সোনার হরিণ

ছোট বেলায় কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ওয়েষ্টার্ণ বইগুলি প্রচুর পড়তাম। রোমানা আফাজের দসূ্ বনহুরও পড়তাম; তখন তো আর হূমায়ূন স্যার সেভাবে উপস্থিত ছিলেন না- ওগুলিই ভরসা ছিল। সেবা প্রকাশনীর ওয়েষ্টার্ণ নোবেলের বাংলা অনুবাদগুলি একটু ধৈর্য নিয়ে পড়তে হতো বাট আমার খুব ভাল লাগতো; ভিন্ন সাংস্কৃতির ভিন্ন রূচির উপন্যাস।
 
ওসব ওয়েষ্টার্ণ বই গুলিতে শেরীফ, সেলুন, রান্স, ঘোড়া নিয়ে দৌড়া-দৌড়িতে ভিন্ন উম্মাদনা ছিল। ভাল লাগতো।
আমেরিকার যে শহরটিতে বর্তমানে আমি রয়েছি তার নাম আর্লিংটন। টেক্সাস ষ্টেটের ডিএফঢব্লিও তে এর অবস্থান। ‘রিপাবলিক অব টেক্সাস’ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটি ১৮৪৫ সালে ২৮তম ষ্টেট হিসাবে ইউনাইটেড ষ্টেটস এ যোগ দেয় এবং এটি বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন ও জনস্ংখ্যার দিক দিয়ে ২য় বৃহত্তম ষ্টেট। রাজধানী অষ্টিন, বৃহত্তম শহর হিউষ্টন আর বৃহত্তম মেট্রো হলো ডালাস-ফোর্ট ওর্থ-আর্লিংটন বা সংক্ষেপে ডিএফডব্লিও। এই ডিএফডব্লিও তে ই রয়েছে বিশ্বের ৭ম বৃহত্তম ও ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট যা ডিএফডব্লিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত।
 
ওয়েষ্টার্ণ উপন্যাসগুলিতে মূলত যে-সব অঞ্চলের বর্ণনা দেয়া হতো তা আসলে টেক্সাসেরই। আমি যেন সেই সেদিনের পড়া উপন্যাসের বর্ণনাগুলি নিজের চোখে এখন জীবন্ত দেখতে পাচ্ছি। ডিএফডব্লিও মূলত ‘কাউবয়’দের শহর হিসাবেই পরিচিত।
 
আগেই বলেছি আমি আমেরিকাকে দেখার জন্যই অনেক কষ্ট করে নিউ ইয়র্ক থেকে ডালাস এসেছিলাম সড়ক পথে গ্রে হাউন্ডের বাসে করে। আমার দেখা স্বার্থক হয়েছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের অনুবাদ করা সেই ওয়েষ্টার্ণ উপন্যাসের মাঠ- যেখানে কাউবয়রা ঘোড়া নিয়ে দৌড়াতে, মাড়ামারি করতো, সেই কাউবয়, সেই সেলুন, সেইসব শেরীফদের আমি নিজ চোখে দেখতে পেয়েছি।
 
কাউবয়’রা এখন প্রায়ই আমার সামনে দিয়ে চলাফেরা করে। তবে এখন আর ঘোড়াতে নয়। টেক্সাসের বিখ্যাত পিকআপ ভ্যান ই এদের প্রধান বাহন। দেখতে খুব ভাল লাগে। বড় হ্যাট পরে মাথায়। বিশাল গোফ নজর কাড়ে। কাউবয়দের বিখ্যাত ষ্টেডিয়াম ‘এটিএন্ডটি ষ্টেডিয়াম’টি ঠিক আমার বাসার কাছেই।
 
ডিএফডব্লিও বা অতি সহজে ডালাস শহরটি অনেক বড়, বিশাল। এখানে ৩টি বড় এয়ারপোর্ট রয়েছে। আর ছোটখাটোতো বেশ কয়েকটি যেখানে প্রাইভেট ফ্লাইটগুলি নিয়ে ছোট ছোট হেলিকপ্টারগুলিই বেশী উঠানামা করে।
ডালাসে আমি ছাড়া আর কোন গাড়ী ছাড়া মানুষ নেই।
 
এ শহরে সকলেরই গাড়ী রয়েছে, এবং একাধিক। গাড়ী এখানে খুব সস্তা। ২০০ ডলার ডাউনপেমেন্টে গাড়ী দিয়ে দেয়; কাগজপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স কিছুই লাগে না। মাসিক ইন্সুরেন্স করা থাকে; কাউকে একসিডেন্ট করলে ক্ষতিপূরণ ইন্সুরেন্স কোম্পানী দিয়ে দেয়। আমি কদাচিত ডালাসে এক আধটা পুলিশের কার দেখেছি, এছাড়া কোন পুলিশ এশহরে রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমার এক ফ্রেন্ড ডালাসে একা থাকে; বউ বাচ্চা বাংলাদেশে, সে বিরক্ত- দেশে যেতে সদা উদগ্রীব। কিন্তু যেতে পারছে না; বাংলাদেশে একসময় ব্যবসা করতো, প্রচুর লস করেছে, ব্যবসা বন্ধ। দেশে যেয়ে করবে কি? তার ওয়াইফ তাকে আমেরিকায় থাকতে বলে নইলে সংসার চলবে না যে!।
ইতিমধ্যে তার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। একদিন সে আমাকে ফোন করে জানালে, আজ নাকি সে পুলিশে ধরা দেবে। এতে এক ঢিলে দু’ই পাখি মারা হবে; এক. বউ কে বলতে পারবে পুলিশ তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে আর, নিজের বিমান ভাড়াটাও বেচে যাবে, সরকারী খরচে দেখে ফিরতে পারবে।
 
অনেক কষ্টে সে ডালাসে পুলিশ খুজে পেল, পুলিশকে নিজের পাসপোর্ট দেখিয়ে বলল, দেখ আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, আমি অবৈধ, আমাকে এরেষ্ট করে দেশে পাঠিয়ে দাও।
 
পুলিশ তাকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, এটা আমার ডিউটি নয়। তুমি একটু কষ্ট করে ইমিগ্রেশনে যোগাযোগ কর।
 
ইকবাল ভাই পুলিশের ব্যবহারে রীতিমত হতাশ!
 
ডালাসে রাস্তায় কোন মানুষ দেখা যায় না। শুধু গাড়ী আর গাড়ী। আর রাস্তাগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা ও ট্রাফিক লাইটিং সিষ্টেম এতোটা সুন্দর ও আধুনিক যে, চোখ খোলা রেখে কারো পক্ষে একসিডেন্ট করা সম্ভব নয়।
সকলেই অত্যন্ত ভদ্র ড্রাইভিং- এ। এদেশে রাস্তায় চলাচলে ফাষ্ট প্রাইরটি ‘হেটে চলা মানুষের’ (আমার মত)। তাছাড়া আমি হাটতে ভালবাসি। আমার বাসা থেকে সবচে কাছের বাজারটি, যার নাম কুগার দেড় মাইল দুরে আর তার পরের টি ওয়ালমার্ট ২ মাইল দুরে। হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই আমার। সবচে কছের বাস ষ্ট্যান্ডটি ৩ মাইল দুরে।
 
এ শহরে তো কেউ হাটে না। এশহরের ডিজাইন করা হয়েছে এভাবেই। বাংলাদেশের গুচ্ছ গ্রামের মতো অসংখ্য এপার্টমেন্ট কম্পপ্লেক্স। এপার্টমেন্টগুলি আমাদের দেশের মতো না। ঢাকার এপার্টমেন্ট মানে একটি বহুতল ভবন।
আর এখানে এপার্টমেন্ট মানে ২ তলা বা সবোর্চ্চ ৩ তিলা বিশিষ্ট (চার বা ছয় ফ্লাট) ৪০/৫০টি আলাদা ভবন নিয়ে এক একটি এপার্টমেন্ট এরিয়া। এপার্টমেন্টগুলি অত্যন্ত আধুনিক। এয়ারকন্ডিশনার, ফ্রিজার ওইথ আইসমেকার, ওভেন, ডিশ ওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন-ড্রাইয়ার ইত্যাদি বাধ্যতামূলকভাবে থাকে। বিজনেস সেন্টার, সুইমিং পুল, বাস্কেটবল কোর্ট কমন বিষয়।
 
ডালাসে বাসা ভাড়া খুবই কম। ৪০০ থেকে ৭০০ ডলারের মধ্যে ১ বেড রুমের এপার্টমেন্ট পাওয়া যায়; এতটা ষ্টান্ডার্ডের বাসা নিউ ইয়র্ক সিটিতে নেই, আশে পাশে থাকলেও ২৫০০ ডলারের নীচে পাওয়া যাবে না।
এমনকি এখানে ০ ডাউন পেমেন্ট জাষ্ট ৮৫০ ডলার মাসিক কিস্তিতেও বাড়ী কিনতে পাওয়া যায়। ডালাসে মাত্র ৪০০ ডলার ডাউন পেমেন্টে এবং মাসিক ২০০ ডলার কিস্তিতে ৫ একর রেন্স বা জমি কিনতে পাওয়া যায়; যার পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার, লেকের পাশে, হরিন গুরে বেড়ায়; এখনই বাড়ী করা উপযোগী।
 
আমেরিকা যান্ত্রিক দেশ। মানুষ খুবই কম, যন্ত্রই মূলত কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে।
কোন দাড়োয়ান নেই কোথাও, সব অটোমেটিক। আমি যে কুগারে বাজার করি সেখানে এটিএম মেশিন টাইপের একটি মেশিনে আমাকে নিজেকেই প্রতিটি প্রডাক্টের বারকোড রিড করিয়ে, নিজেকেই মেশিনে বিল পেমেন্ট করতে হয়- কেউ নেই। ২৪ ঘন্টা খোলা, কতগুলি ক্যামেরা পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছে। কুগার বা ওয়ালমার্টে সবকিছুই পাওয়া যায়। ওয়ালমার্ট অবশ্য এতটা আধুনিক নয়; ওখানে সেলস পারসন রয়েছে বিল নিতে।
আমেরিকায় ডলারের কারেন্সি নোটকে ‘বিল’ বলা হয়।
 
Schedule বলা হয় স্কাজুয়াল।
হৃদরোগের পরীক্ষা ইসিজি কে বলা হয় ইকেজি।
Night কে অনেক সময়ই Nite লেখা হয়।
 
ডালাসে হাটা পথের মানুষতো তেমন একটা নেই, কাজেই কোন ট্রাফিক সিগনালেই অটোমেটিক ‘পথচারী পারাপারের’ সাদা বাতি কখনোই জ্বলে উঠে না। আমি প্রথমতো একটু ভড়কেই গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম একটা ছোট বোতাম রয়েছে প্রতিটি সিনালেই; ওটাতে চাপ দিলে গাড়ীর রাস্তা বন্ধ হয়ে পায়ে হাটার খুব অল্প সময়ের জন্য বাতি জ্বলে উঠে।
 
অনেক দূরে দূরে গুচ্ছ মার্কেট। দোকানগুলি গড়ে উঠেছে বিশাল পার্কিং এরিয়া সামনে নিয়ে। এখানে ‘ড্রাইভ থ্রু’ বিষয়টি খুবই জনপ্রিয়। অর্থাৎ গাড়ী থেকে কেউ নামবে না; গাড়ীতে বসেই কাজ শেষ করবে এরা। সিভিএস ফার্মেসী থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি রেষ্টুরেন্ট এমনকি ব্যাংকগুলিও ড্রাইভ থ্রু সিষ্টেম রয়েছে। গাড়ী থেকে নামার দরকারটা কি? তাছাড়া গ্যাস (ফুয়েল) এখানে খুব সস্তা। বলতে গেলে বাংলাদেশের বোতলজাত করা পানির মতো মূল্য এখানে গ্যাসের। গ্যাস ষ্টেশনে কোন সাহায্যকারী লোক পাবেন না; নিজের গ্যাস নিজেই নিন, নিজেই পেমেন্ট করুন। কেউ নেই, কেউ নেই। কার সার্ভিস সেন্টারে পানি রয়েছে, নিজে পেমেন্ট করে নিজেই নিজের গাড়ী সার্ভিসিং করে নিন।
 
ফোর্থ ওর্থ এখানকার সবচে পুরাতন শহর, ডালাস তুলনামূলকভাবে নতুন। ডাউন টাউন ফোর্থ ওর্থ আর ডাউন টাউন ডালাসে অনেক বিশাল বিশাল ভবন দেখা যায়। শহরদুটিতে যোগাযোগের জন্য রয়েছে ট্রিটিনি রেলওয়ে। ট্রিটিনি এখানকার একটি বিখ্যাত নদী যা এখন মৃতূপ্রায়। ডালাস বা ফোর্থ ওর্থ অনেক ব্যস্ত শহর এবং অনেক এক্সপেনসিভ। ওখানে মেট্রো ও বাস সার্ভিস রয়েছে। ডিএফডব্লিওতে রয়েছে বেশ কয়েটি বড় বড় লেক। প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এসব লেকে, তেলাপিয়া, রুই, ছোট কাচকি মাছ, পুটি মাছ ইত্যাদি।
 
একসময় টেক্সাসের মানুষগুলি জীবন ছিল ঘোড়া নিয়ে। অনেক দুরে দুরে ছোট ছোট সেলুন (মদ্যপানশালা) আর বাজার-পাট ছিল। এখনও ডালাস সেরকমই রয়েছে; ঘোড়ায় জায়গায় স্থান পেয়েছে গাড়ী; মানুষের কাজ ও ব্যস্ততা এবং জীবনমান বেড়েছে। কাউবয়দের শহরে এখন কাউবয় অনেক কমে গেছে, বেড়েছে কালোদের সংখ্যা সংগে যোগ হয়েছে হিস্পানিকরা।
 
আর, আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করা সাদাদের রাস্তাঘাটে তেমন একটা দেখা যায় না, এরা কোন অড জব করে না। এদের দেখতে পাওয়া যায় অফিসিয়াল জবে এবং গবেষণাধর্মী কাজে। এদের আয়ও অনেক বেশী।
আমেরিকার সবচে সুন্দর বিষয়টি হলো মানুষের ব্যবহার।
 
রাস্তায় যে-কারো সাথে দেখা হলেই ‘হাই’, ‘হাউ আর ইউ’, ‘হাউ আর ইউ ডুইং’ খুব অতি সাধারণ ভদ্রতা। এখানে পরিচিত-অপরিচিতের কোন বিষয় নেই।
 
আসল বিষয়টা হল, আমেরিকার গড় আয় ৫৫,০০০ ডলার। অর্থাৎ গড়ে একজন আমেরিকান মাসে ৪৫০০ ডলার করে প্রতি মাসে আয় করে। যেখানে বাংলাদেশের মানুষ করে মাসে ৯১ ডলার।
 
যারা অড জব করে বা কাগজ পত্র নেই তারাও গড়ে সপ্তাহে ৪০০ থেকে ৪৫০ ডলার আয় করতে পারে; মাসে একটি ফ্যামেলির খরচ মোটামুটি ভদ্রভাবে চলতে গেলে ডালাসে ১০০০ ডলার (তবে নিউ ইয়র্কে ১৬০০ ডলার); দুইজন মানুষ অনায়াসে এখানে ৩২০০ ডলার মাসে আয় করতে পারে।। বাচ্চাদের পড়াশোনায় কোন খরচ নেই; চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি।
 
পর্যাপ্ত টাকা হাতে থাকলে মাথা কার ঠান্ডা থাকবে না? ভদ্র হতে আর কি লাগে?
তাহলে কে বলবে না যে এখানে সোনার হরিণ নেই?
   Send article as PDF