে মস্কো পর্যন্ত ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে যাত্রী হাবার সুযোগ পাইনি- পাবো নিশ্চয়ই একদিন।
 
কিন্তু নিউ ইয়র্ক সাবওয়ের কাছে কোনকিছুকেই আমি তুলনায় আনতে পারছি না।
মাটির নীচ দিয়ে ৩৪টি লাইনে ৪৬৯টি ষ্টেশনে প্রতিদিন প্রায় ৬ মিলিয়নের বেশী যাত্রী চলাচল করে- এবং সর্বমোট লাইনের দৈর্ঘ্য ৩৭৫ কিলোমিটার এবং সম্পূর্ণ টা-ই নিউ ইয়র্ক সিটির মাটির নীচে অবস্থিত (অল্পকিছু স্কাই লাইন বাদে)।
 
ম্যানহ্যাটন হলো নিউ ইয়র্কের প্রধানতম সিটি অথবা ম্যানহ্যাটনকেই অফিসিয়ালি নিউ ইয়র্ক সিটি বলা হয়। ম্যানহ্যাটন এর বাইরে আরও ৪টি বরো রয়েছে (কুইন্স, ব্রঙ্কস, স্যাটান আইল্যান্ড ও ব্রকলীন। কুইনস, ব্রঙ্কস ও ব্রকলীন বরোগুলি সব ট্রেনই ম্যানহ্যাটন বেইজড। ম্যানহ্যাটন একটি ছোট দ্বীপ (অবশ্য নিউ ইয়র্ক সিটির একমাত্র ব্রঙ্কস ই মেইনল্যান্ড আমেরিকার অংশ; বাকী সবটুকুই দ্বীপ); এখানেই বিশ্বের সবচে ব্যস্ততম শহড়। একপাশে হাডসন রিভার এবং পুবে ইষ্ট রিভার। মোট ১২টি এভিনিউ এবং এর মধ্যেই প্রায় ৬টি ভিন্ন ভিন্ন ট্রেন লাইন, বলতে গেলে- সবসময়ই আপনার চোখে সামনেই পড়বে অন্তত একটি সাবওয়ে ষ্টেশন।
 
নিউ ইয়র্কে রাস্তাঘাটে তেমন একটা মানুষ দেখা যায় না। শুধু গাড়ী আর গাড়ী। কিন্তু সাবওয়ে ট্রেনে (৮টি বিশাল বগি সমৃদ্ধ) ভীড় অত্যন্ত লক্ষনীয়; সীট পাওয়া সত্যিই মুশকিল, মানুষ আর মানুষ। এবং সবাই ব্যস্ত।
নিউ ইয়র্ক সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র শহর যেটা ২৪ ঘন্টাই সজাগ। বাস, ট্রেন সবকিছুই ২৪ঘন্টা সচল, ২৪ ঘন্টাই কর্মব্যস্ত। এখানে রাস্তা পিক টাইম ভোড় ৪টায় শুরু হয়। ম্যানহ্যাটনে কার পার্কিং পাওয়া ভাগ্যের বিষয়; তাও ঘন্টা প্রতি ভাড়া কমবেশী ১৫ থেকে ২০ ডলার। অবশ্য নিউ ইয়র্ক বাসীর গাড়ীর কোন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না; সবৃত্রই রয়েছে ট্রেন অথবা বাস সার্ভিস।
 
ঝড়, বৃষ্টি, ব্লেজার্ড, তুষার, স্নো কোন কিছুতেই নিউ ইয়র্ক শহড় এতটুকু বন্ধ থাকে না। যেই আমি জীবনে কোনদিন ‘ভাব নষ্ট হবে বলে’ বাংলাদেশে কোনদিন ছাতাই ব্যবহার করিনি, সেও কিনা মোবাইল এপসে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে ছাতা নিয়েই বাসা থেকে বের হই।
 
ম্যানহ্যাটনের ব্রডওয়েতে কিছু বাংলাদেশী দোকানদার একটু বৃষ্টি হলেই ২ ডলারের একটি ছাতা ১০ ডলারে বিক্রি করে।
নিউ ইয়র্ক বা পুরো আমেরিকা সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য দিই- আমেরিকাতে পণ্যের কোন নির্দিষ্ট মূল্য নেই বা মূল্যের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ আপনি আপনার স্বাধীন ইচ্ছামত যে কোন পণ্য যে কোন মূলে ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারবেন। তবে, দুটি বিষয় আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে-
১) কোন ভেজাল, নকল বা অবৈধ পণ্য দোকানে রাখা যাবে না।
২) পণ্যের গায়ে মূল্য লেখা থাকতে হবে।
অর্থাৎ, শুধুমাত্র ভাল পন্যই আপনি বিক্রি করতে পারবেন, তবে যে-কোন দামে।
তো, গেল বছর ম্যানহ্যাটনে এক বাংলাদেশী ষ্ট্রিট দোকানদার ১ ডলারের একটি বার্গার এক বিদেশী ক্রেতার (পর্যটক) কাছে ৩৬ ডলারে বিক্রি করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম হয়েছিলেন।
 
নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাটে নিউজ স্ট্যান্ড থাকে- যা ভাড়া নিয়ে নিউজ পেপারের নামে মুল্য পানি, ক্যান্ডি ইত্যাদি বিক্রি হয়। আরও রয়েছে জারোয়া গাড়ী বা খাবার গাড়ী এবং ফুটপাতে কিছু দোকান দেখা যায় যেখানে ফল-মূল বিক্রি করা হয়। মজার বিষয় হলো- এসব ব্যবসায়ীর ৯০% ই বাংলাদেশী অল্প কিছু রয়েছে আরাবিয়ান ও পাকিস্তনীর দখলে। তবে, এসব ষ্ট্রিট দোকানগুলি সিটি থেকে বার্ষিক হিসাবে ভাড়া নিতে হয়। অবৈধ কোন দোকান নেই।
 
ম্যানহ্যাটনকে ব্রকলীন ও কুইন্সের সাথে যুক্ত রাখতে সব মিলিয়ে প্রায় ১২টি আন্ডারপাস ও ব্রীজ তৈরী করা হয়েছে যা দিয়ে ট্রেন এবং বাস, কার চলাচল করে।
 
আন্ডারপাস গুলি সাগরের নীচ দিয়ে চলে গেছে। একটু ধারণা দিই কতটুকু নীচ দিয়ে- এফ ট্রেনের ল্যাক্সিনটন-৬৩ ষ্ট্রিটের ট্রেন থেকে নেমে উপরে উঠতে মোটামুটি ২০ তলা সমপরিমান এক্সিলেটরে চড়তে হয়। এবং এগুলি সবই তৈরী হয়েছে আজ থেকে আরও ১১৫ বছর আগে।
 
ম্যানহ্যাটনের ফোরটি সেকেন্ড ষ্ট্রিট মোটামুটি আরেকটি জগৎ। গ্রান্ড সেন্ট্রাল থেকে টাইমস স্কোয়ারে যেতে চলছে স্যাটল ট্রেন এবং সেভেন ট্রেন।
এতো সামান্য বললাম- ট্রেন ট্রানজিট সম্পর্কে। এছাড়াও এই ম্যানহ্যাটনেই রয়েছে প্যাথ ট্রেন, লংআইল্যান্ড রেল লাইন, নিউ জার্সি ট্রেন ষ্টেশন এবং পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল এবং এমট্রাক বা লং ডিষ্টেন্স ট্রেন লাই; সবই মাটির নীচে; মাটির উপরে রয়েছে শুধুমাত্র হাজার হাজার আশি নব্বই তলা অট্রালিকার ছড়াছরি।
 
আমেরিকায় প্রায় তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশী বসবাস করে এবং তন্মোধ্যে নিউ ইয়র্কেই সম্ভবত দুই লক্ষ বাংলাদেশী রয়েছে। এসব বাংলাদেশীদের সম্পর্কে আমি কোন একসময় জানাতে চেষ্টা করবো। তবে আজ একটি ছোট ঘটনা শেয়ার করছি।
 
ডালাসে থাকাকালীন একটি ঘটনা।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ফ্রিজে ডিম নেই, অপরদিকে বাসায় মেহমান। আমার বাসা থেকে সবচে কাছের দোকানটির দুরত্ব প্রায় আড়াই মাইল। কি আর করা, আড়াই মাইল রাস্তা হেটে কুগার চেইন ষ্টোরে গেলাম। ৩ ডজন ডিম নিলাম। ২৪ ঘন্টর দোকান কুগারে সকাল ৯টার আগে কোন সেলস এর লোকজন থাকে না; মেশিনে মূল্য পরিশোধ করতে হয় নিজেকেই। আমি এক হাতেই ৩ ডজন ডিম; এক ডজন করে মেশিনে রীড করাবো, হঠাৎ এক ডজন ডিম আমার হাত থেকে পড়ে গেল নীচের ফ্লোরে। এবং যা হবার তা-ই হলো। অর্থাৎ ভেংগে গেল। আমি হকচকিত এবং কিছুটা বিব্রত।
 
মুহুর্তেই দেখলাম কালো একটি মেয়ে আমার সামনে এসে উপস্থিত। সে দ্রুত, প্যাকেটটি তুলে নিল, টিসু্ দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলল। এবং হাসি মুখে আমাকে বলল, সরি, তুমি আর এক ডজন ডিম নিয়ে এসো অামি এখানে আছি।
 
আমি গেলাম ভেতরে এবং আরও একডজন ডিম নিয়ে এলাম। মেয়েটি আমাকে সহযোগীতা করলো এবং আমি ফোর রীড করাতে গেলে সে আমাকে বাধা দিয়ে বলল, তুমি তো ৩টি নিয়েছে- ফোর করছো কেন?
আমি বললাম, আমি তো একটা ভেংগে ফেলেছি, ওটার দায়িত্ব তো আমারই হবার কথা!
 
কিন্তু সে আমাকে হাসি মুখে বলল, দেখ- ভেংগেছে আমাদের দোকানে- সেজন্য তুমি দায়ী হবে কেন? হাত থেকে পড়ে ভাংতেই তো পারে। সরি, তুমি কস্ট নিয়ো না, এবং প্লিজ ৩টির মূল্য পরিশোধ করো।
আমি, বাধ্য ছেলের মতো ৩টির মূল্য পরিশোধ করে এবং একটি ছোট থাংকস দিয়ে বাসায় চলে এলাম।
 
গত মাসে, নিউ ইয়র্কের পার্কচেষ্টারে এবং বাংলাদেশী গ্রোসারীতে বাজার করতে গেছি। ৩টি মূলা নিবো; পাতাগুলি ছিড়ে ফেলে দিলাম। বিল দিতে গেলে বাঙালী দোকানদার আমাকে অনেকটা ধমকের স্বরে বলল- পাতা ছিড়েছেন কেন? ১ ডলার বেশী দিতে হবে। আমি দিয়ে দিলাম।
 
এই আমাদের বাংলাদেশের মহান বাঙালী আচরণ।
বাংলাদেশের জয় হউক।
 
   Send article as PDF