একজন কুপার এবং আবরার

দিনটা ছিল শুক্রবার।২০১৪ সালের ১০ই জানুয়ারী।


৯ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে রাত নয়টার দিকে বাবার সংগে রাস্তা পার হচ্ছিল; নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়েষ্ট-এন্ড এভিনিউ এন্ড ওয়েষ্ট নাইনটি সেভেন্থ ষ্ট্রিট এ। ঠিক তখনই একটা ইয়োলো ক্যাব অনিয়ন্ত্রিতভাবে লেফ্ট টার্ণ করার সময় কেড়ে নেয় ছেলেটার জীবন।
কুপার। হ্যাঁ, বাচ্চাটির নাম ছিল কুপার। কুপারের বাদবাকী গল্পে একটু পরেই আসছি। আপনারা চাইলে এই ফাঁকে কুপার’কে নিয়ে একটু গুগল করে আসতে পারেন।
এবার চলেন আমরা ঢাকায় ফিরি।


সেটা ছিল ২০১৮ সাল। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের রেষারেষিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।

ঐ হতভাগ্য শিক্ষার্থী দু’জনের নাম হয়তো অনেকেই ভুলে গেছে ইতিমধ্যে। ওদের নাম ছিল রাজীব ও দিয়া। হ্যাঁ, আমরা এমনিতেই গতকালের ঘটনা আজ-ই ভুলে যাই এবং নতুন ভাবে আবরার’রা সামনে চলে আসে। আবার আবরার’দের মিলিয়ে যেতেও খুব একটা সময় নেয় না।

যাই হোক, এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা নিরাপদ সড়কের দাবীতে ঢাকার রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।


বাংলাদেশের ছোট ছোট স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের এই আন্দোলন ছিল স্বতস্ফূর্ততায় সমৃদ্ধ। কয়েকটা দিন তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে ট্রাফিক সিষ্টেম পর্যন্ত। তারা দেখেয়েছে কিভাবে ‘লেইন’ মেনে কার ড্রাইভ করতে হয়। তারা ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসারদের পর্যন্ত আইন মেনে গাড়ী চালানোর সবক দিয়েছে।

কিন্তু তারপর?তারপর ছাত্রলীগের ছেলে এসব বাচ্চাদের রাজপথে হাতুরী পিটা করে, কয়েকজনকে হত্যা করে তারপর সেই আন্দোলনকে নিস্তব্দ করিয়ে দিয়েছে আর আমরাও রাজীব ও দিয়া’কে ভুলে গেছি।

রাজীব ও দিয়া’দের জায়গাটা অন্যরা এসে দখল করে নিচ্ছে সীমিত সময়ের জন্য। ঐ যে বললাম, এরপর আবরার আসছে। অন্যরাও আসবে সিরিয়ালে। প্রকৃতি যেহেতু শূন্যতা মানে না। তারপর একদিন আমরা আবরারদেরও ভুলে যাবো। পুরাতন নাম মুছে গিয়ে নতুন নাম আসবে।

আর এরপর বাংলাদেশের পুলিশের গল্প বলে কি লাভ হবে- সেসব তো আপনারা আমার’চে ঢের ভালোই জানেন। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রকাশ্যে পিস্তল উচিয়ে ইয়োলে দাঁত কেলিয়ে হুমকী দেয়, ‘খ্যাইয়্যা ফালামু’।


এবার চলুন কুপারের গল্পে ফিরে যাই।


আমেরিকায় সবচে ক্ষমতাবান হচ্ছে বাচ্চারা। মানে ১৮ বছর বয়সের নীচের বাচ্চারাই এই ভূখন্ডের সবচে ক্ষমতাশালী। এদেশ সবচে বেশী ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে তার শিশুদের। আমেরিকায় ১৮ বছরের নীচের কোন শিশু বা কিশোর-কিশোরীর সংগে ভুলেও কেউ দুব্যবহার করার স্পর্ধা দেখায় না। কারণ সে জানে এতে তার বাদবাকী জীবনটা ‘হেল’ হয়ে যাবে।


যায়ও। এদেশটাই এমন।আইনে যা লেখা আছে- সেটাই ঘটবে। অক্ষরে অক্ষরে আইন মানা হয় এদেশে।


আচ্ছা কুপারের গল্পে যাবার আগে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। খুব একটা অপ্রাসংগিক হবে না অবশ্য আমার আজকের মূল বক্তব্যের সংগে।
বাংলাদেশে আমাকে কোনদিন পুলিশে ধরে নি। অভিজ্ঞতা নেই। মামলা বা জিডিও খাইনি কোনদিন। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে আসার ১ বছরের মধ্যেই একবার পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে গেলাম।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা নিয়ে আমার একটা আর্টিকেলও রয়েছে- আমাকে যারা নিয়মিত পড়েন তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন ঘটনাটি।

আমি জ্যামাইকা থেকে কিউ-৪৪ বাসে উঠেছি ব্রঙ্কসে বাসায় ফিরবো।
বাসগুলিতে সোয়াইপ মেশিন বন্ধ করে প্রতিটি বাস ষ্টপেজ এ এরা নতুন টিকেট ভেন্ডর মেশিন স্থাপন করেছে, আমি মান্থলি আনলিমিটেড মেট্রো কার্ড ব্যবহার করি বিধায় ভাড়া নিয়ে আমার কোন টেনশন থাকে না। নতুন ওই ভেন্ডর মেশিন বিষয়টি আমার চোখে পরেনি এবং বাসে উঠার সময় মেট্রোকার্ড সোয়াইপ করতে না পেরে আমি অন্য কোন সমস্যা ভেবেছিলাম এবং আসলে রাত বেশী হয়ে যাওয়াতে কিছুটা অন্যমনোস্কও ছিলাম।
ফ্লাশিং পার হবার পরই গাড়ীতে বেশ কয়েকজন পুলিশ উঠলো এবং প্রত্যেকের কাছেই টিকেট চেক করছে। আমি তো বোকা হয়ে গেলাম। আমি আমার মেট্রোকার্ড দেখিয়ে বললাম, ‘টিকেট কোত্থেকে কাটবো আমার তো আনলিমিটেড মেট্রোকার্ড রয়েছে’। পুলিশ আমাকে শুধু বললো তাকে ফলো করতে।

আমি আসামীর মতো তাকে ফলো করে নীচে নামলাম, আমার আইডি চাইলো- দিলাম। খসখস করে একটা টিকেট লিখে ফেলল মুহূর্তেই। হাতে দিয়ে বলল আগামী ৩০ দিনের মধ্যে তুমি ১০০ ডলার পেমেন্ট করে দিবে। আমাদের দায়িত্ব টিকেট চেক করা, আমরা তোমার কাছে টিকেট পাইনি। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করেছি। তোমার যদি মনে হয় যে আমরা কোন ভুল বা অন্যায় করেছি তাহলে তুমি এই ৩০ দিনের মধ্যে কোর্টে গিয়ে হেয়ারিং করতে পারো, জাজকে যদি সবকিছু বুঝিয়ে বলো সে হয়তো তোমার পক্ষে রায় দিবে। এবার তুমি অন্য যে কোন একটা বাস ধরে যেখানে যাচ্ছিলে চলে যাও- আজ রাতে আর তোমার কোন টিকেট কাটতে হবে না’। আমাকে ওরা কোন এক্সকিউজ করার বা যুক্তি দেবার সময়ও দিল না। নিউ ইয়র্কের পুলিশ এই পৃথিবীর সবচে প্রফেশনাল পুলিশ তারা তাদের দায়িত্ব ঠিক-ঠাক পালনের সুনাম ধরে রাখে।

যাই হোক, আমিও নাছোরবান্দা। এরা নতুন মেশিন বসিয়েছে, আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তাছাড়া আমার কাছে মান্থলি কার্ড রয়েছে। সুতরাং আমি ১০০ ডলার দিবো না। জাজের কাছে যাবো।

দিন কয়েক পর আমি গেলাম জাজের নির্ধারিত কোর্টে হেয়ারিং এর জন্য।
জীবনের প্রথম বারের মতো কোন জাজের সামনে দাঁড়াবো। ওখানে যেয়ে রিসিপ্টশনে আমার টিকেট দিলাম। মেয়েটি আমাকে বললো, ‘তুমি একটু বসো, জাজ তোমাকে ডাকবে’।

আমি ওয়েটিং রুমে বসে আছি।প্রায় ঘন্টাখানেক পর একজন বয়স্ক হোয়াইট ভদ্রমহিলা আমার নাম ধরে ডাকছেন। আমি ভাবলাম তিনি হয়তো আমাকে জাজের কাছে নিয়ে যাবেন। সামনে যেতেই তিনি আমাকে বললেন, ‘হাই স্যার। হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে; প্লিজ ফলো মি’।

আমি একটু পরেই বুঝলাম ‘ইনিই’ জাজ।তার চেম্বারে নিয়ে আমাকে বসালেন। প্রথমেই আমাকে বললেন তুমি ইংলিশে স্বাচ্ছন্দ কিনা? না হলে তুমি বাংলায় হেয়ারিং করতে চাও কি না? তারপর বললেন, তুমি কি আজই হেয়ারিং করতে প্রস্তুত না কি অন্য কোন দিন করতে চাও? এরপর বললেন সেদিন যে পুলিশ অফিসার তোমাকে টিকেট দিয়েছে- তুমি কি চাও তাকে আমি হাজির করি এখানে? অথবা সেদিনের সেই বাস ড্রাইভারকে!
সবকিছুতে আমি না বলে তাকে বললাম তোমার সিদ্ধান্তে আমার ভরশা আছে- আমি কাউকেই চাই না, আমি গল্প তোমাকে বলবো তারপর তুমি বিচার করবে।

জাজ মিষ্টি করে হেঁসে বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। কিন্তু তুমি আমাকে আরও একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। সেদিন যে পুলিশ অফিসার তোমাকে টিকেট দিয়েছিল সে কি তোমার হাত ধরেছিল বা তোমার সংগে কি কোন অসুন্দর আচরণ করেছে? যদি করে থাকে তাহলে নির্দিধায় আমাকে বল- আমি তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিবো।’

আমি জাজের এই প্রশ্নে সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গেলাম।নিজের ফেলে আসা দেশটি নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল এটা যেন ‘জাহান্নাম থেকে জান্নাতে উঠে আসার গল্প’!
হ্যাঁ। বিগত ৫ বছরের অভিজ্ঞতায় বলছি এই দেশটাতে কোন পুলিশ আপনার শরীরে একটা ফুলের টোকা দেবারও ক্ষমতা রাখে না। ইভেন পুলিশ যদি কাউকে এরেষ্টও করে এবং হ্যান্ডকাপ পড়ানোর সময় বা ধরে নেবার সময় সামান্য একটু ব্যাথাও দেয়- তাতেও ঐ পুলিশের ‘খবর’ করে ছেড়ে দেয়া সম্ভব। এটা আমেরিকা।

আরও একটা কথা বলে বিষয়টা শেষ করি।আমেরিকার পুলিশ’কে আপনি যদি বাসার গেট না খুলেন- তার কোন ক্ষমতাই নেই আপনার দরজা ভেংগে আপনাকে গ্রেফতার করবে! এমনকি সবচে ক্ষমতাধর হোমল্যান্ড সিকিউরিটির আইস পুলিশেরও সেই অধিকার নেই।
এবং ধরে নিলাম আপনি গ্রেফতার হয়েছেন। এবার যদি আপনি পুলিশ’কে বলেন যে, ‘আমি তোমার সংগে কোন কথা বলবো না। যা কথা বলার আমার এটর্ণী বলবে।’ ব্যস। এরপর আর ঐ পুলিশের (যত বড় অফিসারই নিয়ে আসুক) আর কোন ক্ষমতাই থাকে না আপনাকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করবে।

এই দেশে সবার আগে আপনি।
যাই হোক। আমরা কুপারের গল্প করছিলাম।

শিশু কুপারের মৃত্যু নিউ ইয়র্কে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।পরদিন নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন। এবং পুরো নিউ ইয়র্ক সিটি প্রশাসন নড়েচরে বসে। চলে আলোচনা। হ্যাঁ নিউ ইয়র্কে তখনও সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যেত। ঐ বছরই মানে ২০১৪’তে-ই সর্বমোট ৯৬৬টি কার এক্সসিডেন্টে সর্বমোট ১০২৬ জন মানুষ মারা যায়।

মেয়র বিল ডি ব্লাজিও তার টিমকে নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোন মূল্যে এই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ‘জিরো’ নামিয়ে আনতে হবে।

শুরু হলো নতুন আইন প্রণয়নের। আর সেই নতুন আইনটির নাম ‘কুপার ল’। হ্যাঁ নিউ ইয়র্ক কুপার’কে ভুলতে দেয়নি নিউ ইয়র্কারদের।

‘ভিশন জিরো’ ক্যাম্পেইনে নিউ ইয়র্ক সিটির জন্য নতুন প্রণিত হলো ‘কুপার ল’।
মেসিভ চেঞ্জেস আনা হলো নিউ ইয়র্কে সড়ক ডিজাইন ও ট্রাফিক আইনে। টিকেটের সংখ্যা বাড়িয়ে ডাবল করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হলো। রাস্তায় নতুনভাবে লেইন, বাইসাইকেল লেন, বাস লেন, ক্যামেরা ও রোডআইল্যান্ড নির্মিত হলো। নতুন দাগ দেয়া হলো। নতুন সাইনবোর্ড বসানো হলো। নতুন ট্রাফিক লাইট সংযোজন করা হলো। এবং ‘থার্টি মাইল পার আওয়া’ স্পীড লিমিট কমিয়ে ২৫ করা হলো।

উদ্দেশ্য ‘ভিশন জিরো’। আর একজন পথচারীও যেন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা না যায়। একজন কুপার আজ হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছে। নিউ ইয়র্ক আজ ভীশন জিরোতে পৌছাতে না পারলেও মৃত্যু সংখ্যা অনেক গুন কমিয়ে দিতে পেরেছে।
তবে, বাংলাদেশ ভুলে গেছে রাজীব ও দিয়া’র নাম।আমি জানি বাংলাদেশ আবরারের নামও ভুলে যাবে খুব শিগগিরই।

আমরা ট্রাফিক ল পরিবর্তন করতে জানি না। আমরা হলে হলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে না গেলে ক্ষমতায় থাকতে পারবো কিভাবে?

তাছাড়া বাংলাদেশে ‘প্রশাসক নিজেই আইন তৈরী করেন আবার নিজের সুবিধা মতো আইন বাতিলও করতে পারেন’। যে রাষ্ট্র চালাবে সে নিজেই যদি আইন প্রণয়ন করে তাহলে আর জাতীয় সংসদ রাখার বাহুল্য কেন?

আমরা দু’দিন পরপরই দেখি বিশ্বের সবচে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি তার নিজ দেশের আইন প্রণেতা (কংগ্রেস)দের কাছে কেমন অসহায় তাকিয়ে থাকে- সরকারকে সাটডাউনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। ট্রাম্প এখানে আইন তৈরী করতে পারে না, সে শুধুই কংগেসের করে দেয়া আইনে দেশ চালাতে পারে।

বাংলাদেশে একজন-ই বসে বসে দেশ চালান। অন্যরা জনগনের টাকা খায় আর ঐ একজনের হুকুম তামিল করে।

আর বাংলাদেশের মানুষও ভাবে ‘দেশটা বুঝি এভাবেই চালাতে হয়’!পরিবর্তন চাওয়ার যোগ্যতাও বুঝি বাংলাদেশীদের নেই।

এদেশে আবরার’রা কুপারের মতো আর কোন নির্যাতন বা হত্যাকান্ড বন্ধ করারও ক্ষমতা রাখে না!

   Send article as PDF