হাওয়াই দ্বীপে

প্রশান্ত মহাসাগর আমি আগেও দেখেছি বেশ কয়েকবার।

লস এঞ্জেলেস এবং সান ফ্রান্সসিসকো দু’টো শহর থেকেই উপভোগ করেছি প্যাসিফিকের সৌন্দর্য!

ম্যানহাটন বীচে এক সন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় দিয়েছি প্যাসিফিককে।

সান্তা মোনিকা সি-বীচেও কাটিয়েছি রোমাঞ্চকর সকাল, সেটাও স্রেফ প্যাসিফিককেই দেখতে। চোখ জুড়াতে।

সুতরাং যথেষ্ঠ না হলেও প্রশান্ত মহাসাগর আমার অচেনা ছিলো না।

সিডনী বা ম্যানিলা থেকেও প্যাসিফিককে অবলোকনের সুযোগ আমার হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও যেহেতু আমি আটলানটিকের পাড়ের বাসিন্দা, সেহেতু প্যাসিফিক আমার সাগর নয়। আমি সেখানে শুধুই অতিথি।

কিন্তু এবার আমি দেখেছি অন্য এক প্যাসিফিককে।

শুধুমাত্র প্যাসিফিককে দু’চোখ ভরে ভিন্ন অবয়বে দেখতেই আমি এবার কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে হাওয়াইয়ান এয়ারলাইন্সের দু’টো ফ্লাইটেই ওইন্ডো-সীট ক্রয় করেছিলাম।

শুরুর জার্নিটা রাতে হলেও সকালটা হয়েছিলো যখন আমি মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের ৪০ হাজার ফুট উপর দিয়ে ঘন্টায় ৭০০ মাইল গ্রাউন্ড স্পীডে উড়ে চলছি।

জানালা খুললাম।

নীচে তাকালাম। কিন্তু এ আমি কি দেখছি!

পানির রঙ কি এমন হয়?

এতোটা ভয়ংকর হতে পারে পানির রঙ দেখতে!

প্রথমে ভেবেছিলাম নীচে হয়তো কোন রুক্ষ পাহাড়। কিন্তু সেটা কিভাবে হয়? মনে হচ্ছিলো রুক্ষ পাহাড়ের উপর দিয়ে যেন ভয়ংকর এক টর্নেডো বয়ে চলছে আর আমি তার উপর দিয়ে উড়ে চলছি। ৪০ হাজার ফিট নীচের দৃশ্য দেখা খুব সহজ বিষয় নয়, বিভ্রান্তি পদে পদে।

কিন্তু তারপরও আমার এ চোখ তো বহুবার বহু সাগর-মহাসাগড় কে ৪০ হাজার ফুট উপর থেকে দেখে অভ্যস্ত-ই!

কিন্তু এটাতো তার কোনটার সংগেই মিলছে না।

প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার চোখে হয়তো কোনও সমস্যা!

কিন্তু আই স্পেশালিস্ট এর সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার চোখ কাছের কোনওকিছু ভালো দেখতে পায় না; কিন্তু দূরের দৃশ্য আমি শতভাগ স্পষ্ট দেখি।

বৃহস্পতি গ্রহের উপর দিয়ে বিগত ৩০০ বছর ধরে ছুটে চলা টর্নোডোর ছবি আমি দেখেছি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এর সৌজন্য। কিন্তু প্যাসিফিকের সাগরের ঢেউ এর টর্নোডো আমার কাছে তারচেও অনেকগুন ভংয়কর মনে হচ্ছিলো তখন।

সে পানি নীল ছিলো না। মোলায়েম ছিলো না।

যেমনটা আমি দেখতাম আটলানটিকের পানিকে উপর থেকে।

মনে হচ্ছিলো রুক্ষটাইপ কালো ভয়ংকর সে জল। সুউচ্চ ঢেউ আমি স্পস্ট দেখেছি। তখনও আমি হাওয়াই আইল্যান্ডস থেকে ১৫০০ মাইল দক্ষিনের আকাশে।

সে কি ভয়ংকর ঢেউগুলো!

কি তার ভয়ংকর রুক্ষ চেহারা!

আমি বিভ্রান্ত হচ্ছিলাম বারবার।

পানি এতো ভয়ংকর হতে পারে, এতো রুক্ষও লাগতে পারে পানিকে!

ফ্লাইটটি সিডনী থেকে উড়ার পর বারবার হাওয়াইয়ান এয়ারলাইন্স ঘোষনা দিচ্ছিলো এই ফ্লাইটে সকল যাত্রীকে সর্বসময় সিট বেল্ট বেঁধে রাখতে হবে- এটা বাধ্যতামূলক। আমি বিমান ভ্রমণে অভ্যস্ত, আমার কাছে তা ঢাকা-কুমিল্লা বাস রোডের মতোই লোকল বাস জার্নির চেয়ে বেশী কিছু মনে হয় না কখনও। আমি ভাংগা গর্তে বাস চলার ঝাকি সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ, ঠিক তেমনি অভিজ্ঞ বিমানের ঝাকি সম্পর্কেও। এটা আমার কাছে মোটেও কঠিন বা ভয়ের কিছু নয়। কিন্তু প্রায় পুরোটা যাত্রা পথই ভয়ংকর প্যাসিফিকের উপর দিয়ে, তাও ৪০ হাজার ফুট উপরে – কিন্তু মনে হচ্ছিলো এক মুহুর্তও বিমান ঝাকিমুক্ত ছিলো না – যদিও ৪০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়া বিমানে ঝাকি থাকে না বললেই চলে; অন্ততেপক্ষে আমার বিগত দিনের অভিজ্ঞতায়। ছোট বিমানগুলো ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে এবং সেগুলোতে কিছুটা ঝাকি হয়, কিন্তু ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় ইতিপূর্বে আমি বিমানে ঝাকি দেখিনি। আজ দেখছি!

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না ক্যাপ্টেন কুক কিভাবে এই ভয়ংকর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে গেছেন সিডনী থেকে অজানা হাওয়াই দ্বীপের উদ্দেশ্যে! একজন মানুষ কতটা সাহসী হতে পারে? কতটা তার বুকের পাটা ছিলো?

আমি জানি না, আমি তা পরিমাপ করতে অক্ষম।

নিজেকে ভীষন ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো!

দুই।

হাওয়াই আইল্যান্ডে ভ্রমণের আগ্রহ আমার বহু বছরের।

তবে, এটা কিন্তু আমার হাওয়াই আইল্যান্ডস ভ্রমন ছিলো না।

আমি হনোলুলুতে ট্রানজিট নিবো, সেখানেই আমেরিকার ইমিগ্রেশন হবে যেহেতু হাইওয়াই আমেরিকান স্টেট। এবং এই হনোলুলুতে আমার লে-ওভার ৭ ঘন্টার। ওখান থেকে নিউ ইয়র্কের কানেকটিং ফ্লাইট।

ইমিগ্রেশন শেষ করে ল্যাগেজ সংগ্রহ করে তা আবার নিউ ইয়র্কের ফ্লাইটে ড্রপ-অফ করতে করতেই ৩ ঘন্টা চলে গেলো। আমেরিকাগামী ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে যদি আপনার ডোমেস্টিক রুট থাকে তাহলেও আপনাকে প্রথম পোর্টে ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টমসও করতে হবে; দ্যান আপনাকেই লাগেজ সংগ্রহ করে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে ড্রফ-অফ করতে হবে। এটাই আমেরিকার নিয়ম। অন্য দেশগুলোতে লাগেজ ফাইনাল ডেস্টিনেশনে অটোমেটিক চলে যায় বা সেখানেই কাস্টমস হয়ে থাকে। আমেরিকা সবকিছুতেই ভিন্ন, আলাদা।

যাই হোক, আমার হাতে বাড়তি ২ ঘন্টা সময় আছে।

সুতরাং এবার হনোলুলু শহরটি ঘুরে দেখতে হবে। উবারের এপসে চেক করে দেখলাম হনোলুলুর সবচে জনপ্রিয় পয়েন্ট হচ্ছে ওয়াইকিকি বীচ। এয়ারপোর্ট থেকে ওয়াইকিকি খুব বেশী একটা দূরে নয়। উবারে গাড়ী কল দিলাম। দু’ঘন্টা ঘুরবো।

১ মিনিটেই গাড়ী এসে উপস্থিত।

ড্রাইভারের অনুমতি নিয়ে সামনের ডানদিকের সীটে বসলাম।

আমার ড্রাইভারের নাম রোসনি।

যথেষ্ঠ মোটা, ফর্সা ভদ্রমহিলার বয়সটা আমি অনুমান করতে পারছিলাম না।

গল্প জুড়ে দিলাম।

রোসনি-ই আমাকে জানালে যে, হাওয়াই আইল্যান্ডেস-এ প্রচুর নারিকেল গাছ হয়, কিন্তু রাস্তার দু’পাশে এসব নারিকেল গাছগুলো নিয়মিত ট্রিম করা হয় যেন গাছের ডাল বা কচি ডাব কারো উপর পরে কাউকে আহত না করে।

এবং প্রচুর নারিকেল হওয়া সত্বেও হাওয়াই দ্বীপে একটি নারিকেল এর দাম ৫ ডলারের নীচে নয়, যেমনটা মূল্য লস এঞ্জেলেস বা নিউ ইয়র্কেও। এমনকি নারিকেল-জাত পন্য এখানে তেমন একটা উৎপাদিত হয় না, থাইল্যান্ড থেকে এখানে আমদানী হয়। উৎপাদনের চেয়ে আমদানী বেশী সাশ্রয়ী।

আমি আগে থেকেই অবগত যে, হাওয়াই আমেরিকার সবচে এক্সপেনসিভ শহরগুলোর একটি।

কিন্তু আমার ভেতরটা উসখুস করছিলো রোসনির বয়স জানতে। বেশীক্ষন বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না। আমেরিকায় মেয়েদের বয়স জানতে চাওয়ার মধ্যে কোন পাপ নেই, তবুও সরাসরি জানতে চাচ্ছিলাম না, আমি চাচ্ছিলাম সে নিজে থেকেই বলুক।

এক পর্যায়ে আমি জানতে চাইলাম, ‘তুমি দিনে কি ২ ঘন্টা ড্রাইভ করো, আই মিন উবার চালাও?’

রোসনি হেসে দিলো। বললো, হ্যা, কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝলে?

আমি বললাম, যারা সময় কাটানোর জন্য উবার চালায় তারা ২ ঘন্টার বেশী ড্রাইভ করার কথা নয়।

সে হেসে দিলো।

বললো, তুমি ঠিকই ধরেছো, কিন্তু কিভাবে বুঝলে? আসলে আমার কোন কাজ নেই। রিটায়ার্ডমেন্টে গিয়েছি তাও ৫ বছর। কি করবো? সময় তো কাটে না। ঘন্টা দুয়েক ড্রাইভ করলে বেশ ফুরফুরে লাগে। ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমার বন্ধুরা সাঁতার কাটে। আমিও সাতার কাটি প্রতিদিন। আমার বন্ধুদের মধ্যে আমি সবচে জুনিয়র, সবচে ছোট। আমার সবচে বয়স্ক বন্ধুটির বয়স কত হতে পারে তা কি তুমি গ্রেস করতে পারো?

আমি হেসে দিলাম। বললাম, আমি তো তোমার বয়সই অনুমান করতে পারছি না, তোমার বন্ধদের বয়স কিভাবে অনুমান করবো, বলো তো?

রোসনি বললো, আমার সবচে বয়স্ক বন্ধুটির বয়স ১০২ বছর। তাকে দেখলে মনে হয় সে ম্যাক্সিমাম এইটি। আর আমার আরেকজন বন্ধু আছে যে নাইনটিওয়ান এবং অপরজন এইটি সিক্স। আর আমার বয়স না জেনে আমার বড় ছেলের বয়স জানতে পারো, সে এখন ফিফটি-টু।

এবার আমি হেসে দিলাম। বললাম, তোমার বড় ছেলে আমারচে ৩ বছরের বড়। যাকগে, কথা সেটা না, ১০২ বছর বয়সেও তোমার বন্ধু নিয়মিত সাতার কাটে? এতো বয়সে তারা এতটা ফিট কিভাবে হয়?

রোসনি বললো, হাওয়াই এর বাসিন্দারা অনেক বছর বেঁচে থাকে। যৌবনও তাদের দীর্ঘদিন অটুট থাকে। হাওয়াই রুক্ষ মহাসাগরের মধ্যে খুবই চমৎকার আবহাওয়ার একটি দ্বীপপুঞ্জ। মানুষগুলো এখানে প্রচন্ড সাহসী এবং পরিশ্রমী। যদিও মেইনল্যান্ড থেকেই এখন বেশী মানুষ এখানে চলে আসছে।

আমি প্রসংগ পরিবর্তন করে জানতে চাইলাম, ‘ওয়াইকিকি’ নিশ্চয়ই হাওয়াইয়ান ওয়ার্ড; তুমি কি আমাকে বলবে যে ওয়াইকিকি অর্থ কি?

রোসনি বললো, ওয়াইকিকি হাওয়াইয়ান শব্দ সেটা আমিও জানি। হাওয়াইয়ান ওয়াই অর্থ ওয়াটার কিন্তু ‘কিকি’ শব্দটির অর্থ আমি জানি না।

আমি অবাক হলাম। কেন জানো না? তোমরা কি বাসায় হাওয়াইয়ান ভাষায় পরিবারের সংগে কথা বলো না?

রোসনি আমাকে উত্তরে যে তথ্যটি জানালো তাতে আমি রীতিমতো আৎকে উঠেছিলাম! সে বললো, না আমরা ইংলিশেই কথা বলি। তুমি হয়তো জানো না যে, আমেরিকান স্টেটস হবার আগে এই দ্বীপগুলোতে প্রকাশ্যে এবং বাড়ীতে হাওয়াইয়ান ভাষায় কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলো। হাওয়াইন ভাষায় কথা বলা ছিলো অপরাধ, বড় শাস্তি পেতে হতো। সে সময় কেউ ভয়ে হাওয়াইয়ান ভাষা কথা বলতো না। এমনকি আমার বাবা-মাও হাওয়াইন ভাষা ভুলে গেছে। আমি তো জানিই না! আমরা ছোট বেলা থেকেই ইংলিশে কথা বলি। অন্য কোন ভাষা জানি না।

আমি মনে মনে সালাম-বরকত-রফিক-জাব্বার এই ’৪ জন ভাষা শহীদদের’ – ছেলেহারা ’শতমায়ে’র কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন!

রোসনি হাসতে হাসতে বলে চলছে, ‘এখন হাওয়াইয়ান ভাষায় কথা বলার উপর আর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু ঐ হাওয়াইয়ান ভাষায় কথা বলার কোন মানুষ আর নেই’।

আমি রোসনির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমরা কি তাহলে আমেরিকান হতে পেরে সুখি?’

অবশ্যই। আমেরিকা আমাদের সুখ দিয়েছে, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে, অতি উন্নত জীবন দিয়েছে। আমেরিকা আমাদের চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা দিয়েছে। একজন মানুষের জীবনে আর কি চাওয়া থাকে? আমেরিকান সিটিজেন পরিচয় দিয়ে আজ আমরা বিশ্বের যে-কোন প্রান্তে স্পেশাল অনার পাচ্ছি। হাওয়াইয়ান পরিচয়ে কি পেতাম আমরা? কিছুই না, লবডংকা! সুতরাং আমরা আমেরিকান হিসাবে খুবই খুশী, আমরা গর্বিত আমেরিকান।

আমি রোসনির জ্বলে উঠা উদ্ভাষিত, আনন্দিত চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর তথাকথিত স্বাধীনতা এবং ভাষার আবেগী সুখ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করলো না আর।

   Send article as PDF